:::: সূচীপত্র ::::
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক
(১৮৬০-১৯৩৩)
 
গদ্য ও পদ্য রচনায় অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী মোজাম্মেল হক প্রধানত মুসলমান সমাজের জাগরণমূলক কাব্য রচনা করলেও তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটে মূলত গদ্যে। তিনি জীবনচরিত ও উপন্যাস রচনায় এবং ফারসি থেকে অনুবাদে কৃতিত্ব অর্জন করেন। বাঙালি-মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম পাঠ্যপুস্তক রচনাও তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। মূল ফারসি থেকে শাহনামা কাব্যের প্রথমাংশের অনুবাদ তাঁর অমর কীর্তি। (১৯০৯)
মোজাম্মেল হক তাঁর সমগ্র সাহিত্য-কর্মকাণ্ডে স্বজাতির প্রতি যে দরদের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর ধর্মীয় চেতনালব্ধ সুফী ভাবনার প্রভাব। (চিরায়ত সাহিত্য ভাবনা- আজহার ইসলাম -৫১ পৃ:)
মোজাম্মেল হক সুফীভাবে প্রণোদিত ছিলেন।

মোজাম্মেল হকের গদ্যে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব অনুভূত হয়। সেজন্য তাঁর ভাষায় তৎসম শব্দের বহুল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। তাতে অবশ্য তাঁর রচনার ওজঃগুণ বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থী হিসেবে এক সময় মোজাম্মেল হক শান্তিপুরের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বনমালী বিদ্যাভূষণের কাছে ব্যাকরণ পাঠ করিছিলেন। (‘মোজাম্মেল হক’- আজহার ইসলাম ৭৬ পৃ:)
 
তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাব্য হল :
কুসুমাঞ্জলি (১৮৮১)
অপূর্ব দর্শন কথা (১৮৮৫)
প্রেমাহার (১৮৯৮)
হজরত মুহাম্মদ (১৯০৩)
জাতীয় ফোয়ারা (১৯১২)
ইসলাম সঙ্গীত (১৯২৩)
তাপস কাহিনী (১৯১৪)
তাঁর কিছু জনপ্রিয় গদ্য রচনা হল :
মহর্ষি মনসুর (১৮৯৬)
ফেরদৌসি চরিত (১৮৯৮)
শাহনামা (১৯০৯)
টিপু সুলতান (১৯৩১)
খাজা মইনউদ্দিন চিশতি (১৯১৮)
হাতেমতাই (১৯১৯)
শান্তিপুরের রাসলীলা
উপন্যাস : জোহরা (১৯১৭), দরাফ খান গাজী (১৯১৯) ইত্যাদি।
মোজাম্মেল হকের ‘ফেরসৌসী-চরিত’ গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৫ই আশ্বিন,১৩০৫ বঙ্গাব্দ, যা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো; এর দ্বাদশ মুদ্রণ হয় বৈশাখ ১৩৫৫ সালে। জনপ্রিয়তার নমুনা দেয়া যেতে পারে তৎকালিন অনেক পত্রপত্রিকার প্রশংসাব্যঞ্জক সমালোচনার অনেকগুলো থেকে একটি :
“শেষে পাঠকবর্গকে একটি বিশেষ অনুরোধ করিতেছি এই যে, তাঁহারা এক একখানি ‘ফেরসৌসী-চরিত’ আনাইয়া পাঠ করুন। এখানিও ‘মহর্ষি মনসুরে’র ন্যায় উপাদেয়,- পাঠ করিয়া বিশেষ তৃপ্তি লাভ হইবে, একথা সুস্পষ্টই বলিত পারি।” (এডুকেশন গেজেট, কলিকাতা-১৩০৭)
 
তাঁর বাংলা ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্যবোধের কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়এর তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার বাংলা ভাষার পরীক্ষক নিযুক্ত করেন (১৯১৯)। মোজাম্মেল হক লহরী (১৮৯৯), মোসলেম ভারত (১৯২০) ও শান্তিপুর মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। চলি­শ বছর যাবৎ তিনি শান্তিপুর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার ও কিছুকাল ভাইস-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ত্রিশ বছর নদীয়া জেলা বোর্ডের শিক্ষা কমিটির সদস্য, বিশ বছর অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট ও কিছুকাল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির (১৯১১) সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি, পশ্চাৎপদতা ও আত্মবিস্মৃতির বিরুদ্ধে তিনি লেখনী ধারণ ও সংগঠনের মাধ্যমে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
মোজাম্মেল হক শান্তিপুর নামে মাসিকপত্র, মোসলেম ভারত (১৯২০), লহরি (১৮৯৯) পত্রিকা সম্পাদনা এবং মুদগাল, শান্তিপুর দীপিকা, বিশ্বদূত, যুবক, নওরোজ ইত্যাদি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। মুসলিম সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামি, পশ্চাৎপসারণতা ও ঔদাসিন্য এসবের বিরুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাকে ‘কাব্য কন্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে। 'মোসলেম ভারত' একটি অসাম্প্রদায়িক পত্রিকা ছিল।
তাঁর সম্পাদিত 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার প্রথমবর্ষের প্রথমখণ্ডের প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বার্তা ছাপা হয়,তাতে দেখা যায় বিশ্বকবির এই বানী-
“মানব-সংসারে জ্ঞানালোকের দিয়ালি-উৎসব চলিতেছে। প্রত্যেক জাতি আপনার আলোটিকে বড় করিয়া জ্বালাইলে তবে - সকলে মিলিয়া এই উৎসব সমাধা হইবে”।
 
এছাড়া অনেক প্রখ্যাত লেখকও ‘মোসলেম ভারত’-তে লিখেছেন।