:::: সূচীপত্র ::::
মহাকবি কায়কোবাদ
(১৮৫৭-১৯৫১)
 
বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সভ্যতার আধুনিক যুগের শুরু উনিশ শতক। সেইসময় বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যচর্চা ছিল মূলত দোভাষী পুথিঁ সাহিত্য-কেন্দ্রিক, তখন তিনি আবির্ভূত হলেন; আরবী পড়ুয়া বঙ্গীয়-মুসলমান কবিরা পুঁথিতে আঁটকে থাকতেন, তখন তাঁর স্বতন্ত্র পদচারণা,বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ উপকরণ।
আধুনিক বাংলা মহাকাব্য ধারার শেষ কবি কায়কোবাদ এর প্রকৃত নাম কাজেম আলী কোরেশী, কায়কোবাদ তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম।
“মীর মশাররফ, কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হকের মধ্যে কায়কোবাদই হচ্ছেন সর্বতোভাবে একজন কবি। কাব্যের আদর্শ ও প্রেরণা তাঁর মধ্যেই লীলাময় হয়ে ওঠে। সেজন্য একথা বেশ জোরের সঙ্গে বলা যায় যে কবি কায়কোবাদই হচ্ছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি” (একুশের স্মারকগ্রন্থ ‘৯৭- কায়কোবাদের কাব্যে ধর্মীয় অনুভূতি - আজহার ইসলাম - ১৪৮ পৃ:)
তিনি বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতা।

কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষায় “কায়কোবাদের কবিতা শুধু শব্দের কৌশলময় গাঁথুনী নয়, -প্রাণের তলদেশ থেকে উৎসারিত। তাই প্রাণের উপর এর ক্রিয়া হয়- তাইতেই এতে এত মাদকতা। স্বতঃউৎসারিত ভাবাবেগ কাব্যরূপে প্রকাশিত হয়ে যে রসের সৃষ্টি করে তা বড়ই উপভোগ্য- সে যেন কাব্যের দশমরসরূপী প্রাণরস।” (প্রবন্ধসংগ্রহ-কাজী মোতাহার হোসেন -৬৩৮ পৃ:)
তিনি এমন সময়ের কবি, “অতীতমুখী স্বধর্মীয় গৌরব-গর্বী বাঙালী শিক্ষিত কেবল হিন্দু কিংবা মুসলমান হয়েছে- কখনো বাঙালী হয়নি।” (আহমেদ শরীফ রচনাবলী - ২য় খন্ড - কালিক ভাবনা - কবি কায়কোবাদ - ৩৯২ পৃ:)
 
“কায়কোবাদের রচনায় ভাব-চিন্তার ক্ষেত্রে রয়েছে সমকালীনতা আর দৃষ্টি ও কামনার জগৎ হয়েছে ফেলে-আসা সুদূর ও অদূর অতীত।” (আহমেদ শরীফ- প্রাগুক্ত -৩৯১ পৃ:)
 
ধর্মচেতনায় কায়কোবাদ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। এই আঅসাম্প্রদিকতাই তাঁকে, যাঁরা নিজেদের রচনায় নির্বিচারে মুসলমানত্ব প্রচারে নিয়োজিত থাকতেন, তাঁদের কটু সমালোচনার সম্মুখীন করে। (একুশে স্মারকগ্রন্থ ‘৯৭ - প্রাগুক্ত- ১৪৯ পৃ: )
 
কায়কোবাদ গীতি-কবিতা দিয়ে তাঁর কবি-জীবনের সূচনা করেন। তবে তার কবিতায় দু’টি ধারা লক্ষ করা যায়:
১) গীতি-কবিতা ও ২) কাহিনীকাব্য ।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ :
বিরহ বিলাপ (১৮৭০) (এটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ)
কুসুম কানন (১৮৭৩);
অশ্রুমালা (১৮৯৬);
মহাশ্মশান (১৯০৪), এটি তারঁ রচিত মহাকাব্য
শিব মন্দির (১৯২১);
অমিয় ধারা (১৯২৩);
শ্মশানভষ্ম (১৯২৪);
মহররম শরীফ (১৯৩৩); 'মহররম শরীফ' কবির মহাকাব্যোচিত বিপুল আয়তনের একটি কাহিনী কাব্য।
শ্মশান ভসন (১৯৩৮)
এর মধ্যে ৬টি কাহিনীকাব্য রচনা করেছেন।
১.মহাশশ্মান (১৯০৫)
২. শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য (১৯২১)
৩. মহরম শরিফ বা আত্মবিসর্জন কাব্য (১৯৩৩)
৪. শশ্মান-ভস্ম (১৯৩৮)
৫. প্রেমের রাণী (১৯৭০)
৬. প্রেম পারিজাত (১৯৭০)"
(একুশের স্মারকগ্রন্থ ১৯৯৯ - কায়কোবাদের আখ্যানকাব্য - পৃথ্বীলা নাজনীন - ২৪৮পৃ:)
 
মুসলমান কবি রচিত জাতীয় আখ্যান কাব্যগুলোর মধ্যে সুপরিচিত মহাকবি কায়কোবাদ রচিত ‘মহাশ্মশান’ কাব্যটি। কায়কোবাদের মহাকবি নামের খ্যাতি এই মহাশ্মশান কাব্যের জন্যই।
কাব্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে ঊনত্রিশ সর্গ,দ্বিতীয় খন্ডে চব্বিশ সর্গ, এবং তৃতীয় খন্ডে সাত সর্গ।
মোট ষাট সর্গে প্রায় নয়শ' পৃষ্ঠার এই কাব্য বাংলা ১৩৩১, ইংরেজি ১৯০৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়; যদিও গ্রন্থাকারে প্রকাশ হতে আরো ক'বছর দেরী হয়েছিল। একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধযজ্ঞকে রূপায়িত করতে গিয়ে কবি বিশাল কাহিনী,ভয়াবহ সংঘর্ষ, গগনস্পর্শী দম্ভ,এবং মর্মভেদী বেদনাকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন। বিশালতার যে মহিমা রয়েছে তাকেই রূপ দিতে চেয়েছিলেন এই কাব্যে।
 
“... সেদিন কায়কোবাদ এক নির্জিত সমাজের প্রতিনিধি-প্রতিভূ কিংবা মুখপাত্র হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ...তাঁর স্বসমাজের লোক পেয়েছিল প্রাণের প্রেরণা ও পথের দিশা। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন বলেই আমরা এই মুহূর্তেও শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি মহাশ্মশানের কবিকে।” (আহমেদ শরীফ, প্রাগুক্ত - ৩৯৩ পৃ:)
 
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মুল অধিবেশনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা কাব্য সাহিত্যে অবদানের জন্য নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ ও ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন।