:::: সূচীপত্র ::::

দুর্য্যোধনের প্রতি ভানুমতী

[ভগদত্তপুত্রী ভানুমতী দেবী রাজা দুর্য্যোধনের পত্মী। কুরুশ্রেষ্ঠ দুর্য্যোধন পাণ্ডবকুলের সহিত কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে যাত্রা করিলে অল্প দিনের মধ্যে রাজমহিষী ভানুমতী তাঁহার নিকট নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি প্রেরণ করিয়াছিলেন।]
অধীর সতত দাসী, যে অবধি তুমি
করি যাত্রা পশিয়াছ কুরুক্ষেত্র-রণে!
নাহি নিদ্রা ;নাহি রুচি, হে নাথ, আহারে!
না পারি দেখিতে চখে খাদ্যদ্রব্য যত।
কভু যাই দেবালয়ে; কবু রাজোদ্যানে ;
কভু গৃহ-চূড়ে উঠি, দেখি নিরখিয়া
রণ-স্থল। রেণু-রাশি গগন আবরে
ঘন ঘনজালে যেন; জ্বলে শর-রাশি,
বিজলীর ঝলা সম ঝলসি নয়নে!
শুনি দূর সিংহনাদ, দূর শঙ্খ-ধ্বনি,
কাঁপে হিয়া থরথরে! যাই পুনঃ ফিরি।
স্তম্ভের আড়ালে, দেব, দাঁড়ায়ে নীরবে,
শুনি সঞ্জয়ের মুখে যুদ্ধের বারতা,
যথা বসি সভাতলে অন্ধ নরপতি!
কি যে শুনি, নাহি বুঝিআমি পাগলিনী!

