:::: সূচীপত্র ::::

দশরথের প্রতি কেকয়ী

[কোন সময়ে রাজর্ষি দশরথ কেকয়ী দেবীর নিকট এই প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, তিনি তাঁহার গর্ভজাত-পুত্র ভরতকেই যুবরাজপদে অভিষিক্ত করিবেন কালক্রমে রাজা স্বসত্য বিস্মৃত হইয়া কৌশল্যা-নন্দন রামচন্দ্রকে সে পদ-প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করাতে, কেকয়ী দেবী মন্থরা নাম্নী দাসীর মুখে এ সংবাদ পাইয়া নিম্নলিখিত পঞ্জিকাখানি রাজসমীপে প্রেরণ করিয়াছিলেন ।]

এ কি কথা শুনি মাজ মন্থরার মুখে,
রঘুরাজ ? কিন্তু দাসী নীচকুলোদ্ভব,
সত্য মিথ্যা জ্ঞান তার কভু না সম্ভবে!
কহ তুমি ;কেন আজি পুরবাসী যত
আনন্দ-সলিলে মগ্ন ? ছড়াইছে কেহ
ফুলরাশি রাজপথে , কেহ বা গাঁথিছে
মুকুল কুসুম ফল পল্লবের মালা
সাজাইতে গৃহদ্বারমহোৎসবে যেন ?
কেন বা উড়িছে ধ্বজ প্রতি গৃহচূড়ে ?
কেন পদাতিক, হয়, গজ, রথ, রথী
বাহিরিছে রণবেশে ? কেন বা বাজিছে
রণবাদ্য ? কেন আজি পুরনারী-ব্ৰজ
মুহুর্মুহু হুলাহুলি দিতেছে চৌদিকে ?
কেন বা নাচিছে নট, গাইছে গায়কী ?
কেন এত বীণা-ধ্বনি ? কহ, দেব, শুনি,
কৃপা করি কহ মোরে,—কোন্‌ ব্রতে ব্ৰতী
আজি রঘুকুল-শ্রেষ্ঠ ? কহ, হে নুমণি,
কাহার কুশল-হেতু কৌশল্য মহিষী
বিতরেন ধন-জাল ? কেন দেবালয়ে
বাজিছে ঝাঁঝরি, শঙ্খ, ঘণ্টা ঘটারোলে ?
কেন রঘু-পুরোহিত রত স্বস্ত্যয়নে ?
নিরস্তর জন-স্রোতঃ কেন বা বহিছে
এ নগর-অভিমুখে ? রঘু-কুল-বধূ
বিবিধ ভূষণে আজি কি হেতু সাজিছে
কোন্‌ রঙ্গে ? অকালে কি আরম্ভিলা, প্রভূ,
যজ্ঞ ? কি মঙ্গলোৎসব আজি তব পুরে ?
কোন্‌ রিপু হত রণে, রঘু-কুল-রথি ?
জন্মিল কি পুত্র আর ? কাহার বিবাহ
দিবে আজি ? আইবড় আছে কি হে গৃহে
দুহিত ? কৌতুক বড় বাড়িতেছে মনে !
কহু, শুনি, হে রাজন্‌ ; এ বয়েসে পুনঃ
পাইলা কি ভাগ্য-বলেভাগ্যবান্‌ তুমি
চিরকাল !পাইলা কি পুনঃ এ বয়েসে
রসময়ী নারী-ধনে, কহ, রাজ-ঋষি ?

