অপবিজ্ঞান (প্রথম অংশ)
বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের ফলে প্রাচীন অন্ধসংস্কার
ক্রমশ দূর হইতেছে। কিন্তু যাহা যাইতেছে তাহার স্থানে নূতন জঞ্জাল কিছু কিছু জমিতেছে। ধর্মের বুলি লইয়া
যেমন অপধর্ম সৃষ্ট হয়, তেমনি বিজ্ঞানের বুলি
লইয়া অপবিজ্ঞান গড়িয়া উঠে। সকল দেশেই বিজ্ঞানের নামে অনেক নূতন ভ্রান্তি সাধারণের মধ্যে
প্রচলিত হইয়াছে। বৈজ্ঞানিক ছদ্মবেশে যেসব ভ্ৰান্ত ধারণা এদেশে লোকপ্রিয় হইয়াছে, তাহারই কয়েকটির কথা বলিতেছি।
প্রথমেই উল্লেখযোগ্য-বিদ্যুৎ। তীব্ৰ উপহাসের ফলে
এই শব্দটির প্রয়োগে আজকাল কিঞ্চিৎ সংযম আসিয়াছে। টিকিতে বিদ্যুৎ, পইতায় বিদ্যুৎ, গঙ্গাজলে বিদ্যুৎ—এখন বড় একটা শোনা যায় না। গল্প শুনিয়াছি, এক সভায় পন্ডিত
শশধর তর্কচূড়ামণি অগস্ত্যমুনির সমুদ্ৰশোষণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। অগস্ত্যের ক্রুদ্ধ
চক্ষু হইতে এমন প্রচন্ড বিদ্যুৎস্রোত নিৰ্গত হইল যে সমস্ত সমুদ্রের জল এক নিমেষে বিশ্লিষ্ট
হইয়া হাইড্রোজেন অক্সিজেন রূপে উবিয়া গেল। সকলে অবাক হইয়া এই ব্যাখ্যা শুনিল, কেবল একজন ধৃষ্ট শ্রোতা বলিল—'আরে না মশায়, আপনি জানেন
না, চোঁ করে মেরে দিয়েছিল'।
প্রাণিদেহ মাত্ৰেই কিঞ্চিৎ ফসফরাস আছে, কিন্তু তাহা যৌগিক অবস্থায় আছে, এবং তাঁহাতে বিষধর্ম নাই। এক টুকরা মাছে যত ফসফরাস আছে, একটি জোনাকিতে তাহার অপেক্ষা অনেক কম আছে। মাছ-পোড়া যেমন নিরাপদ, জোনাকি-পোড়াও তেমন।
বিদ্যুতের মহিমা কমিলেও একেবারে লোপ পায়
নাই। কিছুদিন পূর্বে কোনও
মাসিক পত্রিকায় এক কবিরাজ মহাশয় লিখিয়াছিলেন— 'সর্বদাই মনে রাখিবেন তুলসীগাছের সর্বত্র
নিরস্তর বৈদ্যুতিক প্রবাহ সঞ্চারিত হইতেছে।' এই অপূর্ব তথ্যটি তিনি কোথায় পাইলেন, চরকে কি সুশ্রুতে কিংবা নিজ মনের অন্তস্তলে, তাহা বলেন নাই। বৈদ্যুতিক সালসা বৈদ্যুতিক আংটি বাজারে সুপ্রচলিত। অষ্টধাতুর মাদুলির
গুণ এখন আর শাস্ত্ৰ বা প্রবাদের উপর নির্ভর করে না। ব্যাটারিতে দুই রকম ধাতু থাকে বলিয়া বিদ্যুৎ
উৎপন্ন হয়, অতএব অষ্টধাতুর উপযোগিতা আরও বেশী না হইবে
কেন ! বিলাতী খবরের কাগজেও বৈদ্যুতিক কোমরবন্ধের বিজ্ঞাপন মায় প্রসংশাপত্র বাহির হইতেছে। সাহেবরা ঠকাইবার বা ঠকিবার পাত্র নয়, অতএব তোমার আমার অশ্রদ্ধার কোনও হেতু নাই। মোট কথা, সাধারণের বিশ্বাস—মিছরি নিম এবং ভাইটামিনের তুল্য বিদ্যুৎ একটি উৎকৃষ্ট পথ্য, যেমন করিয়া
হউক দেহে সঞ্চারিত করিলেই উপকার। বিদ্যুৎ কি করিয়া উৎপন্ন হয়, তাহার প্রকার
ও মাত্ৰা আছে কিনা, কোন রোগে কি রকমে প্রয়োগ করিতে হয়, এত কথা কেহ