মনের জ্বালায় কভু জলাঞ্জলি দিয়া
লজ্জায়, পড়িয়া কাঁদি, শাশুড়ীর পদে,
নয়ন-আসারে ধৌত করি পা দুখানি।
নাহি সরে কথা মুখে, কাঁদি মাত্র খেদে!
নারি সান্ত্বনিতে মোরে, কাঁদেন মহিষী;
কাঁদে কুরু-বধূ যত! কাঁদে উচ্চ-রবে,
মায়ের আঁচল ধরি, কুরু-কুল-শিশু,
তিতি অশ্রুনীরে, হায়, না জানি কি হেতু!
দিবা নিশি এই দশা রাজ-অবরোধে
কুক্ষণে মাতুল তবক্ষম দুঃখিনীরে!
কুক্ষণে মাতুল তব, ক্ষত্র-কুল-গ্লানি,
আইল হস্তিনাপুরে! কুক্ষণে শিখিলা
পাপ অক্ষবিদ্যা, নাথ, সে পাপীর কাছে!
এ বিপুল কুল, মরি মজালে দুর্ম্মতি,
কাল-কলিরূপে পশি এ বিপুল-কুলে!
ধর্ম্মশীল কর্ম্মক্ষেত্রে ধর্ম্মরাজ-সম
কে আছে, কহ তা, শুনি? দেখ ভীমসেনে,
ভীম পরাক্রমী শূর, দুর্ব্বার সমরে!
দেব-নর-পূজ্য পার্থঅব্যর্থ প্রহরী!
কত গুণে গুণী, নাথ, নকুল সুমতি,
সহ শিষ্ট সহদেব, জান না কি তুমি?
মেদিনী-সদনে রমা দ্রুপদ-নন্দিনী!
কার হেতু এ সবারে ত্যজিলা, ভূপতি?
গঙ্গাজল-পূর্ণ ঘটে, হায় ঠেলি ফেলি,
কেন অবগাহ দেহ কর্ম্মনাশা-জলে?
অবহেলি দ্বিজোত্তমো চণ্ডালে ভকতি?
অম্বু-বিম্ব, নীরবৃন্দ ফুলদূর্ব্বাদলে
নহে মুক্তাফল, দেব। কি আর কহিব?
কি ছলে ভুলিলা তুমি, কে কবে আমারে?
এখনও দেহ ক্ষমা, এই ভিক্ষা মাগি,
ক্ষত্রমণি! ভাবি দেখ,চিত্রসেন যবে,
কুরুবধূদলে বাঁধি তব সহ রথে,
চলিল গন্ধর্ব্বদেশে, কে রাখিল আসি
কুলমান প্রাণ তব, কুরুকুলমণি?
বিপদে হেরিলে অরি, আনন্দ-সলিলে
ভাসে লোক; তুমি যার পরমারি, রাজা
ভাসিল সে অশ্রুনীরে তোমার বিপদে!
হে কৌরবকুলনাথ, তীক্ষ্ম শরজালে
চাহ কি বধিতে প্রাণ তাহার সংগ্রামে
প্রাণ, প্রাণাধিক মান রক্ষিল যে তব
অসহায় যবে তুমি, হায়, সিংহ-সম,
আনায়-মাঝারে বদ্ধ রিপুর কৌশলে?
হে দয়া, কি হেতু, মাতঃ এ পাপ সংসারে
মানব-হৃদয়ে তুমি কর গো বসতি!
কেন গর্ব্বী কর্ণে তুমি কর্ণদান কর,
রাজেন্দ্র? দেবতাকুলে জিনিল যে রণে;
তোমা সহ কুরুসৈণ্যে দলিল একাকী
মৎস্যদেশে; আঁটিবে কি রাধেয়১০ তাহারে?
হায়, বৃথা আশা নাথ! শৃগাল কি কভু
পারে বিমুখিতে, কহ, মৃগেন্দ্র সিংহেরে?
সূতপুত্র সখা তব? কি লজ্জা, নৃমণি,
তুমি চন্দ্রবংশচূড়, ক্ষত্রবংশপতি?
জানি আমি বীমবাহু ভীষ্ম পিতামহ;
দেব-নর-ত্রাস বীর্য্যে দ্রোণাচার্য্য গুরু।
স্নেহপ্রবাহিণী কিন্তু এ দোঁহার বহে
পাণ্ডবসাগরে, কান্ত, কহিনু তোমারে।
যদিও না হয় তাহা; তবুও কেমনে,
হায় রে প্রবোধি, নাথ, এ পোড়া হৃদয়ে?
উত্তর-গোগৃহ-রণে জিনিল কিরীটী
একাকী এ বীরদ্বয়ে! সৃজিলা কি, তুমি,
দাবাগ্নির রূপে, বিধি, জিষ্ণু ফাল্গুনিরে১১
এ দাসীর আশা-বন নাশিতে অকালে?
শুন নাথ; নিদ্রা-আশে মুদি যদি কভু
এ পোড়া নয়ন দুটি; দেখি মহাভয়ে
শ্বেত-অশ্ব কপিধ্বজ স্যন্দন সম্মুখে!
রথমধ্যে কালরূপী১২ পার্থ! বাম করে
গাণ্ডীব১৩কোদণ্ডোত্তম১৪। ইরম্মদ-তেজা
মর্ম্মভেদী দেব-অস্ত্র শোভে হে দক্ষিণে!
কাঁপে হিয়া ভাবি শুনি দেবদত্ত-ধ্বনি১৫!
গরজে বায়ুজ ধ্বজে কাল মেঘ যেন!
ঘর্ঘরে গম্ভীর রবে চক্র, উগরিয়া
কালাগ্নি। কি কব, দেব, কিরীটের আভা?
আহা, চন্দ্রকলা যেন চন্দ্রচূড়-ভালে!
উজলিয়া দশ দিশ, কুরুসৈন্য-পানে
ধায় রথবর বেগে! পালায় চৌদিকে
কুরুসৈন্য,তমঃ-পুঞ্জ রবির দর্শনে
যথা! কিম্বা বিহঙ্গম হেরিলে অদূরে
বজ্রনখ বাজে যথা পালায় কুজনি
ভীতচিত ; মিলি আঁখি অমনি কাঁদিয়া!
কি কব ভীমের কথা? মদকল-করী-
সদৃশ উম্মদ দুষ্ট নিধন-সাধনে!
জবাযুগ-সম আঁখিরক্তবর্ণ সদা।
মার, মার শব্দ মুখে! ভীম গদা হাতে,
দণ্ডধর-হাতে, হায়, কালদণ্ড যথা!
শুনেছি লোকের মুখে, দেব-সমাগমে
ধরিলা দুরন্তে গর্ভে কুন্তী ঠাকুরাণী।
কিন্তু যদি দেব পিতা, যমরাজ তবে
সর্ব্ব-অন্তকারী যিনি! ব্যাঘ্রী বুঝি দিল
দুগ্ধ দুষ্টে! নর-নারী-স্তন-দুগ্ধ কভু
পালে কি, কহ, হে নাথ, হেন নর-যমে?
বাড়িতে লাগিল লিপি; তবুও কহিব
কি কুস্বপ্ন, প্রাণনাথ, গত নিশাকালে
দেখিনু ;বুঝিয়া দেখ, বিজ্ঞতম তুমি;
আকুল সতত প্রাণ না পারি বুঝিতে
এ কুহক! গত রাত্রে বসি একাকিনী
শয়নমন্দিরে তব নিরানন্দ এবে
কাঁদিনু! সহসা, নাথ, পুরিল সৌরভে
দশ দিশ; পূর্ণচন্দ্র-আভা জিনি আভা
উজ্জ্বলিল চারি দিক্‌ ; দাসীর সম্মুখে
দাঁড়াইলা দেববালাঅতুলা জগতে!
চমকি চরণযুগে নমিনু সভয়ে।
মুছিয়া নয়নজল, কহিলা কাতরে
বিধুমুখী,বৃথা খেদ, কুরুকুলবধূ,
কেন তুমি কর আর? কে পারে খণ্ডাতে
বিধির বাঁধন, হায়, এ ভবমণ্ডলে?
ওই দেখ যুদ্ধক্ষেত্র!দেখিনু তরাসে,
যত দূর চলে দৃষ্টি, ভীম রণভুমি!
বহিছে শোণিত-স্রোত প্রবাহিণীরূপে;
পড়িয়াছে গজরাজি, শৈলশৃঙ্গ যেন
চূর্ণ বজ্রে; হতগতি অশ্ব; রথাবলী
ভগ্ন; শত শত শব! কেমনে বর্ণিব
কত যে দেখিনু, নাথ, সে কাল মশানে!
দেখিনু রথীন্দ্র এক শরশয্যোপরি!
আর এক মহারথী পতিত ভূতলে,
কণ্ঠে শূণ্যগুণ ধনু ;দাঁড়ায়ে নিকটে,
আস্ফালিছে অসি অরি-মস্তক চ্ছেদিতে!
আর এক বীরবরে দেখিনু শয়নে
ভূশয্যায়! রোষে মহী গ্রাসীয়াছে ধরি
রথচক্র; নাহি বক্ষে কবচ; আকাশে
আভাহীন ভানুদেব, মহাশোকে যেন!
অদূরে দেখিনু হ্রদ ; সে হ্রদের তীরে
রাজরথী একজন যান গড়াগড়ি
ভগ্ন-ঊরু! কাঁদি উচ্চে, উঠিনু জাগিয়া!
কেন এ কুস্বপ্ন, দেব, দেখাইলা মোরে?
এস তুমি, প্রাণনাথ, রণ পরিহরি!
পঞ্চখানি গ্রাম মাত্র মাগে পঞ্চরথী।
কি অভাব তব কহ ? তোষ পঞ্চ জনে;
তোষ অন্ধ বাপ মায়ে ; তোষ অভাগীর ;
রক্ষ কুরুকুল, ওহে কুরুকুলমণি !