হা ধিক্ ! কি কবে দাসীগুরুজন তুমি !
নতুবা কেকয়ী, দেব, মুক্তকণ্ঠে আজি
কহিত,—‘অসত্য-বাদী রঘু-কুল-পতি !
নির্লজ্জ ! প্রতিজ্ঞা তিনি ভাঙ্গেন সহজে !
ধৰ্ম্ম-শব্দ মুখে,—গতি অধৰ্শ্বের পথে !
অযথার্থ কথা যদি বাহিরায় মুখে
কেকয়ীর, মাথা তার কাট তুমি আসি,
নররাজ ; কিম্বা দিয়া চূণ কালি গালে
খেদাও গহন বনে ! যথার্থ যদ্যপি
অপবাদ, তবে কহ, কেমনে ভূঞ্জিবে
এ কলঙ্ক ? লোক-মাঝে কেমনে দেখাবে
ও মুখ, রাঘবপতি, দেখ ভাবি মনে
না পড়ি ঢলিয়া আর নিতম্বের ভরে !
নহে গুরু উরু-দ্বয়, বর্ত্তুল কদলী-
সদৃশ ! সে কটি, হার, কর-পদ্মে ধরি
যাহায়, নিন্দিতে তুমি সিংহে প্ৰেমাদরে,
আর নহে সরু, দেব ! নম্র-শিরঃ এবে
উচ্চ কুচ! সুধা-হীন অধর ! লইল
লুটিয়া কুটিল কাল, যৌবন-ভাণ্ডারে
আছিল রতন যত ; হরিল কাননে
নিদাঘ কুসুম কাস্তি, নীরসি কুসুমে !
কিন্তু পূর্বকথা এবে স্মর, নরমণি !
সেবিনু চরণ যবে তরুণ যৌবনে,
কি সত্য করিলা, প্রভু, ধৰ্ম্মে সাক্ষী করি,
মোর কাছে ? কাম-মদে মাতি যদি তুমি
বৃথা আশা দিয়া মোরে ছলিলা, তা কহ;
নীরবে এ দুঃখ আমি সহিব তা হলে !
কামীর কুরীতি এই শুনেছি জগতে,
অবলার মনঃ চুরি করে সে সতত
কৌশলে, নিৰ্ভয়ে ধর্ম্মে দিলা জলাঞ্জলি ;
প্রবঞ্চনা-রূপ ভষ্ম মাখে মধুরসে
এ কুপথে পথী কি হে সূর্য্য-বংশ-পতি ?
তুমিও কলঙ্ক-রেখা লেখ সুললাটে,
(শশাঙ্ক-সদৃশ) এবে, দেব দিনমণি !
ধৰ্ম্মশীল বলি, দেব, বাখানে তোমারে
দেব নর,—জিতেন্দ্রিয় নিত্য সত্যপ্রিয় !
তবে কেন, কহ মোরে, তবে কেন শুনি,
যুবরাজ-পদে আজি অভিষেক কর
কৌশল্য-নন্দন রামে ? কোথা পুত্র তব
ভরত,— ভারত-রত্ন, রঘু-চুড়ামণি ?
পড়ে কি হে মনে এবে পুৰ্ব্বকথা যত ?
কি দোষে কেকয়ী দাসী দোষী তব পদে ?
কোন্‌ অপরাধে পুত্র, কহ, অপরাধী ?
তিন রাণী ভব, রাজা ! এ তিনের মাঝে,
কি ক্রটি সেবিতে পদ করিল কেকয়ী
কোন্‌ কালে ? পুত্ৰ তব চারি, নরমণি !
গুণশীলোত্তম রাম, কহ, কোন গুণে ?
কি কুহকে, কহ শুনি, কৌশল্যা মহিষী
ভুলাইয়া মনঃ তব ? কি বিশিষ্ট গুণ
দেখি রামচন্দ্রে, দেব, ধৰ্ম্ম নষ্ট কর
অভীষ্ট পূর্ণিতে তার, রঘুশ্রেষ্ঠ তুমি ?
কিন্তু বাক্য-ব্যয় আর কেন অকারণে ?—
যাহা ইচ্ছা কর, দেব ; কার সাধ্য রোধে
তোমায়, নরেন্দ্ৰ তুমি ? কে পারে ফিরাতে
প্রবাহে ? বিতংসে কেবা বাঁধে কেশরীরে ?
চলিল ত্যজিয়া আজি তব পাপ-পুরী
ভিখারিণী-বেশে দাসী ! দেশ দেশান্তরে
ফিরিব ; যেখানে যাব, কহিব সেখানে
পরম অধৰ্ম্মচারী রঘু-কুল-পতি
গম্ভীরে অম্বরে যথা নাদে কাদম্বিনী,
এ মোর দুঃখের কথা, কব সৰ্ব্বজনে
পথিকে, গৃহস্থে, রাজে, কাঙালে, তাপসে,—
যেখানে যাহারে পাব, কব তার কাছে
পরম অধৰ্ম্মচারী রঘু-কুল-পতি ?
পুষি সারী শুক, দোঁহে শিখাব যতনে
এ মোর দুঃখের কথা, দিবস রজনী ।
শিথিলে এ কথা, তবে দিব দোঁহে ছাড়ি
অরণ্যে গাইবে তারা বসি বৃক্ষ-শাখে,
পরম অধৰ্ম্মাচারী রঘু-কুল-পতি !
শিখি পক্ষীমুখে গীত গাবে প্রতিধ্বনি
পরম অধৰ্ম্মাচারী রঘু-কুল-পতি ?
লিখিব গাছের ছালে, নিবিড় কাননে,
পরম অধৰ্ম্মাচারী রঘু-কুল-পতি !
খোদিব এ কথা আমি তুঙ্গ শৃঙ্গদেহে
রচি গাথা, শিখাইব পল্লী-বাল-দলে
করতালি দিয়া তারা গাইবে নাচিয়া
পরম অধৰ্ম্মাচারী রঘু-কুল-পতি।
থাকে যদি ধৰ্ম্ম, তুমি অবশ্য ভূঞ্জিবে
এ কৰ্ম্মের প্রতিফল ! দিয়া আশা মোরে,
নিরাশ করিলে আজি ; দেখিব নয়নে
তব আশা-বৃক্ষে ফলে কি ফল, নৃমণি?
ৰাড়ালে যাহার মান, থাক তার সাথে
গৃহে তুমি ! বামদেশে কৌশল্যা মহিষী,—
( এত যে বয়েস, তবু লজ্জাহীন তুমি !)
যুবরাজ পুত্র রাম ; জনক-নন্দিনী
সীতা প্রিয়তমা বধূ এ সবারে লয়ে
কর ঘর, নরবর, যাই চলি আমি !
পিতৃ-মাতৃ-হীন পুত্রে পালিবেন পিতা
মাতামহালয়ে পাবে আশ্রয় বাছনি
দিব্য দিয়া মানা তারে করিব খাইতে
তব অল্প ; প্রবেশিতে তব পাপ-পুরে
চিরি বক্ষঃ মনোদুঃখে লিপিচু শোণিতে
লেখন না থাকে যদি পাপ এ শরীরে ;
পতি-পদ-গতা যদি পতিব্ৰতা দাসী ;
বিচার করুন ধৰ্ম্ম ধৰ্ম্ম-রীতি-মতে
ইতি শ্ৰীবীরাঙ্গনাকাব্যে কেকয়ীপত্রিকা নাম
চতুর্থ সর্গ
--------xXx--------
১. ব্রজপুরীর নারীগণ।
২. শুদ্ধ প্রয়োগ গায়িকা।
৩. ভোগ করবে।
৪. পাখি ধরবার ফাঁদ।
৫. উঁচু
৬. শপথ করে।

সূত্র : মধুসূদন রচনাবলী-সব্যসাচী রায় (সম্পাদনায়)