নীলধ্বজের প্রতি জনা
[মাহেশ্বরী পুরীর যুবরাজ প্রবীর অশ্বমেধ-যজ্ঞাশ্ব ধরিলে, —পার্থ তাহাকে রণে নিহত করেন। রাজা নীলধ্বজ রায় পার্থের সহিত বিবাদপরাঙ্মুখ হইয়া সন্ধি করাতে, রাজ্ঞী জনা পুত্রশোকে একান্ত কাতর হইয়া এই নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি। রাজসমীপে প্রেরণ করেন। পাঠকবর্গ মহাভারতীয় অশ্বমেধ পর্ব্ব পাঠ করিলে ইহার সবিশেষ বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিবেন।]
বাজিছে রাজ-তোরনে রণবাদ্য আজি;
হ্রেষে অশ্ব; গর্জ্জে গজ; উড়িছে আকাশে
রাজকেতু; মুহুর্মুহুঃ হুঙ্কারিছে মাতি
রণমদে রাজসৈন্য ;—কিন্তু কোন্ হেতু?
সাজিছ কি, নররাজ, যুঝিতে সদলে—
প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে১
নিবাইতে এ শোকাগ্নি ফাল্পুনির লোহে২ ?
এই তো সাজে তোমারে, ক্ষত্রমনি তুমি,
মহাবাহু! যাও বেগে গজরাজ যথা
যমদণ্ডসম শুণ্ড আস্ফালি নিনাদে!
টুট কিরীটীর গর্ব্ব আজি রণস্থলে!
খণ্ডমুণ্ড তার আন শূল-দণ্ড-শিরে!
অন্যায় সমরে মূঢ় নাশিল বালকে;
এ বিষম জ্বালা, দেব, ভুলিব সত্বরে!
জন্মে মৃত্যু ;—বিধাতার এ বিধি জগতে।
ক্ষত্রকুল-রত্ম পুত্র প্রবীর সুমতি,
সম্মুখসমরে পড়ি, গেছে স্বর্গধামে,—
কি কাজ বিলাপে, প্রভু? পাল, মহীপাল,
ক্ষত্রধর্ম্ম, ক্ষত্রকর্ম্ম সাধ ভুজবলে।
হায়, পাগলিনী জনা! তব সভামাঝে
নাচিছে নর্ত্তকী আজি, গায়ক গাইছে,
উথলিছে বীণাধ্বনি! তব সিংহাসনে
বসিছে পুত্রহা৩ রিপু—মিত্রোত্তম এবে'
সেবিছ যতনে তুমি অতিথি-রতনে।—
কি
লজ্জা! দুঃখের কথা, হায়, কব কারে?
হতজ্ঞান
আজি কি হে পুত্রের বিহনে,
মাহেশ্বরী-পুরীশ্বর
নীলধ্বজ রথী?
যে
দারুণ বিধি, রাজা, আঁধারিলা আজি
রাজ্য,
হরি পুত্রধনে, হরিলা কি তিনি
জ্ঞান
তব? তা না হলে, কহ মোরে, কেন
এ
পাষণ্ড পাণ্ডুরথী পার্থ তব পুরে
অতিথি?
কেমনে তুমি, হায়, মিত্রভাবে
পরশ
সে কর, যাহা প্রবীরের লোহে
লোহিত?
ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম এই কি, নৃমণি?
কোথা
ধনু, কোথা তুণ, কোথা চর্ম্ম, অসি?
না
ভেদি রিপুর বক্ষ তীক্ষ্ণতম শরে
রণক্ষেত্রে,
মিষ্টালাপে তুষিছ কি তুমি
কর্ণ
তার সভাতলে? কি কহিবে, কহ,
যবে
দেশ-দেশান্তরে জনরব লবে
এ
কাহিনী, —
কি কহিবে ক্ষত্রপতি যত?
নররারায়ণ-জ্ঞাণে,
শুনিনু পূজিছ
পার্থে
রাজা, ভক্তিভাবে; —এ কি ভ্রান্তি তব?
হায়,
ভোজবালা৪ কুন্তী—কে না জানে,
তারে,
স্বৈরিণী৫? তনয় তার
জারজ অর্জ্জুনে৬
(কি
লজ্জা), কি গুণে তুমি পূজ, রাজরথি,
নরনারায়ণ-জ্ঞানে?
রে দারুণ বিধি,
এ
কি লীলাখেলা তোর, বুঝিব কেমনে?
একমাত্র
পুত্র দিয়া নিলি পুনঃ তারে
অকালে!
আছিল মান, —
তাও কি নাশিলি?
নরনারায়ণ
পার্থ? কুলটা যে নারী—
বেশ্যা—গর্ভে তার কি
হে জনমিলা আসি
হৃষীকেশ?
কোন্ শাস্ত্রে, কোন্ বেদে লেখে—
কি
পুরাণে—এ
কাহিনী? দ্বৈপায়ন ঋষি
পাণ্ডব-কীর্ত্তন
গান গায়েন সতত।
সত্যবতীসুত
ব্যাস বিখ্যাত জগতে!
ধীবরী
জননী, পিতা ব্রাহ্মণ৭! করিলা
কামকেলি
লয়ে কোলে ভ্রাতৃবধুদ্বয়ে
ধর্ম্মমতি৮! কি দেখিয়া, বুঝাও
দাসীরে,
গ্রাহ্য
কর তাঁর কথা, কুলাচার্য্য তিনি
কু-কুলের?
তবে যদি অবর্তীণ ভবে
পার্থরূপে
পীতাম্বর, কোথা পদ্মালয়া
ইন্দিরা?
দ্রৌপদী বুঝি? আঃ মরি, কি সতী!
শাশুড়ীর
যোগ্য বধু! পৌরব-সরসে
নলিনী!
অলির সখী, রবির অধীনী,
সমীরণ-প্রিয়া!
ধিক্। হাসি আসে মুখে
(হেন দুঃখে) ভাবি যদি
পাঞ্চালীর কথা!
লোক-মাতা
রমা কি হে এ ভ্রষ্টা রমণী?
জানি
আমি কহে লোক রথীকুল-পতি
পার্থ!
মিথ্যা কথা, নাথ! বিবেচনা কর,
সূক্ষ্ম
বিবেচক তুমি বিখ্যাত জগতে।—
ছদ্মবেশে
লক্ষ রাজে ছলিল দুর্ম্মতি
স্বয়ম্বরে।
যথাসাধ্য যে যুঝিল, কহ,
ব্রাহ্মণ
ভাবিয়া তারে, কোন্ ক্ষত্ররথী,
সে
সংগ্রামে? রাজদলে তেঁই সে জিতিল!
দহিল
খাণ্ডব দুষ্ট কৃষ্ণের সহায়ে।
শিখণ্ডীর
সহকারে কুরুক্ষেত্র রণে
পৌরব-গৌরব
ভীষ্ম বৃদ্ধ পিতামহে
সংহারিল
মহাপাপী! দ্রোণাচার্য্য গুরু, —
কি
কুছলে নরাধম বধিল তাঁহারে,
দেখ
স্মরি? বসুন্ধরা গ্রাসিলা সরোষে
রথচক্র
যবে, হায়; যবে ব্রহ্মশাপে
বিকল
সমরে, মরি, কর্ণ মহাযশাঃ
নাশিল
বর্ব্বর তাঁরে।৯ কহ মোরে, শুনি,
মহারথী-প্রথা
কি হে এই মহারথি?
আনায়-মাঝারে
আনি মৃগেন্দ্রে কৌশলে
বধে
ভীরুচিত ব্যাধ; সে মৃগেন্দ্র যবে
নাশে
রিপু, আক্রমে সে নিজ পরাক্রমে!
কি
না তুমি
জান রাজা? কি কব তোমারে
জানিয়া
শুনিয়া তবে কি ছলনে ভুল
আত্মশ্লাঘা১০, মহারথি?
হায় রে কি পাপে,
রাজ-শিরোমণি
রাজা নীলধ্বজ আজি
নতশির,
—হে
বিধাতঃ! —পার্থের
সমীপে?
কোথা
বীরদর্প তব? মানদর্প কোথা?