ইতি শ্রীবীরাঙ্গনাকাব্যে ভানুমতী-পত্রিকা নাম

সপ্তম সর্গ

------xXx------

১. ধৃতরাষ্ট্র।
২. শাশুড়ী গান্ধারী।
৩. রাজ-অন্তঃপুরে।
৪. শকুনি।
৫. পাশাখেলা।               
৬. পৃথিবীতে লক্ষ্মী-স্বরূপিনী। এখানে দ্রৌপদী।
৭. বনবাসী পাণ্ডবেরা গন্ধর্বদের বন্দিদশা থেকে কৌরবদের উদ্ধার করেছিলেন।
৮. পরম শত্রু।
৯. বিরাটনগর। উত্তর গোগৃহের কৌরবদের গোহরণকালে অর্জুনের বীরত্বের প্রসঙ্গ।
১০. রাধার পুত্র কর্ণ।
১১. অর্জুন।
১২. সৃষ্টিলয়কালে মহাদেবের সংহারমূর্তিকে মহাকাল বলা হয়। এখানে অর্জুন সংহারমূর্তি।
১৩. অর্জুনের ধনুক।
১৪. শ্রেষ্ঠ ধনুক।
১৫. অর্জুনের যুদ্ধশঙ্খ।


সূত্র : মধুসূদন রচনাবলী-সব্যসাচী রায় (সম্পাদনায়)