:::: সূচীপত্র ::::
অপবিজ্ঞান - (দ্বিতীয় অংশ)

মানুষের কৌতুহলের সীমা নাইসব ব্যাপারেরই সে কারণ জানিতে চায়। কিন্তু তাহার আত্মপ্রতারণার প্রবৃত্তিও অসাধারণতাই সে প্রমাদকে প্রমাণ মনে করেবাক্‌ছলকে হেতু মনে করে। বাংলা মাসিকপত্রিকার জিজ্ঞাসা বিভাগের লেখকগণ অনেক সময় হাস্যকর অপবিজ্ঞানের অবতারণা করেন। কেহ প্রশ্ন করেনবাতাস করিতে গায়ে পাখা ঠেকিলে তাহা মাটিতে ঠুকিতে হয়ইহার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি। কেহ বা গ্রহণে হাঁড়ি ফেলার বৈজ্ঞানিক কারণ জানিতে চান। উত্তর যাহা আসে তাহাও চমৎকার। কিছুদিন পূর্বে 'প্রবাসী'র জিজ্ঞাসা বিভাগে একজন প্রশ্ন করিয়াছিলেন মাছির মল হইতে পুদিনা গাছ জন্মায়ইহা সত্য কিনা। একাধিক ব্যক্তি উত্তর দিলেনআলবৎ জন্মায়ইহা আমাদের পরীক্ষিত। এই লইয়া কয়েক মাস তুমুল বিতন্ডা চলিল। অবশেষে মশা মারিবার জন্য কামান দাগিতে হইলসম্পাদক মহাশয় আচার্য জগদীশচন্দ্রের মত প্ৰকাশ করিলেনপুদিনা জন্মায় না

নিউটন আবিষ্কার করিয়াছেনজড়পদার্থ মাত্রই পরস্পর আকর্ষণ করে। জড়ের এই ধর্মের নাম মহাকর্ষ বা gravitation। এই আকর্ষণের রীতি নির্দেশ করিয়া নিউটন যে সূত্র রচনা করিয়াছেন তাহা Law of Gravitation, মহাকর্ষের নিয়ম। ইহাতে আকর্ষণের হেতুর উল্লেখ নাই। মানুষ মাত্রই মরে ইহা অবধারিত সত্য বা প্রাকৃতিক নিয়ম। মানুষের এই ধর্মের নাম মরত্ব। কিন্তু মৃত্যুর কারণ মরত্ব নয়

আর একজন প্রশ্ন করিয়াছিলেন কর্পূর উবিয়া যায় কেন। উত্তর অনেক আসিলসকলেই বলিলেন কর্পূর উদ্বায়ী পদার্থ তাই উবিয়া যায়। প্ৰশ্নকর্তা বোধ হয় তৃপ্ত হইয়াছেনকারণ তিনি আর জেরা করেন নাই। কিন্তু উত্তরটি কৌতুককর। 'উদ্বায়ী'র অর্থযাহা উবিয়া যায়। উত্তরটি দাঁড়াইল এই কর্পূর উবিয়া যায়কারণ তাহা এমন বস্তু যাহা উবিয়া যায়প্রশ্নকর্তা যে তিমিরে সেই তিমিরে রহিলেন। একবার এক গ্ৰাম্য যুবককে প্রশ্ন করিতে শুনিয়াছিলামকুইনিনে জ্বর সারে কেন। একজন মুরব্বী ব্যক্তি বুঝাইয়া দিলেনকুইনিন জ্বরকে জব্দ করেতাই জ্বর সারে

কর্পূর উবিয়া যায় কেনইহার উত্তরে বিজ্ঞানী বলিবেনজানি না। হয়তো কালক্ৰমে নির্ধারিত:হইবে যে পদার্থের আণব সংস্থান অমুক প্রকার হইলে তাহা উদ্বায়ী হয়। তখন বলা চলিবেকর্পূরের গঠনে অমুক বিশিষ্টতা আছে তাই উবিয়া যায়। কিন্তু ইহাতেই প্রশ্ন থামিবে নাঐপ্রকার গঠনের জন্যই বা পদার্থ উদ্বায়ী হয় কেনবিজ্ঞানী পুনর্বার বলিবেনজানি না

বিজ্ঞানের লক্ষ্য-জটিলকে অপেক্ষাকৃত সরল করাবহু বিসদৃশ ব্যাপারের মধ্যে যোগসূত্র বাহির করা। বিজ্ঞান নির্ধারণ করেঅমুক ঘটনার সহিত অমুক ঘটনার অখন্ডনীয় সম্বন্ধ আছেঅর্থাৎ ইহাতে এই হয়। কেন হয় তাহার চূড়ান্ত জবাব বিজ্ঞান দিতে পারে না। গাছ হইতে স্বলিত হইলে ফল মাটিতে পড়েকারণ বলা হয়পৃথিবীর আকর্ষণ। কেন আকর্ষণ করে বিজ্ঞান এখনও জানে না। জানিতে পারিলেও আবার নূতন সমস্যা উঠিবে। নিউটন আবিষ্কার করিয়াছেনজড়পদার্থ মাত্রই পরস্পর আকর্ষণ করে। জড়ের এই ধর্মের নাম মহাকর্ষ বা gravitation। এই আকর্ষণের রীতি নির্দেশ করিয়া নিউটন যে সূত্র রচনা করিয়াছেন তাহা Law of Gravitation, মহাকর্ষের নিয়ম। ইহাতে আকর্ষণের হেতুর উল্লেখ নাই। মানুষ মাত্রই মরে ইহা অবধারিত সত্য বা প্রাকৃতিক নিয়ম। মানুষের এই ধর্মের নাম মরত্ব। কিন্তু মৃত্যুর কারণ মরত্ব নয়

কারণ নির্দেশের জন্য সাধারণ লোকে অপবিজ্ঞানের আশ্রয় লইয়া থাকে। ফল পড়ে কেনকারণ পৃথিবীর আকর্ষণ। এই প্রশ্নোত্তরে এবং কর্পূরের প্রশ্নোত্তরে কোনও প্রভেদ নাইহেত্বাভাসকে হেতু বলিয়া গণ্য করা হইয়াছে। তবে একটা কথা বলা যাইতে পারে। উত্তরদাতা জানাইতে চান যে তিনি প্ৰশ্নকর্তা অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বেশী খবর রাখেন। তিনি বলিতে চানঅনেক জিনিসই উবিয়া যায়কর্পূর তাঁহাদের মধ্যে একটিজড়পদার্থ মাত্রই পরস্পরকে আকর্ষণ করেপৃথিবী কর্তৃক ফল আকর্ষণ তাঁহারই একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু কারণ নির্দেশ হইল না

বিজ্ঞানশাস্ত্ৰ বারংবার সতর্ক করিয়াছেমানুষ যে সকল প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করিয়াছে তাহা ঘটনার লক্ষিত রীতি মাত্রঘটনার কারণ নয়, laws are not causes । যাহাকে আমরা কারণ বলি তাহা ব্যাপারপরম্পরা বা ঘটনার সম্বন্ধ মাত্রতাহার শেষ নাই,ইয়াত্তা নাই। যাহা চরম ও নিরপেক্ষ কারণ তাহা বিজ্ঞানীর অনধিগম্য। দার্শনিক স্মরণাতীত কাল হইতে তাহার সন্ধান করিতেছেন

এই প্রসঙ্গে একটি অতিপরিচিত বিষয়ের উল্লেখ করা যাইতে পারে-অদৃষ্টবাদ বা নিয়তিবাদ। ইহা পাশ্চাত্ত্য বিজ্ঞানের দান নয়নিতান্তই ভারতীয় বস্তু। আধুনিক বিজ্ঞানের সহিত ইহার বিবাদ নাইকিন্তু সাধারণ লোকে যে অদৃষ্টবাদের আশ্রয় লয় তাহা অপবিজ্ঞান মাত্র

অদৃষ্টের অর্থ—অনিৰ্ণেয় ও অসাধ্য ঘটনাসমূহনিয়তির অর্থসমস্ত ঘটনার অখন্ডনীয় সম্বন্ধ বা আনুপূর্ব। ঘটনার কারণ অদৃষ্ট বা নিয়তি নয়। কিন্তু সাধারণ লোকে অদৃষ্টকে অনর্থক টানিয়া আনিয়া সুখদুঃখের ব্যাখ্যা করেজীবনযাত্রা যখন নিরুদ্‌বেগে চলিয়া যায় তখন কারণ জানিবার ঔৎসুক্য থাকে না। কিন্তু যদি একটা বিপদ ঘটেকিংবা যদি কোন পরিচিত হঠাৎ বড়লোক হয়তখনই মনে কষ্টকর প্রশ্ন আসেকেন এমন হইল বিজ্ঞলোক ব্যাখ্যা করেন বাপুকেন হইল সেটা বুঝিলে না ! উত্তরে যদি বলা হয়কলেরাসর্পাঘাতঅনেক বয়সতবে একটা কারণ বুঝা যায়। কিন্তু ইহা বলা বৃথামরণের অনিৰ্ণেয়তাবা অবাৰ্যতাই মরিবার কারণ। অথচ, 'অদৃষ্ট' বলিলে ইহাই বলা হয়

বহু যুগের অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের দূরদৃষ্টি জন্মিয়াছেঅতীত ও ভবিষ্যৎ অনেক ব্যাপারপরম্পরা সে নির্ণয় করিতে পারে। কিসে কি হয় মানুষ অনেকটা জানে এবং সেই জ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা প্রয়োজন সাধন করে। কতকগুলি জাগতিক ব্যাপার আমাদের বােধ্য বা সাধ্যকিন্তু অধিকাংশই অবােধ্য বা অসাধ্য। প্রথমোক্ত বিষয়গুলি আমাদের 'দৃষ্ট' অর্থাৎ নির্ণেয়শেষোক্ত বিষয়গুলি 'অদৃষ্ট' অৰ্থাৎ অনিৰ্ণেয়। যাহা দৃষ্ট তাহাতে আমাদের কিছু হাত আছেযাহা অদৃষ্ট তাঁহাতে মোটেই হাত নাই

নিয়তিবাদী দার্শনিক বলেনকিসে কি হইবে তাহা জগতের উৎপত্তির সঙ্গেই নিয়মিত হইয়া আছেসমস্ত ব্যাপারই নিয়তি। মানুষের সাধ্য অসাধ্য সমস্তই নিয়তিআমরা নিয়তি অনুসারেই পুরুষকার প্রয়ােগ করি। কাজ সহজে উদ্ধার হইয়া গেলে নিয়তির কথা মনে আসে না। কিন্তু চেষ্টা বিফল হইলেই মনে পড়েনিয়তি মানুষের অবাধ্যযত্ন করিলেও সব কাজ সিদ্ধ হয় না

বিজ্ঞানও স্বীকার করেএই জগৎ নিয়তির রাজ্যসমস্ত ঘটনা কার্যকারণসূত্রে গ্রথিত অখন্ডনীয়রূপে নিয়ন্ত্রিত। অভিজ্ঞ ব্যক্তি কোনও কোনও বিষয়ের ভবিষ্যদুক্তি করিতে পারেনযথাঅমুক দিন চন্দ্রগ্রহণ হইবেঅমুক লোকের শীঘ্র জেল হইবে। প্রাকৃতিক নিয়ম বা নিয়তির কিয়দংশ তাঁহার জানা আছে বলিয়াই পারেন। বিচক্ষণ দাবা খেলোয়াড় ভবিষ্যতের পাঁচ-ছয় চাল হিসাব করিয়া ঘুটি চালিয়া থাকে। কিন্তু যাহা মানুষের প্রতর্ক্য বা অনুমানগম্য তাহা সকল ক্ষেত্রে সাধ্য বা প্ৰতিকাৰ্য নয়। আমাদের এমন শক্তি নাই যে চন্দ্রের গ্রহণ রোধ করিকিন্তু এমন শক্তি থাকিতে পারে যাহাতে অমুকের কারাদন্ড নিবারণ করা যায়। এমন প্রাজ্ঞ যদি কেহ থাকেন যিনি সমস্ত প্ৰাকৃতিক নিয়ম জানেনতবে তিনি সর্বদ্ৰষ্টা ত্রিকালজ্ঞ। তাঁহার কাছে নিয়তি 'অদৃষ্ট' নয়দৃষ্ট ও স্পষ্ট। তিনি মানুষতাই সর্বশক্তিমান হইতে পারেন নাকিন্তু অন্য মানুষের তুলনায় তাঁহার সাধ্যের সীমা অতি বৃহৎ। জ্ঞানবৃদ্ধির ফলে মানবসমাজ এইরূপে উত্তরোত্তর অনাগতবিধাতা হইতেছে