চণ্ডালের
পদধুলি ব্রাহ্মণের ভালে?
কুরঙ্গীর
অশ্রুবারি নিবায় কি কভু
দাবানলে?
কোকিলের কাকলী-লহরী
উচ্চনাদী
প্রভঞ্জনে নীরবয়ে১১ কবে?
ভীরুতার
সাধনা কি মানে বলবাহু?
কিন্তু
বৃথা এ গঞ্জনা১২। গুরুজন তুমি;
পড়িব
বিষম পাপে গঞ্জিলে তোমারে।
কুলনারী
আমি, নাথ, বিধির বিধানে
পরাধীনা।
নাহি শক্তি মিটাই স্ববলে
এ
পোড়া মনের বাঞ্ছা! দুরন্ত ফাল্পুনি
(এ
কৌন্তেয় যোধে ধাতা সৃজিলা নাশিতে
বিশ্বসুখ!)
নিঃসন্তানা করিল আমারে!
তুমি
পতি, ভাগ্যদোষে বাম মম প্রতি
তুমি!
কোন্ সাধে প্রাণ ধরি ধরাধামে?
হায়
রে, এ জনাকীর্ণ ভবস্থল আজি
বিজন
জনার পক্ষে! এ পোড়া ললাটে
লিখিলা
বিধাতা যাহা, ফলিল তা কালে! —
হা
প্রবীর! এই হেতু ধরিনু কি তোরে,
দশ
মাস দশ দিন নানা যত্ম সয়ে,
এ
উদরে? কোন্ জন্মে, কোন্ পাপে পাপী
তোর
কাছে অভাগিনী, তাই দিলি বাছা,
এ
তাপ? আশার লতা তাই রে ছিঁড়িলি?
হা
পুত্র। শোধিলি কি রে তুই এইরূপে,
মাতৃধার?
এই কি রে ছিল তেরা মনে?
কেন
বৃথা, পোড়া আঁখি, বরষিস্ ১৩ আজি
বারিধারা? রে
অবোধ, কে মুছিবে তোরে?
কেন
বা জ্বলিস্, মনঃ? কে জুড়ারে আজি
বাক্য-সুধারসে
তোরে? পাণ্ডবের শরে
খণ্ড
শিরোমণি তোর; বিবরে ১৪ লুকায়ে,
কাঁদি
খেদে, মর্, অরে মণিহারা ফণি! —
যাও
চলি, মহাবল, যাও কুরুপুরে
নব
মিত্র পার্থ সহ! মহাযাত্রা করি
চলিল
অভাগা জনা পুত্রের উদ্দেশে!
ক্ষত্র-কুলবালা
আমি; ক্ষত্র-কুল বধু;
কেমনে
এ অপমান সব ধৈর্য্য ধরি?
ছাড়িব
এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;
দেখিব
বিস্মৃতি যদি কৃতান্তনগরে
লভি
অন্তে! যাচি চির বিদায় ও পদে!
ফিরি
যবে রাজপুরে প্রবেশিবে আসি,
নরেশ্বর,
“কোথা জনা?” বলি ডাক যদি
উত্তরিবে
প্রতিধ্বনি
“কোথা জনা?” বলি!
একাদশঃ সর্গঃ।
------xXx------
১.
প্রতিবিধান করতে।
২.
রক্তে।
৩.
পুত্রহন্তা
৪.
ভোজরাজের কন্যা।
৫.
অসতী।
৬.
জারজ—উপপতির
পুত্র। অর্জুন ইন্দ্রের ঔরসে জন্মেছিলেন।
৭.
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্মবৃত্তান্ত প্রসঙ্গ।
৮.
ধৃতরাষ্ট্র,
পাণ্ডু প্রভৃতির জন্মবৃত্তান্ত প্রসঙ্গ।
৯.
অর্জুনের প্রতি জনার ব্যাঙ্গোক্তি। অর্জুনের সমুদয় গৌরবকীর্তিও কলঙ্কপূর্ণ এই জনার
ইঙ্গিত।
১০.
আত্মঅহংকার।
১১.
নীরব করে।
১২.
তিরস্কার।
১৩.
বর্ষণ করিস।
১৪.
গর্তে।