:::: সূচীপত্র ::::

পুরুরবার প্রতি উর্ব্বশী


[চন্দ্রবংশীয় রাজা পুরুরবা কোন সময়ে কেশী নামক দৈত্যের হস্ত হইতে উর্ব্বশীকে উদ্ধার করেন। উর্ব্বশী রাজার রূপলাবণ্যে মোহিত হইয়া তাঁহাকে এই নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি লিখিয়াছিলেন। পাঠকবর্গ কবি কালিদাসকৃত বিক্রমোর্ব্বশী নাম ত্রোটক পাঠ করিলে, ইহার সবিশেষ বৃত্তান্ত জানিতে পারিবেন।]

স্বর্গচ্যুত আজি, রাজা, তব হেতু আমি!
গত রাত্রে অভিনিনু দেব-নাট্যশালে
লক্ষীস্বয়ম্বর নাম নাটক; বারুণী
সাজিল মেনকা; আমি অম্ভোজা ইন্দিরা।
কহিলা বারুণী,দেখ নিরখি চৌদিকে,
বিধুমুখি! দেবদল এই সভাতলে ;
বসিয়া কেশব ওই! কহ মোরে, শুনি,
কার প্রতি ধায় মনঃ?গুরুশিক্ষা ভুলি,
আপন মনের কথা দিয়া উত্তরিনু
রাজা পুরুরবা প্রতি!হাসিলা কৌতুকে
মহেন্দ্র ইন্দ্রাণী সহ, আর দেব যত ;
চারি দিকে হাস্যধ্বনি উঠিল সভাতে!
সরোষে ভরতঋষি শাপ দিলা মোরে!

শুন, নরকুলনাথ! কহিনু যে কথা
মুক্তকণ্ঠে কালি আমি দেবসভাতলে,
কহিব সে কথা আজিকি কাজ শরমে ?
কহিব সে কথা আমি তব পদযুগে!
যথা বহে প্রবাহিণী বেগে সিন্ধুনীরে,
অবিরাম ; যথা চাহে রবিচ্ছবি পানে
স্থির আঁখি সূর্য্যমুখী ; ও চরণে রতৱৱ
এ মনঃ! উর্ব্বশী, প্রভু, দাসী হে তোমারি!
ঘৃণা যদি কর, দেব, কহ শীঘ্র, শুনি
অমরা অপ্সরা আমি, নারিব ত্যজিতে
কলেবর ; ঘোর বনে পশি আরম্ভিব
তপঃ তপস্বিনীবেশে, দিয়া জলাঞ্জলি
সংসারের সুখে, শূর! যদি কৃপা কর,
তাও কহ ; যাব উড়ি ও পদ-আশ্রয়ে,
পিঞ্জর ভাঙ্গিলে উড়ে বিহঙ্গিনী যথা
নিকুঞ্জে ! কি ছার স্বর্গ তোমার বিহনে?
শুভক্ষণে কেশী, নাথ, হরিল আমারে
হেমকূটে! এখনও বসিয়া বিরলে
ভাবি সে সকল কথা! ছিনু পড়ি রথে,
হায় রে, কুরঙ্গী যথা ক্ষত অস্ত্রাঘাতে!
সহসা কাঁপিল গিরি! শুনিনু চমকি
রথচক্রধ্বনি দূরে শতস্রোতঃ সম!
শুনিনু গম্ভীর নাদঅরে রে দুর্ম্মতি,
মুহূর্ত্তে পাঠাব তোরে শমনভবনে,
প্রতিনাদরূপে কেশী নাদিল ভৈরবে!
হারাইনু জ্ঞান আমি সে ভীষণ স্বনে!
পাইনু চেতন যবে, দেখিনু সম্মুখে
চিত্রলেখা সখী সহ ও রূপমাধুরী
দেবী মানবীর বাঞ্ছা! উজ্জ্বল দেখিনু
দ্বিগুণ, হে গুণমণি, তব সমাগমে
হেমকূট হৈমকান্তিরবিকরে যেন।
রহিনু মুদিয়া আঁখি শরমে, নৃমণি;
কিন্তু এ মনের আঁখি মীলিল হরষে
িনান্তে কমরাকান্তেহেরিলে যেমতি
কমল! ভাসিল হিয়া আনন্দ-সলিলে!
চিত্রলেখা পানে তুমি কহিলা চাহিয়া,
যথা নিশা, হে রূপসি, শশীর মিলনে
তমোহীনা; রাত্রিকালে অগ্নিশিখা যথা
ছিন্নধূমপুঞ্জ-কায়া; দেখ নিরখিয়া,
এ বরাঙ্গ বররুচি রিচ্যমান এবে
মোহান্তে। ভাঙিলে পাড়, মলিনসলিলা
হয়ে ক্ষণ, এইরূপে বহেন জাহ্নবী
আবার প্রসাদে, শুভে! আর যা কহিলে,
এখনো পড়িলে মনে রাখনি, নৃমণি,
রসিকতা! নরকুল ধন্য তব গুণে!
এ পোড়া হৃদয় কম্পে কম্পমান দেখি
মন্দারের দাম বক্ষে, মধুচ্ছন্দে তুমি
পড়িলা যে শ্লোক, কবি, পড়ে কি হে মনে?
ম্রিয়মাণ জন যথা শুনে ভক্তিভাবে
জীবনদায়ক মন্ত্র, শুনিল উর্ব্বশী,
হে সুধাংশু-বংশ-চুড়, তোমার সে গাথা!
সুরবালা-মনঃ তুমি ভুলালে সহজে,
নররাজ! কেনই বা ভুলাবে, কহ?
সুরপুর-চির-অরি অধীর বিক্রমে
তোমার, বিক্রমাদিত্য! বিধাতার বরে,
বজ্রীর অধিক বীর্য্য তব রণস্থলে!
মলিন মনোজ লাজে ও সৌন্দর্য্য হেরি!
তব রূপগুণে তবে কেন না মজিবে
সুরবালা? শুন, রাজা! তব রাজবনে
স্বয়ম্বরবধূ-লতা বরে সাধে যথা
রসালে, রসালো বরে তেমতি নন্দনে
স্বয়ম্বরবধূ-লতা! রূপগুণাধীনা
নারীকুল, নরশ্রেষ্ঠ, কি ভবে কি দিবে
বিধির বিধান এই, কহিনু তোমারে!
কঠোর তপস্যা নর করি যদি লভে
স্বর্গভোগ; সর্ব্ব অগ্রে বাঞ্ছে সে ভুঞ্জিতে
যে স্থির-যৌবন-সুধাঅর্পিত তা পদে!
বিকাইব কায়মনঃ উভয় নৃমণি,
আসি তুমি কেন দোঁহে প্রেমের বাজারে!
উর্ব্বীধামে উর্ব্বশীরে দেহ স্থান এবে,
উর্ব্বীশ! রাজস্ব দাসী দিবে রাজপদে
প্রজাভাবে নিত্য যত্মে। কি আর লিখিব?
বিষের ঔষধ বিষ, শুনি লোকমুখে।
মরিতেছিনু, নৃমণি, জ্বলি কামবিষে,
তেঁই শাপবিষ বুঝি দিয়াছেন ঋষি,
কৃপা করি! বিজ্ঞ তুমি, দেখ হে ভাবিয়া!
দেহ আজ্ঞা, নরেশ্বর, সুরপুর ছাড়ি
পড়ি ও রাজীব-পদে, পড়ে বারিধারা
যথা ছাড়ি মেঘাশ্রয়, সাগর-আশ্রয়ে,
নীলাম্বুরাশির সহ মিশিতে আমোদে!
লিখিনু এ লিপি বসি মন্দাকিনী-তীরে
নন্দনে। ভূমিষ্ঠভাবে পূজিয়াছি, প্রভু,
কল্পতরুবরে, কয়ে মনের বাসনা।
সুপ্রফুল্ল ফুল দেব পড়িয়াছে শিরে।
বীচিরবে হরপ্রিয়া শ্রবণ-কুহরে
আমার কহেনতুই হবি ফলবতী।
এ সাহসে, মহেষ্বাস, পাঠাই সকাশে
পত্রিকা-বাহিকা সখী চারু-চিত্রলেখা।
থাকিব নিরখি পথ, স্থির-আঁখি হয়ে
উত্তরার্থে, পৃথ্বীনাথ!
নিবেদনমিতি!

ইতি শ্রীবীরঙ্গনাকাব্যে উর্ব্বশীপত্রিকা নাম
দশমঃ সর্গঃ
------xXx------


১. অভিনয় করলাম।
২. সমুদ্রস্থলে উত্থিত লক্ষ্মী।
. দেবরাজ ইন্দ্র
. উন্মীলিত হল
. হওয়া উচিত ছিল কমলকান্তেঅর্থাচন্দ্রকে
.ধোঁয়ার পুঞ্জ ভেদ করে প্রকাশিত অগ্নিশিখা
. শ্রেষ্ঠ দেহ
. শ্রেষ্ঠ দীপ্তি
. শুদ্ধ প্রয়োগ রুচ্যমান অর্থাৎ কান্তিমান

সূত্র : মধুসূদন রচনাবলী-সব্যসাচী রায় (সম্পাদনায়)