সোমের প্রতি তারা
[যৎকালে সোমদেব—অর্থাৎ চন্দ্ৰ—বিদ্যাধ্যয়ন করণাভিলাষে দেবগুরু বৃহস্পতির আশ্রমে বাস করেন, গুরুপত্নী তারাদেবী তাঁহার অসামান্য সৌন্দৰ্য্য সম্প্রদর্শনে বিমোহিত হইয়া তাঁহার প্রতি প্রেমাসক্ত৷ হন । সোমদেব, পাঠ সমাপনাস্তে গুরুদক্ষিণা দিয়া বিদায় হইবার বাসনা প্রকাশ করিলে, তারাদেবী আপন মনের ভাব আর প্রচ্ছন্নভাবে রাখিতে পারিলেন না ; ও সতীত্বধৰ্ম্মে জলাঞ্চলি দিয়া সোমদেবকে এই নিম্নলিখিত পত্ৰখালি লিখেন । সোমদেব যে এতাদৃশী পত্রিকাপাঠে কি করিয়াছিলেন, এ স্থলে তাহার পরিচয় দিবার কোন প্রয়োজন নাই । পুরাণজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই তাহা অবগত আছেন ।]
কি বলিয়া সম্বোধিবে, হে সুধাংশুনিধি,
তোমারে অভাগী তারা ? গুরুপত্নী আমি
তোমার, পুরুষরত্ব ; কিন্তু ভাগ্যদোষে,
ইচ্ছা করে দাসী হয়ে সেবি পা দুখানি !—
কি লজ্জা ! কেমনে তুই, রে পোডা লেখনি,
লিখিলি এ পাপ কথা,—হায় রে, কেমনে ?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোরে । হস্তদাসী সদা
তুই ; মনোদাস হস্ত ; সে মনঃ পুড়িলে
কেন না পুড়িবি তুই ? বজ্রাগ্নি যদ্যপি
দহে তরুশিরঃ, মরে পদাশ্রিত লতা !
হে স্মৃতি, কুকৰ্ম্মে রত দুৰ্ম্মতি যেমতি
নিবায় প্রদীপ, আজি চাহে নিবাইতে
তোমায় পাপিনী তারা ! দেহ ভিক্ষা, ভুলি
কে সে মনঃ-চোর মোর, হায়, কেবা আমি !—
কুলমানে তব জন্যে,—ধৰ্ম্ম, লজ্জা, ভয়ে !
কুলের পিঞ্জর ভাঙ্গি, কুল-বিহঙ্গিনী
উড়িল পবন-পথে, পর আসি তারে,
তারানাথ !১—তারানাথ ? কে তোমারে দিল
এ নাম, হে গুণনিধি, কহ তা তারারে ।
এ পোড়া মনের কথা জানিল কি ছলে
নামদাতা ? ভেবেছিনু, নিশাকালে যথা
মুদিত-কমল-দলে থাকে গুপ্তভাবে
সৌরভ, এ প্রেম, বঁধু আছিল হৃদয়ে
অন্তরিত ; কিন্তু—ধিক্, বৃথা চিন্তা, তোরে !
কে পারে লুকাতে কবে জ্বলন্ত পাবকে ?
এস তবে, প্রাণসখে । তারানাথ তুমি ;
জুড়াও তারার জ্বালা ! নিজ রাজ্য ত্যজি,
ভ্ৰমে কি বিদেশে রাজা, রাজকাজ ভুলি ?
সদর্পে কন্দর্প নামে মীনধ্বজ রথী২,
পঞ্চ খর শর তৃণে পুষ্পধনুঃ হাতে,
আক্ৰমিছে পরাক্রমি অসহায় পুরী ;—
কে তারে রক্ষিবে, সখে, তুমি না রক্ষিলে ?
যে দিন,—কুদিন তারা বলিবে কেমনে
সে দিনে, হে গুণমণি, যে দিন হেরিল
আঁখি তার চন্দ্রমুখ,—অতুল জগতে !—
যে দিন প্রথমে তুমি এ শান্ত আশ্রমে
প্রবেশিলা, নিশিকান্ত, সহসা ফুটিল
নবকুমুদিনীসম এ পরাণ মম
উল্লাসে, —ভাসিল যেন আনন্দ-সলিলে !
এ পোড়া বদন মুহুঃ হেরিনু দর্পণে ;
বিনাইনু যত্মে বেণী ; তুলি ফুল রাজী,
(বন-রত্ম) রত্মরূপে পরিনু কুন্তলে ।
চির পরিধান মম বাকল , ঘৃণিনু
তাহায় । চাহিনু, কাঁদি বন-দেবী-পদে,
দুকুল৩, কাঁচলি৪, সিঁতি, কঙ্কণ, কিঙ্কিণী৫,
কুণ্ডল, মুকুতাহার, কাঞ্চী৬ কটিদেশে !
ফেলিনু চন্দন দূরে, স্মরি মৃগমদে৭ !
হায় রে, অবোধ আমি ! নারিনু বুঝিতে
সহসা এ সাধ কেন জনমিল মনে ?
কিন্তু বুঝি এবে, বিধু! পাইলে মধুরে,
সোহাগে বিবিধ সাজে সাজে বনরাজী !—
তারার যৌবন-বন ঋতুরাজ তুমি !
বিদ্যালাভ-হেতু যবে বসিতে, সুমতি,
গুরুপথে ; গৃহকৰ্ম্ম ভুলি পাপীয়সী
আমি, অন্তরালে বসি শুনিতাম সুখে
ও মধুর স্বর, সখে, চির-মধু-মাখা !
কি ছার, নিগম, তন্ত্র, পুরাণের কথা ?
কি ছার, মুরজ৮, বীণা,
মুরলী, তুম্বকী৯?
বর্ষ বাক্যসুধা তুমি ! নাচিবে পুলকে
তারা, মেঘনাদে১০ মাতি ময়ুরী যেমতি ।
গুরুর আদেশে যবে গাভীবৃন্দ লয়ে,
দূর বনে, সুরমণি, ভ্ৰমিতে একাকী
বহু দিন ; অহরহঃ, বিরহ-দহনে,
কত যে কাঁদিত তারা, কব তা কাহারে—
অবিরল অশ্রুজল মুছি লজ্জাভয়ে !
গুরুপত্নী বলি যবে প্ৰণমিতে পদে,
সুধানিধি, মুদি আঁখি, ভাবিতাম মনে,
মানিনী যুবতী আমি, তুমি প্রাণপতি,
মান-ভঙ্গ-আশে নত দাসীর চরণে !
আশীৰ্ব্বাদ-ছলে মনে নমিতাম আমি !
গুরুর প্রসাদ-অন্নে সদা ছিলা রত,
তারাকান্ত ; ভোজনান্তে আচমন-হেতু
যোগাইতে জল যবে গুরুর আদেশে
বহির্দ্বারে, কত যে কি রাখিতাম পাতে
চুরি করি আনি আমি, পড়ে কি হে মনে ?
হরীতকী-স্থলে, সখে, পাইতে কি কভু
তাম্বুল শয়নধামে ? কুশাসন-তলে,
হে বিধু, সুরভি ফুল কভু কি দেখিতে ?
হায় রে, কাঁদিত প্রাণ হেরি তৃণাসনে ;
কোমল কমল-নিন্দ ও বরাঙ্গ তব,
তেঁই, ইন্দু, ফুলশয্যা পাতিত দুঃখিনী !
কত যে উঠিত সাধ, পাড়িতাম যবে
শয়ন, এ পোড়া মনে, পার কি বুঝিতে ?
পূজাহেতু ফুলজাল তুলিবারে যবে
প্রবেশিতে ফুলবনে, পাইতে চৌদিকে
তোলা ফুল । হাসি তুমি কহিতে সুমতি,
“দয়াময়ী বনদেবী ফুল অবচয়ি১১,
রেখেছেন নিবারিতে পরিশ্রম মম !’’
কিন্তু সত্য কথা এবে কহি গুণনিধি ;
নিশীথে ত্যজিয়া শয্যা পশিত কাননে
এ কিঙ্করী ; ফুলরাশি তুলি চারি দিকে
রাখিত তোমার জন্যে ! নীর-বিন্দু যত
দেখিতে কুসুমদলে, হে সুধাংশু-নিধি,
অভাগীর অশ্রুবিন্দু—কহিনু তোমারে !
কত যে কহিত তারা—হায়, পাগলিনী !—
প্রতি ফুলে, কেমনে তা আনিব এ মুখে ?
কহিত সে চম্পকেরে,—“বৰ্ণ তোর হেরি,
রে ফুল, সাদরে তোরে তুলিবেন যবে
ও কর-কমলে, সখা, কহিস্ তাঁহারে,—
‘এ বর বরণ মম কালি অভিমানে
হেরি যে বর বরণ, হে রোহিণীপতি,
কালি সে বর বরণ তোমার বিহনে’।”
কহিত সে কদম্বেরে,—না পারি কহিতে
কি যে সে কহিত তারে, হে সোম, শরমে !—
রসের সাগর তুমি, ভাবি দেখ মনে !
শুনি লোকমুখে, সখে, চন্দ্রলোকে তুমি
ধর মৃগশিশু কোলে, কত মৃগশিশু
ধরেছি যে কোলে আমি কাঁদিয়া বিরলে,
কি আর কহিব তার? শুনিলে হাসিবে,
হে সুহাসি! নাহি জ্ঞান, না জানি কি লিখি!
ফাটিত এ পোড়া প্রাণ হেরি তারাদলে !
ডাকিতাম মেঘদলে চির আবরিতে
রোহিণীর স্বর্ণকান্তি । ভ্রান্তিমদে মাতি,
সপত্নী বলিয়া তারে গঞ্জিতাম রোষে !
প্রফুল্প কুমুদে হ্রদে হেরি নিশাযোগে
তুলি ছিঁড়িতাম রাগে –আঁধার কুটীরে
পশিতাম বেগে হেরি সরসীর পাশে
তোমায়! ভূতলে পড়ি, তিতি অশ্রুজলে,
কহিতাম অভিমানে—‘রে দারুণ বিধি,
নাহি কি যৌবন মোর,—রূপের মাধুরী ?
তবে কেন,—’ কিন্তু
বৃথা স্মরি পূর্বকথা !
নিবেদিব, দেবশ্রেষ্ঠ,
দিন দেহ যবে ।
তুষেছ গুরুর মনঃ সুদক্ষিণা-দানে ;
গুরুপত্নী চাহে ভিক্ষা,—দেহ ভিক্ষা তারে ।
দেহ ভিক্ষা—ছায়ারূপে থাকি তব সাথে
দিবা নিশি ! দিবা নিশি সেবি দাসীভাবে
ও পদযুগল,
নাথ,—হা ধিক, কি পাপে,
হায় রে, কি পাপে, বিধি, এ তাপ লিখিলি
এ ভালে ? জনম মম মহা ঋষিকুলে,
তবু চণ্ডালিনী আমি ? ফলিল কি এবে
পরিমলাকর১২ ফুলে, হায়, হলাহল ?
কোকিলের নীড়ে কি রে রাখিলি গোপনে
কাকশিশু ? কর্ম্মনাশা—পাপ-প্ৰবাহিণী !—
কেমনে পড়িল বহি জাহ্নবীর জলে?
ক্ষম, সখে —পোষা পানী, পিঞ্জর খুলিলে,
চাহে পুনঃ পশিবারে পূর্ব্ব কারাগারে !
এস তুমি ; এস শীঘ্ৰ ! যাব কুঞ্জ-বনে,
তুমি, হে বিহঙ্গরাজ, তুমি সঙ্গে নিলে !
দেহ পদাশ্রয় আসি,—প্রেম-উদাসিনী
আমি ! যথা যাও বাব ; করিব যা কর;—
বিকাইব কায় মনঃ তব রাঙা পায়ে !
কলঙ্কী শশাঙ্ক, তোমা বলে সৰ্ব্ব জনে ।
কর আসি কলঙ্কিনী কিঙ্করী তারারে,
তারানাথ ! নাহি কাজ বৃথা কুলমানে ।
এস, হে তারার বাঞ্ছা ! পোড়ে বিরহিণী,
পোড়ে যথা বনস্থলী ঘোর দাবানলে !
চকোরী সেবিলে
তোমা দেহ সুধা তারে,
সুধাময়১৩ ; কোন্ দোষে দোষী তব পদে
অভাগিনী ? কুমুদিনী কোন্ তপোবলে
পায় তোমা নিত্য, কহ ? আরম্ভি সত্বরে
সে তপঃ, আহার নিদ্রা ত্যজি একাসনে !
কিন্তু যদি থাকে দয়া, এস শীঘ্ৰ করি !
এ নব যৌবন, বিধু, অর্পিব গোপনে
তোমায়, গোপনে যথা অর্পেন আনিয়া
সিন্ধুপদে মন্দাকিনী স্বর্ণ, হীরা, মণি !
আর কি লিখিবে দাসী ? সুপণ্ডিত তুমি,
ক্ষণ ভ্রম ; ক্ষম দোষ । কেমনে পড়িব
কি কহিল পোড়া মনঃ, হায়, কি লিখিল
লেখনী ? আইস, নাথ, এ মিনতি পদে ।
লিখিনু লেপন বসি একাকিনী বনে,
কাঁপি ভয়ে—কাঁদি খেদে—মরিয়া শরমে !
লয়ে ফুলবৃন্ত,
কান্ত, নয়ন-কাজলে
লিখিনু ! ক্ষমিও দোষ, দয়াসিন্ধু তুমি !
আইলে দাসীর পাশে, বুঝিব ক্ষমিলে
দোষ তার, তারানাথ ! কি আর কহিব ?
জীবন মরণ মম আজি তব হাতে ।
ইতি শ্ৰীবীরাঙ্গনাকাব্যে তারাপত্রিকা নাম
দ্বিতীয় সর্গ
--------xXx--------
--------xXx--------
১. চন্দ্র। তারা বা নক্ষত্রদের পতিস্বরূপ।
২. কামদেব। কামদেবের রথের পতাকা মৎসচিহ্ন লাঞ্ছিত।
৩. রেশমী কাপড়।
৪. বক্ষবন্ধন।
৫. নূপুর
৬. মেখলা।
৭. মৃগকে মত্ত করে যা—কস্তুরী।
৮. মৃদঙ্গ।
৯. একতারা।
১০. মেঘের গর্জনে।
১১. চয়ন করে।
১২. মধুর আকর—ফুল।
১৩. অমৃতময়।—চন্দ্র।