ভাবে না। আমার পরিচিত এক মালীর হাতে বাত হইয়াছিল। কে তাহাকে বলিয়াছিল বিজলীতে বাত সারে এবং
টেলিগ্রাফের তারে বিজলী আছে। মালী এক টুকরা ঐ তার সংগ্ৰহ করিয়া হাতে তাগা পরিয়াছিল।
উত্তর দিকে মাথা রাখিয়া
শুইতে নাই, শাস্ত্ৰে বারণ আছে। শাস্ত্র কারণ নির্দেশ করে না। সুতরাং বিজ্ঞানকে সাক্ষী মানা হইয়াছে। পৃথিবী একটি প্রকান্ড
চুম্বক, মানুষের দেহও নাকি চুম্বকধর্মী—অতএব উত্তরমেরুর দিকে
মাথা না রাখাই যুক্তিসিদ্ধ। কিন্তু দক্ষিণমেরু নিরাপদ কেন হইল তাহার কারণ কেহ দেন নাই।
জোনাকিপোকা প্ৰদীপে
পুড়িলে যে ধূয়া বাহির হয় তাহা অত্যন্ত বিষ এই প্ৰবাদ বহুপ্রচলিত। অপবিজ্ঞান বলে—জোনাকি হইতে আলোক বাহির হয় অতএব তাহাতে প্রচুর ফসফরাস আছে, এবং ফসফরাসের
ধূয়া মারাত্মক বিষ। প্রকৃত কথা— ফসফরাস যখন মৌলিক অবস্থায় থাকে তখন বায়ুর স্পর্শে তাহা হইতে
আলোক বাহির হয়, এবং ফসফরাস বিষও বটে। কিন্তু জোনাকির আলোক ফসফরাস-জনিত নয়। প্রাণিদেহ মাত্ৰেই কিঞ্চিৎ ফসফরাস আছে, কিন্তু তাহা
যৌগিক অবস্থায় আছে, এবং তাঁহাতে বিষধর্ম নাই। এক টুকরা মাছে যত ফসফরাস আছে, একটি জোনাকিতে
তাহার অপেক্ষা অনেক কম আছে। মাছ-পোড়া যেমন নিরাপদ, জোনাকি-পোড়াও তেমন।
কোনও কোনও বৈজ্ঞানিক নামের একটা মোহিনী শক্তি
আছে, লোকে সেই নাম শিখিলে স্থানে অস্থানে প্রয়োগ করে। 'গাটােপার্চা' এইরকম একটি মুখরোচক শব্দ। ফাউন্টেন পেন চিরুনি চশমার ফ্রেম প্রভৃতি
বহু বস্তুর উপাদানকে লোকে নির্বিচারে গাটােপার্চা বলে। গােটােপার্চ রবারের ন্যায় বৃক্ষবিশেষের নিষ্যন্দি। ইহাতে বৈদ্যুতিক তারের
আবরণ হয়, জলরোধক বার্নিশ হয়, ডাক্তারি চিকিৎসায় ইহার পাত ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সাধারণত লোকে
যাহাকে গােটাপার্চ বলে তাহা অন্য বস্তু। আজকাল যেসকল শৃঙ্গবৎ কৃত্রিম পদার্থ প্রস্তুত হইতেছে তাহার
কথা সংক্ষেপে বলিতেছি। —
নাইট্রিক অ্যাসিড তুলা ইত্যাদি হইতে সেলিউলয়েড হয়। ইহা কাচতুল্য
স্বচ্ছ কিন্তু অন্য উপাদান যোগে রঞ্জিত চিত্রিত বা হাতির দাঁতের ন্যায় সাদা করা যায়। ফোটােগ্রাফের
ফিল্ম, মোটর গাড়ির
জানালা, হার্মেনিয়মের
চাবি, পুতুল, চিরুনি, বোতাম প্রভৃতি অনেক জিনিসের উপাদান
সেলিউলয়েড। অনেক চশমার ফ্রেমও এই পদার্থ।
টিন শব্দের অপপ্রয়োগ আমরা ইংরেজের কাছে শিখিয়াছি। ইহার প্রকৃত অর্থ রাং, ইংরেজীতে তাঁহাই মুখ্য অর্থ। কিন্তু আর এক অর্থ-রাং-এর লেপ দেওয়া লোহার পাত অথবা তাহা হইতে প্ৰস্তুত আধার, যথা 'কেরোসিনের টিন'। ঘর ছাহিবার করুগেটেড লোহায় দস্তার লেপ থাকে। তাহাও 'টিন' আখ্যা পাইয়াছে, যথা 'টিনের ছাদ'।
রবারের
সহিত গন্ধক মিলাইয়া ইবনাইট বা ভল্কানাইট প্রস্তুত হয়। বাংলায়
ইহাকে 'কাচকড়া' বলা হয়, যদিও কাচকড়ার মূল অর্থ কাছিমের
খোলা। ইবনাইট
স্বচ্ছ নয়। ইহা হইতে ফাউন্টেন পেন চিরুনি প্রভৃতি
প্ৰস্তুত হয়।
আরও নানাজাতীয় স্বচ্ছ বা শৃঙ্গবৎ
পদার্থ বিভিন্ন নামে বাজারে চলিতেছে, যথা-সেলোফেন, ভিসকোজ, গ্যালালিথ, ব্যাকেলাইট ইত্যাদি। এগুলির
উপাদান ও প্রস্তুতপ্রণালী বিভিন্ন। নকল রেশম, নকল হাতির দাঁত, নানারকম বার্নিশ, বােতাম, চিরুনি প্রভৃতি বহু শৌখিন জিনিস
ঐসকল পদার্থ হইতে প্ৰস্তুত হয়।
বঙ্গভঙ্গের
সময় যখন মেয়েরা কাচের চুড়ি বর্জন করিলেন তখন একটি অপূর্ব স্বদেশী পণ্য দেখা দিয়াছিল—'আলুর চুড়ি'। ইহা বিলাতী সেলিউলয়েডের
পাতা জুড়িয়া প্ৰস্তুত। আলুর সহিত ইহার কোনও সম্পর্ক নাই। বিলাতী
সংবাদপত্রে মাঝে মাঝে অতিরঞ্জিত আজগবী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের খবর বাহির হয়। বহুকালপূর্বে
কোনও কাগজে পড়িয়াছিলাম গন্ধকাম্লে আলু ভিজাইয়া কৃত্ৰিম হস্তিদন্ত প্ৰস্তুত হইতেছে। বোধ হয়
তাহা হইতেই আলুর চুড়ি নামটি রাটিয়াছিল।
আর একটি
ভ্রান্তিকর নাম সম্প্রতি সৃষ্টি হইয়াছে—'আলপাকা
শাড়ি'। আলপাকা
একপ্রকার পশমী কাপড়। কিন্তু আলপাকা শাড়িতে পশমের লেশ
নাই, ইহা কৃত্রিম
রেশম হইতে প্ৰস্তুত।
টিন শব্দের অপপ্রয়োগ আমরা ইংরেজের
কাছে শিখিয়াছি। ইহার প্রকৃত অর্থ রাং, ইংরেজীতে তাঁহাই মুখ্য অর্থ। কিন্তু
আর এক অর্থ-রাং-এর লেপ দেওয়া লোহার পাত অথবা তাহা হইতে প্ৰস্তুত আধার, যথা 'কেরোসিনের টিন'। ঘর ছাহিবার করুগেটেড লোহায় দস্তার
লেপ থাকে। তাহাও 'টিন' আখ্যা পাইয়াছে, যথা 'টিনের ছাদ'।
আজকাল মনোবিদ্যার উপর শিক্ষিত জনের
প্রবল আগ্ৰহ জন্মিয়াছে, তাহার ফলে এই বিদ্যার বুলি সর্বত্র শোনা যাইতেছে। Psychological
moment কথাটি বহুদিন হইতে সংবাদপত্র ও বক্তৃতার অপরিহার্য
বুকনি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সম্প্রতি আর একটি শব্দ চলিতেছে-complex । অমুক লোক ভীরু বা অন্যের অনুগত, অতএব তাহার inferiority
complex আছে। অমুক লোক সাঁতার দিতে ভালবাসে, অতএব তাহার
water complex আছে। বিজ্ঞানীর দুর্ভাগ্য—তিনি মাথা ঘামাইয়া যে পরিভাষা রচনা করেন। সাধারণে তাহা কড়িয়া
লইয়া অপপ্রয়োগ করে, এবং অবশেষে একটা বিকৃত কদৰ্থ প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া বিজ্ঞানীকে
স্বাধিকারচ্যুত করে।
সূত্র : প্রবন্ধাবলী রাজশেখর বসু (সম্পাদনা- দীপংকর বসু)
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেই, ওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন