:::: সূচীপত্র ::::

জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা

[অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা দুঃশলা দেবী সিন্ধুদেশাধিপতি জয়দ্রথের মহিষী। অভিমন্যুর নিধনানন্তর পার্থ যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, তচ্ছ্রবণে দুঃশলা দেবী নিতান্ত ভীতা হইয়া নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি জয়দ্রথের নিকট প্রেরণ করেন।]

কে যে লিখিয়াছে বিধিএ পোড়া কপালে,
হায়, কে কহিবে মোরে,জ্ঞানশূণ্য আমি!
শুন, নাথ, মনঃ দিয়া ; মধ্যাহ্নে বসিনু
অন্ধ পিতৃপদতলে, সঞ্জয়ের মুখে
শুনিতে রণের বার্ত্তা। কহিলা সুমতি
(না জানি পূর্ব্বের কথা ; ছিনু অবরোধে
প্রবোধিতে জননীরে ;)কহিলা সুমতি
সঞ্জয়,—‘বেড়িল পুনঃ সপ্ত মহারথী
সুভদ্রানন্দনে, দেব! কি আশ্চর্য্য, দেখ
অগ্নিময় দশ দিশ পুনঃ শরানলে!
প্রাণপণে যোঝে যোধ ; হেলায় নিবারে
অস্ত্রজালে শূরসিংহ ! ধন্য শূরকুলে
অভিমন্যু! নীরবিলা এতেক কহিয়া
সঞ্জয় নীরবে সবে রাজসভাতলে
সঞ্জয়ের মুখ পানে রহিলা চাহিয়া

দেখ, কুরুকুলনাথ,’—পুনঃ আরম্ভিলা
দূরদর্শী, —‘ভঙ্গ দিয়া রণরঙ্গে পুনঃ
পালাইয়ে সপ্ত রথী! নাদিছে ভৈরবে
আর্জ্জুনি, পাবক যেন গহন বিপিনে!
পড়িয়ে অগণ্য রথী, পদাতিক-ব্রজ ;
গরজি মরিছে গজ বিষম পীড়নে ;
সভয়ে হ্রেষিছে অশ্ব! হায়, দেখ চেয়ে,
কাঁদিছেন পুত্র তব দ্রোণগুরুপদে !
মজিল কৌরব আজি আর্জ্জুনির রণে!
কাঁদিলা আক্ষেপে পিতা ; কাঁদিয়া মুছিনু
অশ্রুধারা। দূরদর্শী আবার কহিলা ;
ধাইছে সমরে পুনঃ সপ্ত মহারথী,
কুরুরাজ ! লাগে তালি কর্ণমূলে শুনি
কোদণ্ড-টংকার, প্রভু! বাজিল নির্ঘোষে
ঘোর রণ! কোন রথী গুণ সহ কাটে
ধনু ; কেহ রথচূড়, রথচক্র কেহ।
কাটিয়া পাড়িলা দ্রোণ ভীম-অস্ত্রাঘাতে
কবচ ; মরিল অশ্ব ; মরিল সারথি!
রিক্তহস্ত এবে বীর, তবুও যুঝিছে
মদকল হস্তী যেন মত্ত রণমদে!
নীরবিয়া ক্ষণকাল, কহিলা কাতরে
পুনঃ দূরদর্শী ; আহা! চিররাহু-গ্রাসে
এ পৌরব-কুল-ইন্দু পড়িলা অকালে!
অন্যায় সমরে, নাথ, গতজীব, দেখ,
আর্জ্জুনি! হুঙ্কারে, শুন, সপ্ত জয়ী রথী,
নাদিছে কৌরবকুল জয় জয় রবে!
নিরানন্দে ধর্ম্মরাজ চলিলা শিবিরে।
হরষে বিষাদে পিতা, শুনি এ বারতা,
কাঁদিলা ; কাঁদিনু আমি। সহসা ত্যজিয়া
আসন সঞ্জয় বুধ, কৃতাঞ্জলি পুটে,
কহিলা সভয়ে, —‘উঠ, কুরুকুলপতি!
পূজ কুলদেবে শীঘ্র জামাতার হেতু!
ওই দেখ কপিধ্বজে ধাইছে ফাল্গুনি
অধীর বিষম শোকে! গরজে গম্ভীরে
হনু স্বর্ণরথচূড়ে। পড়িছে ভূতলে
খেচর; ভূচরকুল পালাইছে দূরে!
ঝকঝকে দিব্য বর্ম্ম; খেলিছে কিরীটে
চপলা; কাঁপিছে ধরা থর থর থরে!
পাণ্ডু-গণ্ড ত্রাসে কুরু ; পাণ্ডু-গণ্ড ত্রাসে
আপনি পাণ্ডব নাথ, গাণ্ডীবীর কোপে!
মুহুর্মুহুঃ ভীমবাহু টংকারিছে বামে
কোদণ্ডব্রহ্মাণ্ডত্রাস! শুন কর্ণ দিয়া,
কহিছে বীরেশ রোষে ভৈরব নিনাদে ;
কোথা জয়দ্রথ এবে,রোধিল যে বলে
ব্যুহমুখ? শুন, কহি, ক্ষত্ররথী যত ;
তুমি, হে বসুধা, শুন ; তুমি জরনিধি ;
তুমি, স্বর্গ, শুন ; তুমি, পাতাল, পাতালে ;
চন্দ্র, সূর্য্য, গ্রহ, তারা, জীব এ জগতে
আছ যত, শুন সবে ! না বিনাশি যদি
কালি জয়দ্রথে রণে, মরিব আপনি !
অগ্নিকুণ্ডে পশি তবে যাব ভুতদেশে,
না ধরিব অস্ত্র আর এ ভব-সংসারে!’ —
অজ্ঞান হইয়া আমি পিতৃপদতলে
পড়িনু! যতনে মোরে আনিয়াছে হেথা
এই অন্তঃপুরেচেড়ী পিতার আদেশে।
কহ এ দাসীরে, নাথ ; কহ সত্য করি ;
কি দোষে আবার দোষী জিষ্ণুর সকাশে
তুমি? পুর্ব্বকথা স্মরি চাহে কি দণ্ডিতে
তোমায় গাণ্ডীবী পুনঃ ? কোথায় রোধিলে
কোন্‌ ব্যুহমুখ তুমি, কহ তা আমারে?
কহ শীঘ্র, নহে, দেব, মরিব তরাসে!
কাঁপিছে এ পোড়া হিয়া থরথর করি!
আঁধার নয়ন, হায়, নয়নের জলে!
নাহি সরে কথা, নাথ, রসশূন্য মুখে!
কাল অজাগর-গ্রাসে পড়িলে কি বাঁচে
প্রাণী? ক্ষুধাতুর সিংহ ঘোর সিংহনাদে
ধরে যবে বনচরে, কে তারে তাহারে?
কে কহ, রক্ষিবে তোমা, ফাল্গুনি রুষিলে?
হে বিধাতঃ কি কুলক্ষণে, কোন্‌ পাপদোষে
আনিলে নাথেরে হেথা, এ কাল সমরে
তুমি? শুনিয়াছি আমি, যে দিন জন্মিলা
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, অমঙ্গল ঘটিল সে দিনে!
নাদিল কাতরে শিবা ; কুকুর কাঁদিল
কোলাহলে; শূণ্যমার্গে গর্জ্জিল ভীষণে
শকুনি গৃধিনীপাল। কহিলা জনকে
বিদূরসুমতি তাত! ত্যজ এ নন্দনে,
কুরুরাজ! কুরুবংশ-ধ্বংসরূপে আজি
অবতীর্ণ তব গৃহে! না শুনিলা পিতা
সে কথা! ভুলিলা, হায়, মোহের ছলনে!
ফলিল সে ফল এবে, নিশ্চয় ফলিল!
শরশয্যাগত ভীষ্ম, বৃদ্ধ পিতামহ
পৌরব-পঙ্কজ-রবি চির রাহুগ্রাসে!
বীর্য্যাঙ্কুর অভিমন্যু হতজীব রণে।
কে ফিরে আসিবে বাঁচি এ কাল সমরে?
এস তুমি, এস নাথ, রণ পরিহরি!
ফেলি দূরে বর্ম্ম, চর্ম্ম১০, অসি, তূণ, ধনু,
ত্যজি রথ, পদব্রজে এস মোর পাশে।
এস, নিশাযোগে দোঁহে যাইব গোপনে
যথায় সুন্দরী পুরী সিন্ধুনদতীরে
