দ্বারকানাথের প্রতি রুক্মিণী
[বিদর্ভাধিপতি ভীষ্মকরাজপুত্রী রুক্মিণী দেবীকে পৌরাণিক ইতিবৃত্তে স্বয়ং লক্ষ্মীঅবতার
বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন । সুতরাং তিনি আজন্ম বিষ্ণুপরায়ণা ছিলেন । যৌবনাবস্থায় তাঁহার
ভ্রাতা যুবরাজ রুক্স চেদীশ্বর শিশুপালের সহিত তাঁহার পরিণয়ার্থে উদ্যোগী হইলে, রুক্মিণী দেবী নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি দ্বারকায় বিষ্ণু-অবতার দ্বারকানাথের সমীপে
প্রেরণ করেন । রুক্মিণী-হরণ-বৃত্তান্ত এ স্থলে ব্যক্ত করা বাহুল্য ।]
শুনি নিত্য ঋষিমুখে, হৃষীকেশ তুমি,
যাদবেন্দ্র, অবতীর্ণ অবনী-মণ্ডলে
খণ্ডিতে ধরার ভার দণ্ডি পাপী-জনে,
চাহে পদাশ্রয়, নমি ও রাজীব-পদে,
রুক্মিণী, —ভীষ্মক-পুত্ৰী, চিরদাসী তব –;
তার, হে তারক, তারে এ বিপত্তি-কালে !
কেমনে মনের কথা কহিব চরণে,
অবলা কুলের বালা আমি, যদুমণি ?
কি সাহসে বাঁধি বুক, দিব জলাঞ্জলি
লজ্জাভয়ে ? মুদে আঁখি, হে দেব, শরমে ;
না পারে আঙুল-কুল ধরিতে লেখনী ;
কাঁপে হিয়া থরথরে ! না জানি কি করি ;
না জানি কাহারে কহি এ দুঃখ-কাহিনী !
শুন তুমি, দয়াসিন্ধু ! হায়, তোমা বিনা
নাহি গতি অভাগীর আর এ সংসারে !
নিশার স্বপনে হেরি পুরুষ-রতনে,
কায় মনঃ অভাগিনী সঁপিয়াছে তাঁরে ;
দেবে সাক্ষী করি বরি দেবনরোত্তমে
বরভাবে ! নারী দাসী,
নারে উচ্চারিতে
নাম তাঁর, স্বামী তিনি ; কিন্তু কহি, শুন,
পঞ্চ মুখে পঞ্চমুখ১ জপেন সতত
সে নাম,—জগত-কর্ণে সুধার লহরী !
কে যে তিনি ? জন্ম তাঁর কোন্ মহাকুলে ?
অবধান কর, প্রভু, কহিব সংক্ষেপে ;
তুলিয়া কুসুম-রাশি, মালিনী যেমতি
গাঁথে মালা, ঋষিমুখ-বাক্যচয় আজি
গাঁথিব গাথায়, নাথ, দেহ পদ-ছায়া ।
গৃ-হিলা পুরুষোত্তম জন্ম কারাগারে২—
রাজদ্বেষে পিতা মাতা ছিল বন্দীভাবে,
দীনবন্ধু, তেঁই জন্ম নাথের কুস্থলে !
খনিগর্ভে ফলে মণি ; মুক্ত শুক্তিধামে
!
হাসিলা উল্লালে পৃথ্বী সে শুভ নিশীথে ;
শত শরদের শশী-সদৃশী শোভিল
বিভা ! গন্ধামোদে মাতি স্বনিলা সুস্বনে
সমীরন; নদ নদী কলকলকলে
সিন্ধুপদে সুসংবাদ দিলা দ্রুতগতি ;
কল্লোলিলা জলপতি গম্ভীর নিনাদে !
নাচিলা অপ্সরা স্বর্গে
, মর্ত্ত্যে নর নারী !
সঙ্গীত-তরঙ্গ রঙ্গে বহিল চৌদিকে !
বৃষ্টিলা কুসুম দেব ; পাইল দরিদ্র
রতন ; জীবন পুনঃ জীবশূণ্য জন!
পূরিল অখিল বিশ্ব জয় জয় রবে।
জন্মাতে জনমদাতা, ঘোর নিশাযোগে
গোপরাজ-গৃহে লয়ে রাখিলা নন্দনে
মহা যত্নে ।৩ মহারত্মে পাইলে যেমতি
আনন্দ-সলিলে ভাসে দরিদ্র,ভাসিলা
গোকুলে গোপ-দম্পতি৪ আনন্দ-সলিলে !
আদরে পালিলা বালে গোপ-কুল-রাণী
পুত্রভাবে । বাল্য-কালে বাল্য-খেলা যত
খেলিলা রাখাল-রাজ, কে পারে বর্ণিতে ?
কে কবে, কি ছলে শিশু নাশিলা মায়াবী
পুতনারে ? কাল নাগ কালীয়, কি দেখি,
লইল আশ্রয় নমি পাদ-পদ্ম-তলে ?
কে কবে, বাসব যবে রুষি, বরষিলা
জলাসার,৫ কি কৌশলে গোবর্দ্ধনে
তুলি,
রক্ষিলা গোকুল, দেব, প্রলয়-প্লাবনে ?
আর আর কীৰ্ত্তি যত বিদিত জগতে ?৬
যৌবনে করিলা কেলি গোপী-দলে
লয়ে
রসরাজ ; মজাইলা গোপ-বধু-ব্ৰজ
বাজায়ে বাঁশরী, নাচি তমালের তলে ।
বিহারিলা গোষ্ঠে প্রভু ; যমুনা-পুলিনে !৭
এইরূপে কত কাল কাটাইলা সুখে
গোপ-ধামে গুণনিধি ; পরে বিনাশিয়া
পিতৃ-অরি৮ অরিন্দম৯, দূর সিন্ধু-তীরে
স্থাপিলা সুন্দরী পুরী।১০ আর কব কত ?
দেখ চিন্তি, চিন্তামণি, চেন যদি তারে ।
না পার চিনিতে যদি, দেহ আজ্ঞা তবে,
পীতাম্বর, দেখি যদি পারে হে বর্ণিতে
সে রূপ-মাধুরী দাসী । চিত্রপটে যেন,
চিত্রিত সে মূৰ্ত্তি চির, হায়, এ হৃদয়ে !
নবীন-নীরদ-বর্ণ; শিখি-পুচ্ছ শিরে;
ত্রিভঙ্গ ; সুগল-দেশে বরগুঞ্জমালা ;
মধুর অধরে বাঁশী ; বাস পীত ধড়া ;১১
ধ্বজবজ্রাঙ্কুশ-চিহ্ন১২ রাজীব-চরণে—
যোগীন্দ্র-মানস-পদ্ম ! মোক্ষ-ধাম ভবে !
যত বার হেরি, দেব, আকাশ-মণ্ডলে,
ঘনবরে, শক্র-ধনুঃ চূড়ারূপে শিরে ;
তড়িৎ সুধড়া অঙ্গে ; —পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া,
সাষ্টাঙ্গে প্রণমি, আমি, পূজি ভক্তি-ভাবে !
ভ্রান্তিমদে মাতি কহি—‘প্রাণকান্ত মম
আসিছেন শূন্যপথে তুষিতে দাসীরে !’
উড়ে যদি চাতকিনী, গঞ্জি তারে রাগে !
নাচিলে ময়ূরী, তারে মারি, যদুমণি !
মন্দ্রে যদি ঘনবর, ভাবি, আঁখি মুদি,
গোপ-কুল-বালা আমি ; বেণুর সুরবে
ডাকিছেন সখা মোরে যমুনা-পুলিনে !
কহি শিখীবরে,—‘ধন্য তুই পক্ষিকুলে,
শিখণ্ডি১৩ ! শিখণ্ড১৪ তোর মণ্ডে শিরঃ যাঁর,
পূজেন চরণ তাঁর আপনি ধূর্জটি !’ —
আর পরিচয় কত দিব পদযুগে ?
শুন এবে দুঃখ-কথা । হৃদয়-মন্দিরে
স্থাপি সে সুশ্যাম মূৰ্ত্তি, সন্ন্যাসিনী যথা
পূজে নিত্য ইষ্টদেবে গহন বিপিনে,
পূজিতাম আমি নাথে । এবে ভাগ্য-দোষে
চেদীশ্বর নরপাল শিশুপাল নামে,
(শুনি জনরব) নাকি আসিছেন হেথা
বরবেশে বরিবারে, হায়, অভাগীরে !
কি লজ্জা । ভাবিয়া দেপ, হে দ্বারকাপতি !
কেমনে অধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম করিবে রুক্মিণী ?
স্বেচ্ছায় দিয়াছে দাসী, হায়, এক জনে
কায় মনঃ ; অন্য জনে—ক্ষম, গুণনিধি ! —
উড়ে প্রাণ, পোড়া কথা পড়ে যবে মনে !
কি পাপে লিখিলা বিধি এ যাতনা ভালে ?
আইস গরুড়-ধ্বজে, পাঞ্চজন্য নাদি,
গদাধর ! রূপ গুণ থাকিত যদ্যপি
এ দাসীর,—কহিতাম, ‘আইস, মুরারি,
আইস ; বাহন তব বৈনতেয় যথা
হরিল অমৃতরস পশি চঞ্জলোকে,
হর অভাগীরে তুমি প্রবেশি এ দেশে !’
কিন্তু নাহি রূপ গুণ , কোন্ মুখ দিয়া
অমৃতের সহ দিব আপন তুলনা !
দীন আমি ; দীনবন্ধু তুমি, যদুপতি ।
দেহ লয়ে রূক্সিণীরে সে পুরুষোত্তমে,
যাঁর দাসী করি বিধি সৃজিলা তাহারে !
রুক্স নামে সহোদর, —দুরন্ত সে অতি ;
বড় প্রিয়পাত্র তার চেদীশ্বর বলী ;
শরমে মায়ের পদে নারি নিবেদিতে
এ পোড়া মনের কথা ! চন্দ্রকলা সখী,
তার গলা ধরি, দেব, কাঁদি দিবানিশি ;—
নীরবে দুজনে কাঁদি সভয়ে বিরলে !
লইনু শরণ আজি ও রাজীব-পদে;—
বিঘ্ন-বিনাশন তুমি, ত্রাণ বিঘ্নে মোরে !
কি ছলে ভুলাই মনঃ ; কেমনে যে ধরি
ধৈরয, শুনিবে যদি, কহিব, শ্ৰীপতি !
বহে প্রবাহিণী এক রাজ-বন-মাঝে ;
‘যমুনা’ বলিয়া তারে সম্বোধি আদরে,
গুণনিধি ! কুলে তাঁর কত যে রোপেছি
তমাল, কদম্ব,—তুমি হাসিবে শুনিলে !
পুষিয়াছি সারী শুক, ময়ূর ময়ূরী
কুঞ্জবনে; অলিকুল গুঞ্জরে সতত
;
কুহরে কোকিল ডালে ; ফোটে ফুলরাজী ।
কিন্তু শোভাহীন বন প্রভূর বিহনে !
কত কুঞ্জবিহারীরে, হে দ্বারকাপতি,
আসিতে সে কুঞ্জবনে বেণু বাজাইয়া !
কিম্বা মোরে লয়ে, দেব, দেহ তাঁর পদে ।
আছে বহু গাভী
গোষ্ঠে; নিজ কর দিয়া
সেবে দাসী তা সবারে । কহ হে রাখালে
আসিতে সে গোষ্ঠগৃহে, কত, যদুমণি !
যতনে চিকণি নিত্য গাঁথি ফুলমালা ;
যতনে কুড়ায়ে রাখি যদি পাই পড়ি
শিখীপুচ্ছ ভূমিতলে ; —কত যে কি করি,
হায়, পাগলিনী আমি ! কি কাজ কহিয়া ?
আসি উদ্ধারহ মোরে, ধনুৰ্দ্ধর তুমি,
মুরারি ? নাশিলা কংসে, শুনিয়াছে দাসী,
কংসজিত , মধু নামে দৈত্য-কুল-রথী,
বধিলা, মধুসূদন, হেলায় তাহারে !
কে বর্ণিবে গুণ তব, গুণনিধি তুমি ?
কালরূপে শিশুপাল আসিছে সত্বরে ;
আইস তাহার অগ্রে । প্রবেশি এ দেশে,
হর মোরে । হরে লয়ে দেহ তাঁর পদে,
হরিলা এ মনঃ যিনি নিশার স্বপনে ।
ইতি শ্ৰীবীরাঙ্গনাকাব্যে রুক্মিণীপত্রিকা নাম
তৃতীয় সৰ্গ ।
--------xXx--------
১.
পাঁচ মুখ যার—মহাদেব।
২.
কৃষ্ণের জন্ম প্রসঙ্গ।
৩.
ভাগবতোক্ত কাহিনী—নবজাত কৃষ্ণ বসুদেব ব্রজধামে গোপরাজ নন্দগোপের গৃহে রেখে
এসেছিলেন।
৪.
(বইতেই নেই)।
৫.
বৃষ্টি ধারা।
৬.
ব্রজধামে কৃষ্ণের বাল্যলীলার পৌরাণিক প্রসঙ্গ। কবি এখানে পূতনাবধ দমন, ইন্দ্রপূজা
বন্ধ ও গোবর্ধনপর্বত ধারণ প্রভৃতি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।
৭.
গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রণয়লীলার প্রসঙ্গ।
৮.
কংস।
৯.
শক্রকে যিনি দমন করেন।
১০.
দ্বারকা নগরী স্থাপনের প্রসঙ্গ।
১১.
ধুতি।
১২.
পৌরাণিক বিশ্বাস মতে বিষ্ণুর এবং তাঁর অবতারদের পদতলে ধ্বজ, বজ্র ও
অঙ্কুশচিহ্ন থাকে।
১৩.
ময়ূর।
১৪.
ময়ূরপুচ্ছ।