কুট তার্কিক বলিবেনপ্রকৃতির অখন্ডনীয় বিধি মানিব কেনতোমার আমার বুদ্ধিতে ফল মাটিতে পড়েযথাকলে চন্দ্রগ্রহণ হয়দুই আর তিনে পাঁচ হয়। কিন্তু এমন ভুবন বা এমন অবস্থা থাকিতে পারে যেখানে বিধির ব্যতিক্রম হয়বিজ্ঞানী উত্তর দেনতোমার সংশয় যথার্থ। কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্র এই চিরপরিচিত ভুবন এবং তোমার আমার তুল্য প্রকৃতিস্থ মানুষের দৃষ্টি। যখন অন্য ভুবনে যাইব বা অন্য প্রকার দেখিব তখন অন্য বিজ্ঞান রচনা করিব। বিজ্ঞানী যে সূত্র প্রণয়ন করেন তাহা কখনও কখনও সংশোধন করিতে হয় সত্য, কিন্তু তাহা প্রাকৃতিক বিধির পরিবর্তনের ফলে নয়।

অতএবঅদৃষ্টের অর্থ—অনিৰ্ণেয় ও অসাধ্য ঘটনাসমূহনিয়তির অর্থসমস্ত ঘটনার অখন্ডনীয় সম্বন্ধ বা আনুপূর্বঘটনার কারণ অদৃষ্ট বা নিয়তি নয়। কিন্তু সাধারণ লোকে অদৃষ্টকে অনর্থক টানিয়া আনিয়া সুখদুঃখের ব্যাখ্যা করেজীবনযাত্রা যখন নিরুদ্‌বেগে চলিয়া যায় তখন কারণ জানিবার ঔৎসুক্য থাকে না। কিন্তু যদি একটা বিপদ ঘটেকিংবা যদি কোন পরিচিত হঠাৎ বড়লোক হয়তখনই মনে কষ্টকর প্রশ্ন আসেকেন এমন হইল বিজ্ঞলোক ব্যাখ্যা করেন বাপুকেন হইল সেটা বুঝিলে না ! উত্তরে যদি বলা হয়কলেরাসর্পাঘাতঅনেক বয়সতবে একটা কারণ বুঝা যায়। কিন্তু ইহা বলা বৃথামরণের অনিৰ্ণেয়তাবা অবাৰ্যতাই মরিবার কারণ। অথচ, 'অদৃষ্ট' বলিলে ইহাই বলা হয়যাহা অবিসংবাদিত সত্য বা truism তাহা শুনিলে কাহারও কৌতুহলনিবৃত্তি বা সান্ত্বনালাভ হয় নাসুতরাং ইহাও বলা বৃথাঅমুক লোকটি ঘটনাপরম্পরার ফলে মরিয়াছে। অথচ, 'নিয়তি' বলিলে ইহাই বলা হয়। 'অদৃষ্ট' ও 'নিয়তি' শব্দ সাধারণের নিকট প্রকৃত অর্থ হারাইয়াছে এবং বিধাতার আসন পাইয়া সুখদুঃখের নিগুঢ় কারণ রূপে গণ্য হইতেছে

অধ্যাপক Poyinting-এর উক্তিটি উদ্ধারযোগ্য
'No long time ago physical laws were quite commonly described as the Fixed Laws of Nature, and were supposed sufficient in themselves to govern the universe....A law of nature explains nothingit has no governing power, it is but a descriptive formula which the careless has sometimes personified.

সূত্র : প্রবন্ধাবলী রাজশেখর বসু (সম্পাদনা- দীপংকর বসু)
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেই, ওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন