১৯৭১ সাল। মাসটা মনে নেই। মনে থাকার কথা নয়,
কেননা তখন মাসের হিসেবে জীবন গণনা করা হতো না। প্রতি মুহুর্তে আলদা
করে বাঁচতে হতো। একটানা এক মাস দু’মাস বেঁচে থাকার কল্পনা কারো মনে উদয় হতো না। সে ছিল এক অদ্ভূত অভূতপূর্ব
আশ্চর্য বাঁচা, পরবতী মূহুতে কি ঘটবে জানা নেই, অথচ বেঁচে আছি, মুহুর্ত মুহুর্ত
করে মাসও কেঁটে যাচ্ছে, কিন্তু মুহুর্তের বাইরে
যে বিস্তৃত দিগন্ত রয়েছে সেখানে দৃষ্টি প্রসারিত করা যাচ্ছে না। আশা আকাঙ্ক্ষা অভিলাষ
বলতে কিছু নেই। সের্ফ বেঁচে আছি, ব্যস। আছি ত আছি,
নেই ত নেই। ভবিষ্যৎ নেই, অতএব ভবিষ্যতের
ভাবনাও নেই, পরিকল্পনাও নেই। নির্ভেজাল নিখুঁত অস্তিত্বটুকু নিয়ে বাঁচা!
তবু মানুষে
মানুষে বিভেদ আছে। অনিত্যের মধ্যেও নিত্যের আলো দেখতে পায়। এমনি একজন মানুষ আব্দুল হামিদ মাস্টার। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের
পাশে এক স্থানে বাড়ী। গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। কিছু জমিজামাও আছে! মোটামুটি ভাল অবস্থা। ম্যাট্রিক জি. টি.
পাস করে মাস্টার নিযুক্ত হওয়ার পরপরই পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সাদু মীরের (সম্প্রতি সৈয়দ
লিখতে শুরু করেছিল) ষোড়শী কন্যা মিতালি ওরফে হাজেরার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। চিঠিপত্র বিনিময়ের
মাধ্যমে প্রেম গাঢ় হলে পর বিয়ের প্রস্তাব। সাদু মীর প্রথমে খান্দানের প্রশ্ন তুললেও কিছু নগদ টাকার বিনিময়ে
কন্যাকে হামিদ মাস্টারের হাতে তুলে দেয়। সে আজ প্রায় দশ বৎসরের কথা। ইতিমধ্যে প্রেমের ফলশ্রুতিরূপে কয়েকটি পুত্রকন্যা
তারা পেয়েছে। প্রথম সন্তান সান্তু ওরফে আব্দুল আজিজ। সান্তুর আদরের অন্ত নেই, অপর দিকে সাস্তুরও দুষ্টুমির শেষ নাই। সে ঢাক বাজাতে জানে না কিন্তু খালে বিলে ছিপ ফেলে, মাঠে ঘুড়ি ওড়ায়, আম জাম পেয়ারা
গাছের আগায় চড়ে পাকা ফল খায় এবং নারকেল গাছের চূড়া থেকে ডাব পেড়ে নিয়ে আসে। বাপ-মা উভয়ের মতে
সাস্তুকে নিয়ে আর পারা যায় না। কিন্তু পারা যায় না বললেও তাকে দমন মানে মারপিট করার কথা তারা
ভাবতে পারে না, কেননা দুষ্টুমি ছাড়া সাস্তুকে কল্পনা করা
যায় না! বনবাদাড় ঘুরে এক হাঁটু ময়লা নিয়ে যদি সান্তু না ফেরে তবে তার মা কার পা
মেজেঘষে সাফ করবে! সান্তু যদি খালে বিলে মাছ ধরতে গিয়ে কোমর অবধি কাদা মেখেই না আসে
তাহলে তার মা মিতালি এবং বাবা হামিদ মাস্টার দুয়ে মিলে সাবান সোডা মাখিয়ে কাকে গোসল
করবে। শীতের দিন পাক সহজে
সাফ হয় না। সাবান সোডা ছাড়াও আরো কঠিন বস্তু ব্যবহার করতে হয়। এক মুঠো খড় ভিজিয়ে মা মিতালি সাস্তুর হাত
পায়ে পিঠে ঘষে এবং বাবা হামিদ মাস্টার বদনার নল দিয়ে ধীরে ধীরে পানি ঢালে। সহসা সান্তু যদি শান্ত
ছেলেটি হয়ে শুধু ঘর আর স্কুল করে এবং অবসর সময়টা ঘুমিয়ে কাটায় তাহলে মিতালি এবং
হামিদ মাস্টার কি নিয়ে বাঁচবে। স্বামী স্ত্রীতে কথাবার্তা বলা বিশেষ করে ষোল আনা একমত হওয়ার
উপযুক্ত কোন বিষয়বস্তুই যে থাকবে না। মাঝে মাঝে অবশ্য উত্ত্যক্ত পাড়াপড়শীরা নালিশ করে। ফলমূল নষ্ট করার জন্য
কেউ তেড়ে আসে না, তেড়ে আসে যখন সান্তুর ছোঁড়া ঢিলে অথবা লাঠির
আঘাতে ওদের মুকুটআলা লাল মোরগ জখমী হয় অথবা ডিম-ভরা হাঁস ধড়ফড়াতে ধড়ফড়াতে প্রাণ
ত্যাগ করে। হামিদ মাস্টার এবং মিতালি খুবই বিব্রত হয়। তারা জানে সাস্তুরই কাজ, তবু পুত্রের অপরাধ লঘু করার চেষ্টায় বলে, ছেলেমানুষ ওরকম করেই থাকে। অনেকে মিলেই হয়ত করেছে, দোষটা ওর ওপর চাপিয়ে বাকিরা সরে পড়েছে—সাস্তুটা বোকা কিনা তাই। হামিদ মাস্টার উদ্যত চড়টা পুত্রের গালের
কাছে নিয়েও মারতে পারে না, এমন নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক
শিশুমুখ এর আগে সে কখনও দেখেনি। সান্তু সত্য সত্যই বড় সুন্দর, তার মা'র চেয়েও উজ্জ্বল রং। কোনদিন কথাটা সোচ্চারেই
বলে ফেলে স্ত্রীর সমুখে। মিতালি ধমক দিয়ে বলে, ছি! কথার শ্রী দেখ। তুমি না বাপ। ষাট! ষাট! মিতালি সাস্তুর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। অবশ্য মিতালিও কখনও কখনও আতালঝাতাল করে,
বিশেষ করে রান্নার সময় সান্তু যখন সহসা পশ্চাৎ দিক থেকে মার
গলা জড়িয়ে ধরে পিঠে চড়ে বসে তখন।
তবে বাপ মা সাস্তুকে রোজ সাবধান করে দিতেও কসুর করে না। খালে বিলে নামতে নেই, সাপ থাকে, সিং মাছ কাঁটা বিধিয়ে দিতে পারে, আশ্বিন কার্তিক মাসের পানিতে জ্বর হতে পারে, মরা ডাল ভেঙে কিংবা পা ফসকে গাছ থেকে পড়লে সর্বনাশ হতে পারে, অতএব সাস্তুর উচিত দুষ্টুমি বন্ধ করা।
কিন্তু এসব
উপদেশ সাস্তুর উপর ক্রিয়া করে না। সে তার মত জীবনের ফানুস উড়িয়ে চলে।
এত দুষ্টুমি
সত্ত্বেও সান্তু ক্লাসে খারাপ করে না।
সে বরাবর ফাস্ট
হয় এবং পরীক্ষার ফল ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে বাড়ী ফিরে মার গলায় ঝুলে নিজের
কৃতিত্বের সংবাদ দিয়ে দাবি করে : আমার প্রাইজ।
মা মিতালি পুত্রের
দু’গাল চুমোয় চুমোয় ভিজিয়ে দিয়ে বলে : প্রাইজ! কি প্রাইজ বাপ?
বাঁশী মা,
ঐ যে পল্টনের লোকেরা বাজায় সেই বাঁশী। বাঁশের বাঁশীর মতো লম্বা— তেমনি মুখ, ফুঁকতেও হয় তেমনি,
উপরে রুপোর কাজ, নীচে তামাকের
বড় কলকের উপরটার মতো।
ক্লারিওনেট?
ক্লারিওনেট!
ঐটার নাম এত বড় মা? হ্যাঁ মা, ঐরকম একটা কিনে দাও।
ওটা ত বাবা
ইংরেজী বাজনা। বাজাতে পারবে ?
পারব মা।
বিষ্ণুৎবারের
বারবেলায় কোন অসুখবিসুখ নাকি হতে নেই, খুব ভোগায়,
এমন কি...। অথচ বিযুৎবার দিন বিকেলে কিনা সান্তু পেয়ারা গাছের শুকনো মটকা
ডাল ভেঙে পড়ল, এবং পড়বি ত পড় সরাসরি নিচে না পড়ে পোতা
একটা চোখা কঞ্চি ঘেঁষে পড়ল, এমন ঘেঁষে পড়ল যে
গায়ের চামড়া ত কিছুটা গেলোই এমনকি আর একটু হলে কোন-না-কোন জায়গা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে
যেতো। কিন্তু তাই বলে আঘাতটা
নিতান্ত কমও নয়, ডান চোখের কোণ ঘেঁষে জিংলার চোখা আগাটা ঢুকে
পড়েছে। টেনে খুলতে হলো। সে কি সাংঘাতিক রক্তপাত। মিতালি ফিট। গাঁয়ে ডাক্তার নেই। এক নরসুন্দর যুবক কিছুদিন থানার দাতব্য চিকিৎসালয়ে কম্পাউণ্ডারের
সহকারীরূপে কাজ করে সুঁই প্রবেশ করানো, মিকচার বানানো,
বেণ্ডেজ বাঁধা ইত্যাদি কাজ শিখেছিল। তারপর হতেই সে গ্রামের সবচেয়ে কোয়ালিফাইড
ডাক্তার। তাকে কল দিলে সে তুলায় কিঞ্চিৎ ডেটল মেখে বেণ্ডেজ বেঁধে দিয়ে বললো : মাস্টার
সাব, চোখ হেন ধন নেই। কিছু বলা যায় না, আপনি ওকে ঢাকায়
নিয়ে যান, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল আছে, এমনিতেও প্রাইভেট ডাক্তার আছে।
মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতাল! ঢাকায়! দিন ভালো যাচ্ছে না, ওরা নাকি অনেক
ডাক্তারও মেরে ফেলেছে। ঢাকা না কি খুবই গরম। বাঙালী দেখলেই নাকি পাঞ্জাবীরা পাখির মতো গুলী করে মারে?
মিতালি স্বামীর কান ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে।
আরে দুর! কি
যে কও মিতালি! ও সব গুজব, তিলকে তাল করে বলা। গোলমাল থেমে গেছে। খবরের কাগজ পর্যন্ত
বেরোচ্ছে। কাল বাজারে এক জনের হাতে একটা দেখলাম।
লোকটা কি ঢাকা
থেকে এসেছে নাকি ?
হ্যাঁ,
মিতালি। তার কাছে সব হালহকীকত জানলাম। রীতিমত ভিড় জমে গিয়েছিল। সে বললো মিলিটারির
রাগ হিন্দুর প্রতি। মুসলমানদের নাকি এখন আর কিছু বলে না, প্রথম এক দফা
যা মেরেছে, মেরেছে।
লোকটার সঙ্গে
কোন মিলিটারির দেখা হয়েছিল নাকি ?
অত শত কথা জিজ্ঞাসা
করিনি মিতালি। ঢাকায় গিয়েছিল ফিরে এসেছে এটা ত ঠিক। সেদিন প্লেনে বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে গেলো : মুসলমানের কোন ভয় নেই। জামাতে ইসলামী পার্টির
লোকেরাও ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের এক মৌলভী সাহেব বললেন, মুসলমানের ভালাইর জন্যই নাকি পাঞ্জাবীরা কাফের মারছে। যে সকল মুসলমান মারা গেছে তারা নাকি প্রকৃত মুসলমান নয়, কাফির।
কিন্তু যাই বলে আমার মনটা যেন কেমন কেমন করছে। মন কিছুতেই সায় দিতে চায় না। এদিকে কোথাও কি চোখের ডাক্তার নেই?
চোখের ডাক্তার! কি যে বলো মিতালি! এল. এম. এফ. পাস করা একজন ডাক্তার পর্যন্ত নেই। চোখ অবহেলার বস্তু নয় মিতালি, ওকে নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে।
মিতালি অগত্যা চুপ করে থাকে, কিন্তু তার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে।
তুমি ভেবো না সাস্তুর মা। আমি খাঁটি মুসলমান, রীতিমতো নামাজ রোজা করি। আমাদের কোন অনিষ্ট হবে না ইনশাল্লাহ্। আমার আচকান পাজামা রুমী টুপি বের করে দাও, সাস্তুকে পাজামা-পাঞ্জাবি এবং জরির কাজ করা টুপিটা পরিয়ে দাও।
ডাক্তার কম, অনেকে ফেরে নি, অনেকে আর ইহজগতে ফিরতেও পারবে না। হতাবশিষ্টদের মন মেজাজ ভালো নয়। প্রতি মুহুর্তে জীবনের আশঙ্কা। হামিদ মাস্টারের ভাগ্য ভালো বলতেই হবে, হাসপাতালে চোখের ডাক্তার এক জন পাওয়া যায়। তেমন কিছু মারাত্মক নয়, কিছুদিন ওষুধ ব্যবহার করলেই সেরে যাবে—ডাক্তার বলে।
রাত্রে পরপর কয়েকটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ, তারপর প্রায় সারা রাত গোলাগুলী থ্রি নট থ্রি স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার, বোধ করি দু ইঞ্চি মর্টারও চলে। হামিদ মাস্টার পুত্রকে নিয়ে পুরনো স্টেশনের কাছাকাছি এক সস্তা হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে বাপ বেটা কারো ঘুম হয় না। হামিদ মাস্টার জীবনে কখনও এত কাছাকাছি এত বড় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনে নি, এত গোলাগুলীর শব্দও নয়। হোটেলে লোকের সংখ্যা খুব কম। বেশীর ভাগ শয্যা খালি। তারাও ঘুমোয় না। বলাবলি করে, মুক্তিবাহিনী-পাকবাহিনীর মধ্যে লড়াই লেগেছে, কাল সকালে কি দশা হয় আল্লাহ জানেন। সান্তু আজ অতিশয় শান্ত। সে বারবার বাপের বুকে নিরাপদ আশ্রয় খোজে। হামিদ মাস্টার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে—ঢাকায় আর নয়, তার চেয়ে গ্রাম অনেক ভালো। সাধে কি আর লোকজন শহর ছেড়ে ইণ্ডিয়া চলে গেছে!
মসজিদে আজান হয়, আজান নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। হামিদ মাস্টার হোটেলেই নামাজ আদায় করে। কিঞ্চিৎ বেলা উঠতেই পিতাপুত্র রওয়ানা হয়। আচকান পাজামা রুমী টুপি পরে এসেছিল হামিদ মাস্টার। সেই পোশাকেই ফেরত যাত্রা করে। পুত্র সাস্তুও তার পাজামা পাঞ্জাবি টুপি পরে নেয়।
মোড়ে মোড়ে পাঞ্জাবী সেনা। ট্রাকে মর্টার ফিট করে টহলরত পাঞ্জাবী সেনা। হামিদ মাস্টার পুত্রকে উপদেশ দেয় : বাপ! এদিক ওদিক তাকিয়ে না, আমার হাত ধরে নীচের দিকে চেয়ে হাটো।
হামিদ মাস্টার হাইকোর্ট কার্জন হল ময়মনসিংহ রোডের মোড়ে পৌছে [পৌছয়]। যানবাহন বিরল। সারাটা পথ হয়ত হেঁটেই যেতে হবে। তা হোক, তবু যদি প্রাণে বাঁচা যায়।
মোড়ের প্রতিটি কোণে পাঞ্জাবী মিলিটারী সঙ্গিন-আঁটা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে। মাথায় জালে ঢাকা লোহার হেলমেট। আজরাইল ফেরেস্তাকে কেউ কখনও দেখেনি, ওদের দেখলে মনে হয়, ওরাই বুঝি-বা আজরাইলের চেলা।
হামিদ মাস্টার আড়ে তাকিয়ে চারদিককার এই ভয়াবহ স্তব্ধতা দেখে নেয়, তারপর মাথার টুপিটা চেপে কান অবধি বসিয়ে দেয়। পুত্রের মাথার টুপিটাও এক ফাঁকে টেনে কানপর্যন্ত নামিয়ে দেয়। খাঁটি মুসলমানের টুপি
কান অবধি নামানো থাকবে, তবলিগী জামাতের পরিব্রাজকদের
দেখা অবধি হামিদ মাস্টারের এ রকমের একটা ধারণা জন্মেছিল। সেই মুহুর্তে সঙ্গে আরো একটি ধারণা যোগ হয়,
কান অবধি টুপি মানে অধিক খাঁটি মুসলমান, মানে মিলিটারী-ঘেরা মোড়ে অধিক নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তা অবশ্যই
কাম্য কেননা তাকে যে ওর মধ্য দিয়ে মোড়টা পার হতে হবে।
হামিদ মাস্টার পুত্র
সান্তুর হাত ধরে মোড়টা পাড়ি দিতে উদ্যত হয়। মনে হয় আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিটা তার সমুখে। খাঁ খাঁ করছে মোড়টা। তিন কোণে গাছের ছায়ায়
দণ্ডায়মান উদ্যত-বন্দুক মিলিটারির চোখ। অন্য কোন চোখ নিবদ্ধ নেই মোড়ের প্রতি। সে চোখ কোনমতেই এড়াবার উপায় নেই। তবু তাকে ঐ মোড়টা
পেরোতেই হবে। কারণ এটাই একমাত্র রাস্তা। নিজ ডান হাতে সান্তুর বা হাত ধরে হামিদ মাস্টার মোড়ের উপর পা
ফেলে। এক একটি ধাপ এক একটি
যুগ। যদি আল্লাহ পা দুটোকে
এমন লম্বা করে দিতেন যে একবার ঠাং তুলেই মোড়টার সবটুকু দূরত্ব অতিক্রম করা যেতো তাহলে
কতই না ভালো হতো। তিনি ইচ্ছা করলে এই ভয়াবহ পথটা অতিক্রমকালে ঐ সৈনিকগুলোর চোখ সাময়িকভাবে অন্ধ
করেও দিতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ তা করেন না, সৈনিকেরা ঠিক চেয়ে
আছে এবং দেখছেও । আল্লাহতালার দয়া ছিল তাওরাত ইঞ্জিলের মানুষের প্রতি। সাগর শুকিয়ে দিলেন মুসার লোকের জন্যে। তার হবিব রাসুলুল্লাহ্র
উম্মত হামিদ মাস্টারের জন্যে কি এতটুকু দয়া করতে পারেন না তিনি? হামিদ মাস্টারের মনে হয় বাতাসও যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐটুকু দূরত্ব এক নদীও
নয়, তবু ফুরাতে চায় না, সে যত এগোয় দূরত্ব যেন তত বৃদ্ধি। ঠ্যাং ফেলতে গিয়ে তার দেহ সমুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে, সে যেন অশীতিপর বৃদ্ধ। ছেলেটাকে ডান হাত থেকে বা হাতে নিয়ে ছাতাটাকে
লাঠির মতো ব্যবহার করে সে’পায়ে অতিরিক্ত বল
আনতে চায় : ফেলতে চায় আরো লম্বা লম্বা কদম। কিন্তু কোন কিছুই তাকে জোর দিতে পারে না। মৃদু বাতাস সহসা যেন
ঝড় হয়ে তার গতিরোধ করে, পথ এগোতে চায় না। এয়া আল্লাহ ?
একি মহা মুসীবতে ফেললে তুমি আমাকে ! বলে, আল্লাহর কাছে পানা চাইতে চাইতে পা ফেলে, কিন্তু ওজন কিছুতেই লাঘব হয় না। সহসা ইতিহাসের পাতায় বিধৃত ঔরঙ্গজেবের নববুই
বৎসর বয়সের চিত্রটা তার চোখের সমুখে ভেসে ওঠে। সে কি পয়ত্রিশ বৎসর বয়েসেই ঐ রকম পৃষ্ঠ
ন্যুব্জদেহ হয়ে পড়লো?
দুটি ফর্সামুখ কৈশোরাতিক্রান্ত
পাঞ্জাবী সেনার মধ্যে কথা হয়। একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার নিশানা কেমন?
অপর ব্যক্তি উত্তর
দেয়, উত্তম, চোখে বললে চোখেও লাগাতে পারি।
ঐ লোকটাকে বাদ
দিয়ে ছেলেটার মাথার খুলিতে লাগাতে পারে?
আলবৎ পারি।
বাজি রাখতে
রাজি আছ ?
হ্যাঁ,
জরুর।
কত টাকা ?
দশ টাকা।
এবং এক কার্টুন
কে-টু সিগারেট?
ঠিক আছে তাও
দেবো। কিন্তু খবরদার মাথার
খুলি ছেড়ে যদি ঘাড়ে বা অন্য কোথাও লাগে তাহলে কিন্তু দশ টাকা এবং সিগারেট তোমাকে
দিতে হবে।
দেবো।
তাহলে পরীক্ষা
হোক।
গুড়ুম। পাঞ্জাবী সৈনিকের বন্দুকের
নল ছেড়ে গুলীটা সোঁ করে বেরিয়ে যায়। সাত্ত বাবাগো শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারে না। সে পাকা ফলের ন্যায়
সহসা হামিদ মাস্টারের হাত থেকে খসে পড়ে। আইল্যাণ্ডের গোড়ায় তাজা রক্তের স্রোত বয়ে যায়।
হামিদ মাস্টার শোক
করার সুযোগ পায় না, সঙ্গিন উচিয়ে তেড়ে আসে পাঞ্জাবী দুটো।
ভাগো কাফের! জলদি ভাগো!
হামিদ মাস্টার একবার মৃত পুত্রের দিকে এবং একবার
তার বুক বরাবর করে উদ্যত সঙ্গিন দুটোর দিকে তাকায়। গরু জবাই করার ছুরির চেয়েও ধারালো ঐ সঙ্গিন।
সহসা সে কোথা থেকে
এত বল পায় আল্লাহই জানেন। সে বারো বৎসরের ছেলের ন্যায় বাবাগো বলে চিৎকার করে উর্ধ্বশ্বাসে
দৌড়োতে থাকে। তার আচকানের দুদিককার প্রান্ত পাখির ডানার ন্যায় উড়তে থাকে। রুমী টুপির পশ্চাতের
লেজ দোয়েল পাখির লেজের মতো ওঠানামা করে। তার পাজামায় ঢেউ ওঠে। সে ছাতা বগলে ডাক রানারের ন্যায় দৌড়োয়। পথ যে অনেক দূর!
পাঞ্জাবী
সৈনিক দুটি সাস্তুকে তুলে আইল্যাণ্ডের উপর রেখে দেয় এবং হাসতে হাসতে
যেখানে ছিল সেখানে ফিরে গিয়ে পুনরায় ডিউটির প্রথানুযায়ী ভাবলেশহীন কাষ্ঠপুত্তলিকায়
পরিণত হয়।
পৃথিবীতে নতুন
কিছু ঘটে নি। বন্দুকের গুলীতে একটি বালক মরেছে মাত্র।
পথে হামিদ মাস্টারের
মৃত্যু হয় না। পথে আরো বহু মিলিটারির সমুখে পড়ে সে। তাদের চোখের উপর দিয়ে সে কখনও হাসতে হাসতে কখনও কাঁদতে কাঁদতে
কখনও দৌড়ে কখনও হেঁটে পথ চলছে কিন্তু কেউ তাকে তাক করে গুলী করে নি।
দ্বিতীয় দিন
সূর্যাস্তের কিছু আগে সে স্বগ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু কোথায় গ্রাম। কোথায় তার বাড়ী
! গোয়াল ঘরটাই শুধু দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু লাল বড় গাইটা নেই। সর্বত্র কেবল ছাই আর ছাই। বুড়ী সালেমা পাগলিনী
লাঠি ভর করে ছাইয়ের মধ্যে খৈ কুড়োচ্ছে। প্রচুর খৈ। তবু যত ধান তত খৈ বোধ করি হয় না, কেননা তখনও ধান পুড়ছে এবং ধানপোড়া গন্ধ আসছে।
আমার মিতালি
কোথায়? মিতালি। বল্ বুড়ী আমার মিতালি কৈ? মিতালি, ও মিতালি, মিতালি...ই! এই প্রথম নিৰ্ভয়ে গগনবিদার চিৎকার করে হামিদ মাস্টার।
মিতালিকে মিলিটারীরা
ধরে নিয়ে গেছে। নেবে না? মাগীর গতরখানা কি! পাগলী বুড়ী উত্তর দিয়ে
পুনরায় খৈ কুড়াতে থাকে।