হেরে নিজ প্রতিমুর্ত্তি বিমল সলিলে,
হেরে হাসি সুবদনা সুবদন যথা
দর্পণে১১! কি কাজ রণে তোমার? কি দোষে
দোষী তব কাছে, কহ পঞ্চপাণ্ডু রথী?
চাহে কি হে অংশ তারা তব রাজ্যধনে?
তবে যদি কুরুরাজ ভালবাস তুমি,
মম হেতু, প্রাণনাথ; দেখ ভাবি মনে,
সমপ্রেমপাত্র তব কুন্তীপুত্র বলী।
ভ্রাতা মোর কুরুরাজ ; ভ্রাতা পাণ্ডুপতি!
এক জন জন্যে কেন ত্যজ অন্য জনে,
কুটুম্ব উভয় তব? আর কি কহিব?
কি ভেদ হে নদদ্বয়ে জন্ম হিমাদ্রিতে?
তবে যদি গুণ দোষ ধর, নরমণি ;
পাপ অক্ষক্রীড়া-ফাঁদ কে পাতিল, কহ?
কে আনিল সভাতলে (কি লজ্জা‍!) ধরিয়া
রজস্বলা১২ ভ্রাতৃবধূ ? দেখাইল তাঁরে
ঊ রু ? কাড়ি নিতে তাঁর বসন চাহিল
উলঙ্গিতে অঙ্গ, মরি, কুলাঙ্গনা তিনি?
ভ্রাতার সুকীর্তি যত, জান না কি তুমি?
লিখিতে শরমে, নাথ, না সরে লেখনী!
এস শীঘ্র, প্রাণসখে, রণভূমি ত্যজি!
নিন্দে যদি বীরবৃন্দ তোমায়, হাসিও
স্বমন্দিরে বসি তুমি! কে না জানে, কহ,
মহারথী রথীকুলে সিন্ধু-অধিপতি?
যুঝেছ অনেক যুদ্ধ; অনেক বধেছ
রিপু; কিন্তু এ কৌন্তেয়, হায় ভবধামে
কে আছে প্রহরী, কহ, ইহার সদৃশ ?
ক্ষত্রকুল-রথী তুমি, তবু নরযোনি ;
কি লাজ তোমার, নাথ, ভঙ্গ যদি দেহ
রণে তুমি হেরি পার্থে, দেবযোনি-জয়ী?
কি করিলা আখণ্ডল খাণ্ডব দাহনে?
কি করিলা চিত্রসেন গন্ধর্ব্বধিপতি?
কি করিলা লক্ষ রাজা স্বয়ম্বর কালে?
স্মর, প্রভু! কি করিলা উত্তর গোগৃহে
কুরুসৈন্য নেতা যত পার্থের প্রতাপে?
এ কালাগ্নি কুণ্ডে, কহ, কি সাধে পশিবে?
কি সাধে ডুবিবে হায়, এ অতল জলে?
ভুলে যদি থাক মোরে, ভুল না নন্দনে,
সিন্ধুপতি; মণিভদ্রে ভুল না, নৃমণি!
নিশার শিশির যথায় পালয়ে মুকুলে
রসদানে; পিতৃস্নেহ, হায় রে শৈশবে
শিশুর জীবন, নাথ, কহিনু তোমারে!
জানি আমি কহিতেছে আশা তব কানে
মায়াবিনী।—‘দ্রোণ গুরু সেনাপতি এবে;
দেখ কর্ণ ধনুর্দ্ধরে; অশ্বত্থামা শূরে;
কৃপাচার্য্যে; দুর্য্যোধনেভীম গদাপাণি!
কাহারে ডরাও তুমি, সিন্ধদেশপতি?
কে সে পার্থ? কি সামর্থ্য তাহার নাশিতে
তোমায়? শুন না, নাথ, ও মোহিনী বাণী।
হায়, মরীচিকা আশা ভব-মরুভূমে!
মুদি আঁখি ভাব, দাসী পড়ি পদতরে ;
পদতলে মণিভদ্র কাঁদিছে নীরবে!
ছদ্মবেশে রাজদ্বারে থাকিব দাঁড়ায়ে
নিশীথে ; থাকিবে সঙ্গে নিপুণিকা সখী,
লয়ে কোলে মণিভদ্রে! এসো ছদ্মবেশে,
না কয়ে কাহারে কিছু! অবিলম্বে যাব
এ পাপ নগর ত্যজি সিন্ধূরাজালয়ে ।
কপোতমিথুন সম যাব উড়ি নীড়ে !
ঘটুক যা থাকে ভাগ্যে কুরু পাণ্ডু কুলে!
ইতি শ্রীবীরাঙ্গনাকাব্যে দুঃশলা-পত্রিকা নাম
অষ্টম সর্গ।
------xXx------
১. ব্যাসদেবের বরে সঞ্জয় হস্তীনায় বসে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে ধৃতরাষ্ট্রকে বর্ণনা করেছিলেন। এখানে সেই প্রসঙ্গ বলা হয়েছে।
২. দ্রোণ, কর্ণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, শকুনি, দুর্যোধন, দুঃশাসন এই সপ্ত মহারথী একযোগে যুদ্ধ করে অভিমন্যুকে বধ করেছিল।
৩. যোদ্ধা।
৪. ভয়ে গণ্ডস্থল পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করল।
৫. অভিমন্যু-নিধনের দিন দেববরে জয়দ্রথ ছিলেন অজেয়। সেকারণে সেদিন তিনি চক্রব্যূহের মুখ রোধ করেছিলেন। অভিমন্যুর সাহায্যের জন্য তাই পাণ্ডবপক্ষীয় কোন বীরই ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনি।
৬. পরিচারিকা।
৭. বনবাসী পাণ্ডবদের কুটির থেকে একবার দ্রৌপদীকে অপহরণ করবার চেষ্টা করে জয়দ্রথ বিশেষভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন।
৮. শৃগাল।
৯. বীর্যের অঙ্কুর স্বরূপ। অভিমন্যু ছিলেন কিশোরবীর।
১০. ঢাল।
১১. একটি সুন্দর উপমা।
১২. ঋতুমতী।

সূত্র : মধুসূদন রচনাবলী-সব্যসাচী রায় (সম্পাদনায়)