:::: সূচীপত্র ::::
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা
চার্ব্বাক ও মঞ্জুভাষা

বনপথে চলেছে চার্ব্বাক,
সূৰ্য্যতাপে স্পন্দিত সে বন ;
ক্লান্ত আঁখি, চিন্তিত, নির্ব্বাক্,
বিনা কাজে ফিরিছে ভুবন ।

হ্রদের দক্ষিণ কূলে ভিড়ি'
শ্যামলেখা শোভিছে শৈবাল,
মরালীর পক্ষে চন্ধু রাখি'
আঁখি মুদে চলেছে মরাল।

তীর তীরে ঘন সারি দিয়ে
দেবদারু গড়েছে প্ৰাচীর,
বনস্থলী-মধুচক্র ভরি'
রশ্মি-মধু ঝরিছে মদির।

চলিয়াছে চাৰ্ব্বাক কিশোর,
ভ্ৰকুঞ্চিত, দৃঢ় ওষ্ঠাধর ;
শিশিরের পদ্মকলি সম
রুদ্ধ প্ৰাণে দ্বন্দ্ব নিরন্তর।

"আজি যদি মঞ্জুভাষা আসে এই পথ দিয়া,
চকিতে আঁচলখানি নেব তার পরশিয়া,
সে যদি জানিতে পারে ! সে যদি পালটি চায় !
মাগিয়া লইতে ক্ষমা আমি কি পারিব, হায়!
সে এলে অবশ্য তনু, কথা না জুয়ায় আর ।
কত যেন অপরাধ,—আঁখি নোয় বারবার !

সময় বহিয়া যায়, চ'লে যায় রূপসী,
রাখিয়া রূপের স্মৃতি ডুবে যায় সে শশী ।

 米 米 米 米 米 米

"কে বলে বিধাতা আছে, হায়,
কে বলে সে জগতের পিতা,
পিতা কবে সন্তানে কাঁদায়,—
ক্ষুধায় কাঁদিলে দেয় তিতা !
পিতা যদি সর্ব্বশক্তিমান
পুত্র কেন তাপের অধীন ?

পিতা যদি দয়ার নিধান
পুত্র কেন কাঁদে চিরদিন ?

নাহি—নাহি—নাহি হেন জন,
বিধি নাই—নাহিক বিধান ;
কোন্‌ ধনী পিতার সংসারে
অনাহারে মরেছে সন্তান ?

মোরা যে বিশ্বের পরমাণু
স্নেহ প্ৰেম মোদেরো প্ৰবল ;
আর যেই ত্ৰিলোকের পিতা
তারি প্ৰাণ পাষাণ-নিশ্চল ?

দাসীপুত্র যারা জন্মদাস
ভয়ে ভক্তি জানি তাহাদের,
আজন্ম যে হ'তেছে নিরাশ,—
সেও রত তোষামোদে ফের !
ধিক্‌ ! ধিক্‌ ! মরণের দাস !
মুখে বল পুত্ৰ অমৃতের !

ছিল দিন,—হাসি আসে এবে ;—
নখে চিরি' বক্ষ আপনার,
আমিও ক'রেছি লোহদান
লৌহময় পায়ে দেবতার।

বালকের অখিল হৃদয়ে
আমিও করেছি আরাধন,
ধ্রুব কি প্ৰহ্লাদ বুঝি কভু
জানে নাই ভকতি তেমন ।

ফল তার ?—পদে পদে বাধা
আজনম,—বুঝি আমরণ !
মরণের পরে কিবা আর ?
নাহি—নাহি—নাহি— কোনো জন।"

অকস্মাৎ চাহিল চাৰ্ব্বাক
পশ্চিমে পড়েছে, হেলে রবি,
রশ্মি-রসে ডুবু ডুবু বন,ৱ
আবির্ভূতা বনে বনদেবী !

মঞ্জু ভাষা রূপে বনদেবী
শিরে ধরি' পাষণ কলস,
আসে ধীরে আশ্রম বাহিরে
গতি ধীর, মন্থর, অলস।

পর্ণরাশি-মৰ্ম্মর-মঞ্জীর
পদতলে মরিছে গুঞ্জরি' ;
অযতনে কুন্তলে বল্কলে
লগ্ন তার নীবার-মঞ্জরী।

লতিকার তন্তু সে অলক,
মঙ্গল-প্ৰদীপ আঁখি তার ;
পরিপূর সংযত পুলকে
কপোল সে পুষ্প মহুয়ার।

ওষ্ঠে তার জাগ্ৰত কৌতুক,
অধরেতে সুপ্ত অভিমান ;
বাহুলতা চন্দনের শাখা,
বর্ণ তার চন্দ্ৰিকা সমান ।

চাহিয়া সহসা বালা ডাকিল চাৰ্ব্বাকে
"ওগো ! শোনো শোনো,
শুনিলু এনেছ তুমি মৃগ-শিশু এক,
আছে কি এখনো ?"
মন-ভুলে চেয়েছিল মুখপানে তার
বিস্ময়ে চার্ব্বাক,
নীরব হইল বালা ; কি দিবে উত্তর ?
বিষম বিপাক !
কহে শেষে ক্ষীণ হেসে গদগদ বচন
"সুন্দর হরিণ,
চিত্ৰিত শরীর তার সোনার বরণ ;—
যোয়ো একদিন ।
আজ যাবে?" মুখ চেয়ে জিজ্ঞাসে চার্ব্বাক
ভরসা ও ভয়ে ;
মঞ্জুভাষা কহে "না, না আজ?—আজ থাক্ !"
আধেক বিস্ময়ে !

সহসা সংবরি আপনায়,
কহে বালা চাহি মুখপানে,

"শুনিনু মা-হারা মৃগ-শিশু
মৃত মৃগী কিরাতের বাণে
ইচ্ছা করে পালিতে তাহায়,—
শিশু সে যে মা-হারা হরিণ ;
পড় তুমি,—অবসর না থাকে তোমার,—
বলিলে পালিতে পারি। আমি সারদিন ।

বল, আমি মা হ'ব তাহার।"
"তাই হোক্‌" কহিল চাৰ্ব্বাক,
"আমার স্নেহের ধনে তব স্নেহ-ধার
দিয়ে তুমি।" কহি যুবা হইল নির্ব্বাক্‌।
কৌতুকে চাহিয়া মুখপানে
মঞ্জুভাষা মঞ্জুলীলাভরে
চ'লে গেল মরাল গমনে
জল নিতে ক্ৰৌঞ্চ-সরোবরে ।

আশার বাতাসে করি ভর
ফিরে এল চাৰ্ব্বাক কুটীরে,
ভাষাহীন আশার আবেশে
সুখভরে চুমে মৃগটিরে।

ঠেকেছিল মনোতরী খান্‌ ।
প্ৰাণ-নাশা সংশয়-চরায়,
ভাষাহীন আশা পেয়ে আজ
হর্ষে ভেসে চলে পুনরায়।

যত কিছু ছিল বলিবার
না বলিতে হ'ল যেন বলা,
বোঝা—সোজা হ'ল মনে মনে,
ধুয়ে গেল যত মাটি মলা।

ছিল ঠেকে মনোতরী খান,
চলিল সে কাহার ইঙ্গিতে ?
কে গো তুমি দুর্জ্ঞেয় মহান্‌ !
কে দেবতা এলে আজি

"এ আনন্দ কে দিলে আমায় ?—
আশা-সুখে মন পরিপূর !
এতদিন চিনি নি তোমায় ;
আজ বটে। দয়ার ঠাকুর !"

রাত্রি এল ;—শয্যাতলে জাগিয়া চার্ব্বাক,
আশা-সুখে ধন্য মানে জন্ম আপনার ;
নিগুৰ্ণ মহেশে যেই করিয়াছে হেলা,
আনন্দ-মূৰ্ত্তিতে হিয়া পূর্ণ আজি তার !

সেই একদিন শুধু জীবনে চার্ব্বাক
নত হ'য়েছিল নিজে চরণে ধাতার ;
প্রেমের কল্যাণে শুধু সেই একদিন,—
সে যে আনন্দের দিন,—সে যে প্রত্যাশার।

সূত্র : কুহু ও কেকা — সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত [চতুর্থ সংস্করণ/১৯২৯]

২টি মন্তব্য: