:::: সূচীপত্র ::::

লক্ষ্মণের প্রতি সূর্পণখা

[যৎকালে রামচন্দ্র পঞ্চবটী-বনে বাস করেন, লঙ্কাধিপতি রাবণের ভগিনী সূর্পণখা রামানুজের মোহন-রূপে মুগ্ধা হইয়া, তাঁহাকে এই নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি লিখিয়াছিলেন। কবিগুরু বাল্মীকি রাজেন্দ্র রাবণের পরিবারবর্গকে প্রায়ই বীভৎস রস দিয়া বর্ণন করিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এ স্থলে সে রসের লেশ মাত্রও নাই। অতএব পাঠকবর্গ সেই বাল্মীকিবর্ণিতা বিকটা সূর্পণখাকে স্মরণপথ হইতে দূরীকৃতা করিবেন।]
কে তুমি,বিজন বনে ভ্রম হে একাকী,
বিভূতি-ভূষিত অঙ্গ? কি কৌতুকে, কহ,
বৈশ্বানর, লুকাইছ ভম্মের মাঝারে?
মেঘের আড়ালে যেন পূর্ণশশী আজি?
ফাটে বুক জটাজুট হেরি তব শিরে,
মঞ্জুকেশি! স্বর্ণশয্যা ত্যজি জাগি আমি
বিরাগে, যখন ভাবি, নিত্য নিশাযোগে
শয়ন, বরাঙ্গ তব, হায় রে, ভূতলে!
উপাদেয় রাজ-ভোগ যোগাইলে দাসী,
কাঁদি ফিরাইয়া মুখ, পড়ে যবে মনে
তোমার আহার নিত্য ফল মূল, বলি!
সুবর্ণ-মন্দিরে পশি নিরানন্দ গতি,
কেন নানিবাস তব বঞ্জুল মঞ্জুলে!

হে সুন্দর, শীঘ্র আসি কহ মোরে শুনি
কোন্‌ দুঃখে ভব-সুখে বিমুখ হইলা
এ নব যৌবনে তুমি? কোন্‌ অভিমানে
রাজবেশ ত্যজিলা হে উদাসীর বেশে?
হেমাঙ্গ মৈনাক-সম, হে তেজস্বি, কহ,
কার ভয়ে ভ্রম তুমি এ বন-সাগরে
একাকী, আবরি তেজঃ ক্ষীণ, ক্ষুণ্ন খেদে?
তোমার মনের কথা কহ আসি মোরে।
যদি পারভূত তুমি রিপুর বিক্রমে,
কহ শীঘ্র ; দিব সেনা ভব-বিজয়িনী,
রথ, গজ, অশ্ব, রথীঅতুল জগতে!
বৈজয়ন্ত-ধামে নিত্য শচীকান্ত বলী
ত্রস্ত অস্ত্র-ভয়ে যার, হেন ভীম রথী
যুঝিবে তোমার হেতুআমি আদেশিলে!
চন্দ্রলোকে, সূর্য্যলোকে,যে লোকে ত্রিলোকে
লুকাইবে অরি তব, বাঁধি আনি তারে
দিব তব পদে, শূর! চামুণ্ডা আপনি,
(ইচ্ছা যদি কর তুমি) দাসীর সাধনে,
(কুলদেবী তিনি, দেব,) ভীমখণ্ডা হাতে
ধাইবেন হুহুঙ্কারে নাচিতে সংগ্রামে
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস!যদি অর্থ চাহ,
কহ শীঘ্র ;অলকার ভাণ্ডার খুলিব
তুষিতে তোমার মনঃ ; নতুবা কুহকে
শুষি রত্মাকরে, লুটি দিব রত্ম-জালে!
মণিযোনি খনি যত, দিব হে তোমারে!
প্রেম-উদাসীন যদি তুমি, গুণমণি,
কহ, কোন্‌ যুবতীর(আহা, ভাগ্যবতী
রামাকুলে সে রমনী!)কহ শীঘ্র করি,
কোন্‌ যুবতীর নব যৌবনের মধু
বাঞ্ছা তব? অনিমিষে রূপ তার ধরি,
(কামরূপা আমি, নাথ,) সেবিব তোমারে!
আনি পারিজাত ফুল, নিত্য সাজাইব
শয্যা তব! সঙ্গে মোর সহস্র সঙ্গিনী,
নৃত্য গীত রঙ্গে রত। অপ্সরা, কিন্নরী,
বিদ্যাধরী,ইন্দ্রাণীর কিঙ্করী যেমতি,
তেমতি আমারে সেবে দশ শত দাসী।
সুবর্ণ-নির্ম্মিত গৃহে আমার  বসতি
মুক্তাময় মাঝ তার; সোপান খচিত
মরকতে; স্তম্ভের হীরা; পদ্মরাগ মণি;
গবাক্ষে দ্বিরদ-রদ, রতন কপাটে!
সুকল স্বরলহরী উথলে চৌদিকে
দিবানিশি;  গায় পাখী সুমধুর স্বরে;
সুমধুরতর স্বরে গায় বীণাবাণী
বামাকুল! শত শত কুসুম-কাননে
লুটি পরিমল, বায়ু অনুক্ষণ বহে!
খেলে উৎস; চলে জল কলকল কলে!
কিন্তু বৃথা এ বর্ণনা। এস, গুণনিধি,
দেখ আসি,এ মিনতি দাসীর ও পদে!
কায়, মনঃ প্রাণ আমি সঁপিব তোমারে!
ভুঞ্জ আসি রাজ-ভোগ দাসীর আলয়ে;
নহে কহ, প্রাণেশ্বর! অম্লান বদনে,
এ বেশ ভূষণ ত্যজি, উদাসিনী-বেশে
সাজি, পূজি, উদাসীন, পাদ-পদ্ম তব!
রতন কাঁচলি খুলি, ফেলি তারে দূরে,
আবরি বাকলে স্তন; ঘুচাইয়া বেণী,
মণ্ডি জটাজুটে শিরঃ ভুলি রত্মরাজী,
বিপিন-জনিত ফুলে বাঁধি হে কবরী!
মুছিয়া চন্দন, লেপি ভস্ম কলেবরে।
পরি রুদ্রাক্ষের মালা, মুক্তামালা ছিঁড়ি
গলদেশে! প্রেম-মন্ত্র দিও কর্ণ-মূলে ;
গুরু দক্ষিণা-রূপে প্রেম গুরু-পদে
দিব এ যৌবন-ধন প্রেম-কুতূহলে!
প্রেমাধীনা নারীকুল ডরে কি হে দিতে
জলাঞ্জলি, মঞ্জকেশি, কুল, মান ধনে
প্রেমলাভ-লোভে কভু? বিরলে লিখিয়া
লেখন, রাখিনু, সখে, এই তরুতলে।
নিত্য তোমা হেরি হেথা; নিত্য ভ্রম তুমি
এই স্থলে। দেখ চেয়ে; ওই যে শোভিছে
শমী,লতাবৃতা, মরি, ঘোমটায় যেন,
লজ্জাবতী!দাঁড়াইয়া উহার আড়ালে,
গতিহীনা লজ্জাভয়ে, কত যে চেয়েছি
তব পানে, নরবরহায়! সূর্য্যমুখী
চাহে যথা স্থির-আঁখি সে সূর্য্যের পানে!
কি আর কহিব তার ? যত ক্ষণ তুমি
থাকিতে বসিয়া, নাথ, থাকিত দাঁড়ায়ে
প্রেমের নিগড়ে বদ্ধা এ তোমার দাসী!
গেলে তুমি শূন্যাসনে বসিতাম কাঁদি!
হায় রে, লইয়া ধূলা, সে স্থল হইতে
যথায় রাখিতে পদ, মাখিতাম ভালে,
হব্য-ভস্মতপস্বিনী মাখে ভালে যথা!
কিন্তু বৃথা কহি কথা! পড়িও, নৃমণি,
পড়িও এ লিপিখানি, এ মিনতি পদে!
যদিও ও হৃদয়ে দয়া উদয়ে, যাইও
গোদাবরী-পূর্বকূলে; বসিব সেখানে
মুদিত কুমুদীরূপে আজি সায়ংকালে;
তুষিও দাসীরে আসি শশধর-বেশে!
লয়ে তরি সহচরী থাকিবেক তীরে;
সহজে হইবে পার। নিবিড় সে পারে
কানন, বিজন দেশ। এস, গুণনিধি!
দেখিব প্রেমের স্বপ্ন জাগি হে দুজনে!
যদি আজ্ঞা দেহ, এবে পরিচয় দিব
সংক্ষেপে। বিখ্যাত, নাথ, লঙ্কা, রক্ষঃপুরী
স্বর্ণময়ী, রাজা তথা রাজ-কুল-পতি
রাবণ, ভগিনী তাঁর দাসী; লোকমুখে
যদি না শুনিয়া থাক, নাম সূর্পণখা।
কত যে বয়সে তার; কি রূপ বিধাতা
দিয়াছেন, আশু আসি দেখ, নরমণি!
আইস মলয়-রূপে; গন্ধহীন যদি
এ কুসুম, ফিরে তবে যাইও তখনি!
আইস ভ্রমর-রূপে; না যোগায় যদি
মধু ও যৌবন-ফুল, যাইও উড়িয়া
ুঞ্জরি বিরাগ-রাগে ! কি আর কহিব?
মলয় ভ্রমর, দেব, আসি সাধে দোহে
বৃন্তাসনে মালতীরে! এস, সখে, তুমি ;
এই নিবেদন করে সূর্পণখা পদে।
শুন নিবেদন পুনঃ। এত দূর লিখি
লেখন, সখীর মুখে শুনিনু হরষে,
রাজরথী দশরথ অযোধ্যাধিপতি,
পুত্র তুমি, হে কন্দর্প-গর্ব্ব-খর্ব্ব-কারি,
তাঁহার ; অগ্রজ সহ পশিয়াছ বনে
পিতৃ-সত্য-রক্ষা-হেতু। কি আশ্চর্য্য! মরি,
বালাই১০ লইয়া তব, মরি, রঘুমণি,
দয়ার সাগর তুমি! তা না হলে কভু
রাজ্য-ভোগ ত্যজিতে কি ভ্রাতৃ-প্রেম-বশে?
দয়ার সাগর তুমি। কর দয়া মোরে,
প্রেম ভিখারিণী আমি তোমার চরণে!
চল শীঘ্র যাই দোঁহে স্বর্ণ লঙ্কাধামে।
সম পাত্র মানি তোমা, পরম আদরে,
অর্পিবেন শুভ ক্ষণে রক্ষঃ-কুল-পতি
দাসীরে কমল-পদে। কিনিয়া, নৃমণি
অয্যোধ্য-সদৃশ রাজ্য শতেক যৌতুকে,
হবে রাজা; দাসী-ভাবে সেবিবে এ দাসী!
এস শীঘ্র, প্রাণেশ্বর; আর কথা যত
নিবেদিব পাদ-পদ্মে বসিয়া বিরলে।
ক্ষম অশ্রু-চিহ্ন পত্রে; আনন্দে বহিছে
অশ্রু-ধারা! লিখেছে কি বিধাতা এ ভালে
হেন সুখ, প্রাণসখে? আসি ত্বরা করি,
প্রশ্নের উত্তর, নাথ, দেহ এ দাসীরে।
ইতি শ্রীবীরাঙ্গনাকাব্যে সূর্পণখাপত্রিকা
নামে পঞ্চম সর্গ।

--------xXx--------

১. বেত।
২. কুঞ্জ।
৩. ভয়াবহ খড়্গ।
৪. যক্ষরাজ কুবেরের রাজধানী।
৫. মণির উৎপত্তিস্থল।
৬. মুহূর্তে।
৭. যে ইচ্ছামত রূপ ধারণে সক্ষম।
৮. মেঝে।
৯. যজ্ঞের ভস্ম।
১০. অমঙ্গল।

সূত্র : মধুসূদন রচনাবলী-সব্যসাচী রায় (সম্পাদনায়)