অর্ধাঙ্গী
কোন রোগীর চিকিৎসা করিতে হইলে প্রথমে রোগের অবস্থা জানা আবশ্যক। তাই অবলাজাতির উন্নতির
পথ আবিষ্কার করিবার পূৰ্ব্বে তাহদের অবনতির চিত্র দেখাইতে হয়। আমি 'স্ত্রীজাতির অবনতি' শীর্ষক প্রবন্ধে ভগিনীদিগকে জানাইয়াছি যে, আমাদের একটা রোগ আছে—'দাসত্ব'। সে রোগের কারণ এবং
অবস্থা কতক পরিমাণে ইতঃপূৰ্ব্বে বর্ণনা করা হইয়াছে। এক্ষণে আমরা দেখাইতে চেষ্টা করিব, সেই রোগ হওয়ায় আমাদের সামাজিক অবস্থা কেমন বিকৃত হইয়াছে। ঔষধপথ্যের বিধান স্থানান্তরে
দেওয়া হইবে।
এইখানে গোঁড়া পরদাপ্রিয় ভগ্নীদের অবগতির জন্য দু-একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক
বোধ করি। আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার 'স্ত্রীজাতির অবনতি' প্রবন্ধে পরদাবিদ্বেষ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত
করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন
নাই।
সে প্রবন্ধে প্রায়
সমগ্র নারীজাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাঁহারা পর্দানশীল নহেন বলিয়া কি আমি তাঁহাদিগকে সম্পূর্ণ
উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের (enslaved মনের) আলোচনা করিয়াছি।
কোন একটা নূতন কাজ করিতে গেলে সমাজ প্রথমতঃ
গোলযোগ উপস্থিত করে, এবং পরে সেই নূতন চালচলন সহিয়া লয়, তাহারই দৃষ্টান্তস্বরূপ পাসী মহিলাদের পরিবর্তিত অবস্থার উল্লেখ
করিয়াছি। পূর্বে তাঁহারা ছত্র ব্যবহারেরও অধিকারিণী ছিলেন না, তারপর তাঁহাদের বাড়াবাড়িটা সীমা লঙ্ঘন করিয়াছে, তবু পৃথিবী ধ্বংস হয় নাই। এখন পারসী মহিলাদের পরদামোচন হইয়াছে সত্য, কিন্তু মানসিক দাসত্ব মোচন হইয়াছে কি? অবশ্যই হয় নাই। আর ঐ যে পরদা ছাড়িয়াছেন, তাহা দ্বারা তাঁহাদের
স্বকীয় বুদ্ধিবিবেচনার তো কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। পারসী পুরুষগণ কেবল অন্ধভাবে বিলাতী সভ্যতার অনুকরণ করিতে যাইয়া স্ত্রীদিগকে পরদার বাহিরে আনিয়াছে, ইহাতে অবলাদের জীবনীশক্তির তো কিছু পরিচয় পাওয়া যায় না—তাঁহারা যে জড়পদার্থ, সেই জড়পদার্থই আছেন। পুরুষ যখন তাঁহাদিগকে
অন্তঃপুরে রাখিতেন, তাঁহারা তখন সেইখানে থাকিতেন। আবার পুরুষ যখন তাঁহাদের 'নাকের দড়ি' ধরিয়া টানিয়া তাঁহাদিগকে মাঠে বাহির করিয়াছেন, তখনই তাঁহারা পর্দার বাহির
হইয়াছে। ইহাতে রমণীকুলের বাহাদুরী কি?
ঐরূপ পরদা-বিরোধ কখনই প্রশংসনীয় নহে।
কলম্বস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করিতে কৃতসঙ্কল্প
হন, তখন লোকে তাঁহাকে বাতুল বলে নাই কি? নারী আপন স্বত্ব-স্বামিত্ব বুঝিয়া আপনাকে
নরের ন্যায় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করিতে চাহে, ইহাও বাতুলতা বই আর কি?
পুরুষগণ স্ত্রীজাতির
প্রতি যতটুকু সম্মান প্রদর্শন করেন,
তাহাতে আমরা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হইতে পারি না। লোকে কালী, শীতলা প্রভৃতি
রাক্ষস-প্রকৃতির দেবীকে ভয় করে, পূজা করে,
সত্য। কিন্তু সেইরূপ বাঘিনী, নাগিনী, সিংহী প্রভৃতি 'দেবী' ও কি ভয় ও পূজা লাভ করে না?
তবেই দেখা যায় পূজাটা কে পাইতেছেন,—রমণী কালী, না রাক্ষসী নৃমুণ্ডামালিনী?
নারীকে শিক্ষার
দিবার জন্য গুরুলোকে সীতা দেবীকে আদর্শরূপে দেখাইয়া থাকেন। সীতা অবশ্যই পর্দানশীল ছিলেন না। তিনি রামচন্দ্রের অৰ্দ্ধাঙ্গী, রাণী, প্রণয়িনী এবং
সহচরী। আর রামচন্দ্র প্রেমিক, ধাৰ্ম্মিক—সবই। কিন্তু রাম সীতার প্রতি
যে ব্যবহার করিয়াছেন, তাহাতে প্রকাশ পায় যে, একটি পুতুলের সঙ্গে কোন বালকের যে-সম্বন্ধ, সীতার সঙ্গে
রামের সম্বন্ধও প্রায় সেইরূপ। বালক ইচ্ছা করিলে পুতুলকে প্রাণপণে ভালবাসিতে পারে; পুতুল হারাইলে
বিরহে অধীর হইতে পারে; পুতুলের ভাবনায় অনিদ্রায় রজনী যাপন করিতে পারে; পুতুলটা যে
ব্যক্তি চুরি করিয়াছিল, তাহার প্রতি খড়গহস্ত হইতে পারে; হারানো পুতুল
ফিরিয়া পাইলে আহ্লাদে আটখানা হইতে পারে; আবার বিনা কারণে রাগ করিয়াও পুতুলটা কাদায়
ফেলিয়া দিতে পারে,—কিন্তু পুতুল বালকের কিছুই করিতে পারে না, কারণ হস্তপদ
থাকা সত্ত্বেও পুত্তলিকা অচেতন পদার্থ। বালক তাহার পুতুল স্বেচ্ছায় অনলে উৎসর্গ করিতে পারে, পুতুল পুড়িয়া
গেল দেখিয়া ভূমে লুটাইয়া ধূলি-ধূসরিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে পারে!!
রামচন্দ্র "স্বামিত্বের" ষোল আনা পরিচয় দিয়াছেন!! আর সীতা?—কেবল প্রভু
রামের সহিত বনযাত্রার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, তাহারও ইচ্ছা
প্রকাশের শক্তি আছে। রাম বেচারা অবোধ বালক, সীতার অনুভব শক্তি আছে, ইহা তিনি বুঝিতে চাহেন নাই, কেন না, বুঝিয়া কাৰ্য্য
করিতে গেলে স্বামিত্বটা পূর্ণমাত্রায় খাটানো যাইত না! —সীতার অমন পবিত্র হৃদয়খানি অবিশ্বাসের পদাঘাত দলিত ও চূর্ণ করিতে পারা যাইত না!
আচ্ছা, দেশ কালের নিয়মানুসারে কবির ভাষায় স্বর মিলাইয়া নাহয় মানিয়া লই যে, আমরা স্বামীর দাসী নহি—অৰ্দ্ধাঙ্গী। আমরা তাঁহাদের গৃহে গৃহিণী, মরণে (না হয়, অন্ততঃ তাঁহাদের চাকুরী উপলক্ষে যথাতথা) অনুগামিনী, সুখদুঃখে সমভাগিনী, ছায়াতুল্য সহচরী ইত্যাদি। কিন্তু কলিযুগে আমাদের ন্যায় অৰ্দ্ধাঙ্গ লইয়া পুরুষগণ কিরূপ বিকলাঙ্গ হইয়াছেন, তাহা কি কেহ একটু চিন্তাচক্ষে দেখিয়াছেন? আক্ষেপের (অথবা 'প্ৰভু'দের সৌভাগ্যের) বিষয় যে, আমি চিত্রকর নহি—নতুবা এই নারীরূপ অৰ্দ্ধাঙ্গ তাঁহাদের কেমন অপরূপ মূৰ্ত্তি হইয়াছি, তাহা আঁকিয়া দেখাইতাম।
শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়—ঐ শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরাজী ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিণী ('partner') উত্তমার্ধ ('better half') ইত্যাদি বলে। জীবনের কৰ্ত্তব্য অতি গুরুতর, সহজ নহে—
'সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার
সুশৃঙ্খল কে পারে চালাতে?
রাজ্যশাসনের রীতিনীতি
সূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।'
বোধ হয় এই গার্হস্থ্য ব্যাপারটাকে মস্তকস্বরূপ কল্পনা করিয়া শাস্ত্রকারগণ পতি ও পত্নীকে তাহার অঙ্গস্বরূপ বলিয়াছেন। তবে দেখা যাউক বৰ্ত্তমান যুগে সমাজের মূৰ্ত্তিটা কেমন।
আচ্ছা, দেশ কালের নিয়মানুসারে কবির ভাষায় স্বর মিলাইয়া নাহয় মানিয়া লই যে, আমরা স্বামীর দাসী নহি—অৰ্দ্ধাঙ্গী। আমরা তাঁহাদের গৃহে গৃহিণী, মরণে (না হয়, অন্ততঃ তাঁহাদের চাকুরী উপলক্ষে যথাতথা) অনুগামিনী, সুখদুঃখে সমভাগিনী, ছায়াতুল্য সহচরী ইত্যাদি। কিন্তু কলিযুগে আমাদের ন্যায় অৰ্দ্ধাঙ্গ লইয়া পুরুষগণ কিরূপ বিকলাঙ্গ হইয়াছেন, তাহা কি কেহ একটু চিন্তাচক্ষে দেখিয়াছেন? আক্ষেপের (অথবা 'প্ৰভু'দের সৌভাগ্যের) বিষয় যে, আমি চিত্রকর নহি—নতুবা এই নারীরূপ অৰ্দ্ধাঙ্গ তাঁহাদের কেমন অপরূপ মূৰ্ত্তি হইয়াছি, তাহা আঁকিয়া দেখাইতাম।
শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়—ঐ শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরাজী ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিণী ('partner') উত্তমার্ধ ('better half') ইত্যাদি বলে। জীবনের কৰ্ত্তব্য অতি গুরুতর, সহজ নহে—
'সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার
সুশৃঙ্খল কে পারে চালাতে?
রাজ্যশাসনের রীতিনীতি
সূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।'
বোধ হয় এই গার্হস্থ্য ব্যাপারটাকে মস্তকস্বরূপ কল্পনা করিয়া শাস্ত্রকারগণ পতি ও পত্নীকে তাহার অঙ্গস্বরূপ বলিয়াছেন। তবে দেখা যাউক বৰ্ত্তমান যুগে সমাজের মূৰ্ত্তিটা কেমন।
মনে করুন কোনস্থানে পূর্বদিকে একটি বৃহৎ দর্পণ আছে, যাহাতে আপনি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে পারেন। আপনার দক্ষিণাঙ্গভাগ
পুরুষ এবং বামাঙ্গভাগ স্ত্রী। এই দর্পণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখুন—
আপনার দক্ষিণ বাহু দীর্ঘ (ত্রিশ ইঞ্চি) এবং স্থূল, বামবাহু দৈর্ঘ্যে চব্বিশ ইঞ্চি এবং ক্ষীণ। দক্ষিণ চরণে দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিণ চরণ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিন স্কন্ধ উচ্চতায় পাঁচ ফিট, বাম স্কন্ধ উচ্চতায় চারি ফিট ! (তবেই মাথাটা সোজা থাকিতে পারে না, বাম দিকে ঝুঁকিতে পড়িতেছে! কিন্তু আবার দক্ষিণ কর্ণভারে বিপরীত দিকেও একটু ঝুঁকিয়াছে!) দক্ষিণ কর্ণ হস্তিকর্ণের ন্যায় বৃহৎ, বাম কর্ণ রাসভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ। দেখুন! —ভাল করিয়া দেখুন, আপনার মূৰ্ত্তিটা কেমন! যদি এ মূৰ্ত্তিটা অনেকের মনোমতো না হয়, তবে দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; —সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না।
সমাজের বিধি ব্যবস্থা আমাদিগকে তাঁহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রহিয়াছে; তাঁহাদের সুখদুঃখ একপ্রকার, আমাদের সুখদুঃখ অন্যপ্রকার। এস্থলে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নবদম্পতীর প্রেমালাপ' কবিতার দুই-চারি ছত্র উদ্ধৃত করিতে বাধ্য হইলাম:
বর। কেন সখি কোণে কাঁদিছ বসিয়া?
কনে। পুষি মেনিটিরে ফেলিয়া এসেছি ঘরে।
আপনার দক্ষিণ বাহু দীর্ঘ (ত্রিশ ইঞ্চি) এবং স্থূল, বামবাহু দৈর্ঘ্যে চব্বিশ ইঞ্চি এবং ক্ষীণ। দক্ষিণ চরণে দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিণ চরণ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিন স্কন্ধ উচ্চতায় পাঁচ ফিট, বাম স্কন্ধ উচ্চতায় চারি ফিট ! (তবেই মাথাটা সোজা থাকিতে পারে না, বাম দিকে ঝুঁকিতে পড়িতেছে! কিন্তু আবার দক্ষিণ কর্ণভারে বিপরীত দিকেও একটু ঝুঁকিয়াছে!) দক্ষিণ কর্ণ হস্তিকর্ণের ন্যায় বৃহৎ, বাম কর্ণ রাসভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ। দেখুন! —ভাল করিয়া দেখুন, আপনার মূৰ্ত্তিটা কেমন! যদি এ মূৰ্ত্তিটা অনেকের মনোমতো না হয়, তবে দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; —সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না।
সমাজের বিধি ব্যবস্থা আমাদিগকে তাঁহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রহিয়াছে; তাঁহাদের সুখদুঃখ একপ্রকার, আমাদের সুখদুঃখ অন্যপ্রকার। এস্থলে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নবদম্পতীর প্রেমালাপ' কবিতার দুই-চারি ছত্র উদ্ধৃত করিতে বাধ্য হইলাম:
বর। কেন সখি কোণে কাঁদিছ বসিয়া?
কনে। পুষি মেনিটিরে ফেলিয়া এসেছি ঘরে।
বর। কি করিছ বনে কুঞ্জভবনে?
কনে। খেতেছি বসিয়া টােপা কুল।
বর। জগৎ ছানিয়া, কী দিব আনিয়া জীবন করি ক্ষয়?
তোমা তবে সখি, বল করিব কী?
কনে। আরো কূল পাড় গোটা ছয়।
বর। বিরহের বেলা কেমনে কাটিবে?
কনে। দেব পুতুলের বিয়ে।
সুতরাং দেখা যায় কন্যাকে এরূপ শিক্ষা দেওয়া হয় না, যাহাতে সে স্বীকার ছায়াতুল্য সহচরী হইতে পারে। প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর 'বোধোদয়' পর্যন্ত।
স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূৰ্য্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহনক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতের বিচরণ করেন, সূৰ্য্যমণ্ডলের ঘনফল তুলাদণ্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনীর গতি নির্ণয় করেন। বলি জ্যোতিবেত্তা মহাশয়, আপনার পার্শ্বে আপনার সহধৰ্ম্মিনী কই? বোধহয়, গৃহিণী যদি আপনার সঙ্গে সূৰ্য্যমণ্ডলে যান, তবে তথায় পঁহুছিবার পূৰ্ব্বেই পথিমধ্যে উত্তাপে বাস্পীভূত হইয়া যাইবেন! তবে সেখানে গৃহিণীর না যাওয়াই ভাল!
অনেকে বলেন, স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নাই। মেয়ে চৰ্ব্ব্য, চোষ্য রাঁধিতে পারে, বিবিধ প্রকার সেলাই করিতে পারে, দুই-চারিখানা উপন্যাস পাঠ করিতে পারে, ইহাই যথেষ্ট। আর বেশী আবশ্যক নাই। কিন্তু ডাক্তার বলেন যে আবশ্যক আছে। যেহেতু মাতার দোষ গুণ লইয়া পুত্রগণ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়। এইজন্য দেখা যায় যে, আমাদের দেশের অনেক বালক শিক্ষকের বেত্রতাড়নায় কণ্ঠস্থ বিদ্যার জোরে এফ, এ, বি, এ, পাশ হয় বটে; কিন্তু বালকের মনটা তাহার মাতার সহিত রান্নাঘরেই ঘুরিতে থাকে! তাহাদের বিদ্যা পরীক্ষায় এ-কথার সত্যতার উপলব্ধি হইতে পারে।*
আমার জনৈক বন্ধু তাঁহার ছাত্রকে উত্তর-দক্ষিণ প্রভৃতি দিঙ্নির্ণয়ের কথা (cardinal points) বুঝাইতেছিলেন। শেষে তিনি প্রশ্ন করিলেন, “যদি তোমার দক্ষিণ হস্ত পশ্চিমে এবং বাম হস্ত পূৰ্ব্বে থাকে, তবে তোমার মুখ কোন দিকে হইবে?” উত্তর পাইলেন “আমার পশ্চাৎ দিকে!”
যাঁহারা কন্যার ব্যায়াম করা অনাবশ্যক মনে করেন, তাঁহারা দৌহিত্রকে হৃষ্টপুষ্ট 'পাহল-ওয়ান' দেখিতে চাহেন কি না? তাঁহাদের দৌহিত্র ঘুষিটা খাইয়া থাপড়টা মারিতে পারে, এরূপ ইচ্ছা করেন কি না? যদি সেরূপ ইচ্ছা করেন, তবে বোধ হয়, তাঁহারা সুকুমারী গোলাপ-লতিকায় কাঁঠাল ফলাইতে চাহেন!! আর যদি ইচ্ছা করেন যে দৌহিত্রও বলিষ্ঠ না হয়, বরং পয়জার পেটা হইয়া নত মস্তকে উচ্চৈঃস্বরে বলে, 'মাৎ মারো! চোট লাগতা হায়!' এবং পয়জার লাভ শেষ হইলে দূরে গিয়া প্রহারকর্তাকে শাসাইয়া বলে যে, 'কায় মারতা থা? হাম নালিশ করেগা!' তাহা হইলে আমি তাহাদিগকে আমার বক্তব্য বুঝাইতে অক্ষম।
খ্ৰীষ্টিয়ান সমাজে যদিও স্ত্রীশিক্ষার যথেষ্ট সুবিধা আছে, তবু রমণী আপন স্বত্ব ষোলআনা ভোগ করিতে পায় না। তাহাদের মন দাসত্ব হইতে মুক্তি পায় না। স্বামী ও স্ত্রী কতক পরিমাণে জীবনের পথে পাশাপাশি চলিয়া থাকেন বটে; কিন্তু প্রত্যেক উত্তমার্ধই (Better half) তাঁহার অংশীর (partner-এর) জীবনে আপন জীবনে মিলাইয়া তন্ময়ী হইয়া যান না। স্বামী যখন ঋণজালে জড়িত হইয়া ভাবিয়া ভাবিয়া মরমে মরিতেছেন, স্ত্রী তখন একটা নূতন টুপীর (bonnet এর) চিন্তা করিতেছেন। কারণ তাহাকে কেবল মূৰ্ত্তিমতী কবিতা হইতে শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে—তাই তিনি মনোরমা কবিতা সাজিয়া থাকিতে চাহেন। ঋণদায়রূপ গদ্য (prosaic) অবস্থা তিনি বুঝিতে অক্ষম।
এখন মুসলমান সমাজে প্রবেশ করা যাউক। মুসলমানের মতে আমরা পুরুষের 'অৰ্দ্ধেক', অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্য। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা 'আড়াই জন' হই! আপনারা 'মুহম্মদীয় আইনে' দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অৰ্দ্ধেক ভাগ পাইবে। এ নিয়মটি কিন্তু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। যদি আপনারা একটু পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোন ধনবান মুসলমানের সম্পত্তি বিভাগ করা দেখেন, কিম্বা জমীদারী পরিদর্শন করিতে যান, তবে দেখিবেন কাৰ্য্যতঃ কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।
আমি এখন অপার্থিব সম্পত্তির কথা বলিব। পিতার স্নেহ, যত্ন ইত্যাদি অপার্থিব সম্পত্তি। এখানেও পক্ষপাতিতার মাত্রা বেশী। ঐ যত্ন, স্নেহ, হিতৈষিতার অৰ্দ্ধেকই আমরা পাই কই? যিনি পুত্রের সুশিক্ষার জন্য চারিজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন, তিনি কন্যার জন্য দুইজন শিক্ষয়ত্রী নিযুক্ত করেন কি? যেখানে পুত্র তিনটা (বি, এ, পৰ্য্যন্ত) পাশ করে, সেখানে কন্যা দেড়টা পাশ (এন্ট্রাসি পাশ ও এফ, এ, ফেল) করে কি? পুত্রদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা করা যায় না, বালিকাদের বিদ্যালয় সংখ্যায় পাওয়াই যায় না! যে স্থলে ভ্রাতা 'শমস-উল-ওলামা' সে স্থলে ভগিনী 'নজম-উল-ওলামা' হইয়াছেন কি? তাঁহাদের অন্তঃপুরগগণে অসংখ্য 'নজমন্নেসা' 'শমসন্নেসা' শোভা পাইতেছেন বটে, কিন্তু আমরা সাহিত্য-গগনে 'নজম-উল-ওলামা' দেখিতে চাই।
আমাদের জন্য এদেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ : প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কোরাণ শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলির অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টিয়াপাখীর মত আবৃত্তি কর। কোনো পিতার হিতৈষণার মাত্রা বৃদ্ধি হইলে, তিনি দুহিতাকে 'হাফেজ' করিতে চেষ্টা করেন। সমুদয় কোরআনখানি যাঁহার কণ্ঠস্থ থাকে, তিনিই 'হাফেজ'। আমাদের আরবী শিক্ষা ঐ পর্যন্ত। পারস্য এবং উর্দু শিখিতে হইলে, প্রথমেই 'করিমা ববখশা এবরহালে মা' এবং একেবারে (উর্দু) 'বানাতন্ নাশ' পড়া!** একে আকার ইকার নাই, তাতে আবার আর কোনো সহজ পাঠ্যপুস্তক পূৰ্ব্বে পড়া হয় নাই সুতরাং পাঠের গতি দ্রুতগামী হয় না। অনেকের ঐ কয়খানি পুস্তক পাঠ শেষ হওয়ার পূৰ্ব্বেই কন্যা-জীবন শেষ হয়। বিবাহ হইলে বালিকা ভাবে, 'যাহা হোক, পড়া হইতে রক্ষা পাওয়া গেল!' কোনো কোনো বালিকা রন্ধন ও সূচীকৰ্ম্মে সুনিপুণা হয়। বঙ্গদেশের বালিকাদিগকে রীতিমত বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শিখে, কিন্তু কলম ধরিতে শিখে না। ইহাদের উন্নতির চরম সীমা সল্মা চুমকির কারুকার্য, উলের জুতা-মোজা ইত্যাদি প্রস্তুত করিতে শিক্ষা পর্য্যন্ত।
যদি ধৰ্ম্মগুরু মোহাম্মদ (দঃ) আপনাদের হিসাব নিকাশ লয়েন যে, “তোমরা কন্যার
প্রতি কিরূপ ন্যায় ব্যবহার করিয়াছ?” তবে আপনারা কি বলিবেন?
পয়গম্বরদের ইতিহাসে শুনা যায়, জগতে যখনই মানুষ বেশি অত্যাচার অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-একজন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন পালন করিয়াছেন। আরবে স্ত্রী-জাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসিগণ কন্যাহত্যা করিতেছিল তখন হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কন্যাকুলের রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন। তাহাঁর জীবন ফাতেমাময় করিয়া দেখাইয়াছেন—কন্যা কিরূপ আদরণীয়া। সে আদর, সে স্নেহ জগতে অতুল।
আহা! তিনি নাই বলিয়া আমাদের এ দুর্দশা। তবে আইস ভগিনীগণ! আমরা সকলে সমস্বরে বলি:
'করিমা ববখশা এ বরহালে মা' করিম (ঈশ্বর) অবশ্যই কৃপা করিবেন। যেহেতু 'সাধনার সিদ্ধি।' আমরা 'করিমের' অনুগ্রহলাভের জন্য যত্ন করিলে অবশ্যই তাঁহার করুণা লাভ করিব। আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের 'অৰ্দ্ধেক' নহি। তাহা হইলে এইরূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইত—পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস। পুত্রের জন্য যতখানি দুগ্ধ আমদানী হয়, কন্যার জন্য তাহার অৰ্দ্ধেক! সেরূপ ত নিয়ম নাই! আমরা জননীর স্নেহমমতা ভ্রাতার সমানই ভোগ করি। মাতৃহৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই। তবে কেমন করিয়া বলিব, ঈশ্বর পক্ষপাতী? তিনি কি মাতা অপেক্ষা অধিক করুণাময় নহেন?
আমি এবার রন্ধন ও সূচীকাৰ্য সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহাতে আবার যেন কেহ মনে না করেন যে আমি সূচীকৰ্ম্ম ও রন্ধনশিক্ষার বিরোধী। জীবনের প্রধান প্রয়োজনীয় বস্তু অন্নবস্ত্র; সুতরাং রন্ধন ও সেলাই অবশ্য শিক্ষণীয়। কিন্তু তাই বলিয়া জীবনটাকে শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নহে।
পয়গম্বরদের ইতিহাসে শুনা যায়, জগতে যখনই মানুষ বেশি অত্যাচার অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-একজন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন পালন করিয়াছেন। আরবে স্ত্রী-জাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসিগণ কন্যাহত্যা করিতেছিল তখন হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কন্যাকুলের রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন। তাহাঁর জীবন ফাতেমাময় করিয়া দেখাইয়াছেন—কন্যা কিরূপ আদরণীয়া। সে আদর, সে স্নেহ জগতে অতুল।
আহা! তিনি নাই বলিয়া আমাদের এ দুর্দশা। তবে আইস ভগিনীগণ! আমরা সকলে সমস্বরে বলি:
'করিমা ববখশা এ বরহালে মা' করিম (ঈশ্বর) অবশ্যই কৃপা করিবেন। যেহেতু 'সাধনার সিদ্ধি।' আমরা 'করিমের' অনুগ্রহলাভের জন্য যত্ন করিলে অবশ্যই তাঁহার করুণা লাভ করিব। আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের 'অৰ্দ্ধেক' নহি। তাহা হইলে এইরূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইত—পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস। পুত্রের জন্য যতখানি দুগ্ধ আমদানী হয়, কন্যার জন্য তাহার অৰ্দ্ধেক! সেরূপ ত নিয়ম নাই! আমরা জননীর স্নেহমমতা ভ্রাতার সমানই ভোগ করি। মাতৃহৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই। তবে কেমন করিয়া বলিব, ঈশ্বর পক্ষপাতী? তিনি কি মাতা অপেক্ষা অধিক করুণাময় নহেন?
আমি এবার রন্ধন ও সূচীকাৰ্য সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহাতে আবার যেন কেহ মনে না করেন যে আমি সূচীকৰ্ম্ম ও রন্ধনশিক্ষার বিরোধী। জীবনের প্রধান প্রয়োজনীয় বস্তু অন্নবস্ত্র; সুতরাং রন্ধন ও সেলাই অবশ্য শিক্ষণীয়। কিন্তু তাই বলিয়া জীবনটাকে শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নহে।
স্বীকার করি যে, শারীরিক দুৰ্ব্বলতাবশতঃ
নারীজাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে। তাই বলিয়া পুরুষ 'প্ৰভু' হইতে পারে না। কারণ জগতে দেখিতে পাই, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের
নিকট কোন-না-কোন প্রকার সাহায্য প্রার্থনা না করে, যেন একে অপরের সাহায্যে
ব্যতীত চলিতে পারে না। তরুলতা যেমন বৃষ্টির সাহায্য-প্রার্থী, মেঘও সেইরূপ তরুর সাহায্য চায়। জল বৃদ্ধির নিমিত্ত নদী বর্ষার সাহায্য পায়, ... আবার নদীর ঋণী। তবে তরঙ্গিনী কাদম্বিনীর 'স্বামী' না কাদম্বিনী তরঙ্গিনীর 'স্বামী'? এ স্বাভাবিক নিয়মের কথা ছাড়িয়া
কেবল সামাজিক নিয়মে দৃষ্টিপাত করিলেও আমরা তাহাই দেখি।
কেহ সূত্রধর, কেহ তস্তুরায় ইত্যাদি। একজন ব্যারিষ্টার ডাক্তারের সাহায্য-প্রার্থী, আবার ডাক্তারও ব্যারিষ্টারের সাহায্য চাহেন। তবে ডাক্তারকে ব্যারিষ্টারের স্বামী বলিব, না ব্যারিষ্টার ডাক্তারের স্বামী? যদি ইহাদের কেহ কাহাকে 'স্বামী' বলিয়া স্বীকার না করেন, তবে শ্রীমতীগণ জীবনের চিরসঙ্গী শ্রীমানদিগকে 'স্বামী' ভাবিবেন কেন?
আমরা উত্তমার্ধ (better halves) তাঁহারা নিকৃষ্টার্ধ (worse halves), আমরা অৰ্দ্ধাঙ্গী, তাঁহারা অৰ্দ্ধাঙ্গ। অবলার হাতেও সমাজের জীবন মরণের কাঠি আছে, যেহেতু 'না জাগিলে সব ভারত-ললনা' এ ভারত আর জাগিতে পারিবে না। প্রভুদের ভীরুতা কিম্বা তেজস্বিতা জননীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে কেবল শারীরিক বলের দোহাই দিয়া অদূরদর্শী ভ্রাতৃমহোদয়গণ যেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবী না করেন!
আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না-পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমনা সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম না? আশৈশব আত্মনিন্দা শুনিতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি, এবং নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি। অনেক সময় 'হাজার হোক ব্যাটা ছেলে!' বলিয়া ব্যাটা ছেলেদের দোষ ক্ষমা করিয়া অন্যায় প্রশংসা করি। এই ত ভুল। আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি। তাঁহাদের ধৰ্ম্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রিস্টানকে খ্ৰীস্টানি ছাড়িতে হইবে এমন কোন কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।
অনেকে হয়ত ভয় পাইয়াছেন যে, বোধ হয় একটা পত্নীবিদ্রোহের আয়োজন করা হইতেছে। অথবা ললনাগণ দলে দলে উপস্থিত হইয়া বিপক্ষে রাজকীয় কাৰ্য্যক্ষেত্রে হইতে তাড়াইয়া দিয়া সেই পদগুলি অধিকার—শামলা, চোগা, আইন কানুনের পাঁজিপুঁথি লুঠিয়া লইবেন! অথবা সদলবলে দখল করিবেন, হাল গরু কাড়িয়া লইবেন, তবে তাঁহাদের অভয় দিয়া বলিতে হইবে—নিশ্চিন্ত থাকুন।
পুরুষগণ আমাদিগকে সুশিক্ষা হইতে পশ্চাৎপদ রাখিয়াছেন বলিয়া আমরা অকৰ্ম্মণ্য হইয়া গিয়াছি। ভারতে ভিক্ষু ও ধনবান—এই দুই দল লোক অলস; এবং ভদ্রমহিলার দল কৰ্ত্তব্য অপেক্ষা অল্প কাজ করে। আমাদের আরাম-প্রিয়তা খুব বাড়িয়াছে। আমাদের হস্ত, পদ, মন, চক্ষু ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করা হয় না। দশজন রমণীরত্ম একত্র হইলে ইহার উহার বিশেষত আপন আপন অর্ধাঙ্গের নিন্দা কিংবা প্রশংসা করিয়া বাকপটুতা দেখায় আবশ্যক হইলে কোন্দলও চলে।
কেহ সূত্রধর, কেহ তস্তুরায় ইত্যাদি। একজন ব্যারিষ্টার ডাক্তারের সাহায্য-প্রার্থী, আবার ডাক্তারও ব্যারিষ্টারের সাহায্য চাহেন। তবে ডাক্তারকে ব্যারিষ্টারের স্বামী বলিব, না ব্যারিষ্টার ডাক্তারের স্বামী? যদি ইহাদের কেহ কাহাকে 'স্বামী' বলিয়া স্বীকার না করেন, তবে শ্রীমতীগণ জীবনের চিরসঙ্গী শ্রীমানদিগকে 'স্বামী' ভাবিবেন কেন?
আমরা উত্তমার্ধ (better halves) তাঁহারা নিকৃষ্টার্ধ (worse halves), আমরা অৰ্দ্ধাঙ্গী, তাঁহারা অৰ্দ্ধাঙ্গ। অবলার হাতেও সমাজের জীবন মরণের কাঠি আছে, যেহেতু 'না জাগিলে সব ভারত-ললনা' এ ভারত আর জাগিতে পারিবে না। প্রভুদের ভীরুতা কিম্বা তেজস্বিতা জননীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে কেবল শারীরিক বলের দোহাই দিয়া অদূরদর্শী ভ্রাতৃমহোদয়গণ যেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবী না করেন!
আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না-পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমনা সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম না? আশৈশব আত্মনিন্দা শুনিতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি, এবং নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি। অনেক সময় 'হাজার হোক ব্যাটা ছেলে!' বলিয়া ব্যাটা ছেলেদের দোষ ক্ষমা করিয়া অন্যায় প্রশংসা করি। এই ত ভুল। আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি। তাঁহাদের ধৰ্ম্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রিস্টানকে খ্ৰীস্টানি ছাড়িতে হইবে এমন কোন কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।
অনেকে হয়ত ভয় পাইয়াছেন যে, বোধ হয় একটা পত্নীবিদ্রোহের আয়োজন করা হইতেছে। অথবা ললনাগণ দলে দলে উপস্থিত হইয়া বিপক্ষে রাজকীয় কাৰ্য্যক্ষেত্রে হইতে তাড়াইয়া দিয়া সেই পদগুলি অধিকার—শামলা, চোগা, আইন কানুনের পাঁজিপুঁথি লুঠিয়া লইবেন! অথবা সদলবলে দখল করিবেন, হাল গরু কাড়িয়া লইবেন, তবে তাঁহাদের অভয় দিয়া বলিতে হইবে—নিশ্চিন্ত থাকুন।
পুরুষগণ আমাদিগকে সুশিক্ষা হইতে পশ্চাৎপদ রাখিয়াছেন বলিয়া আমরা অকৰ্ম্মণ্য হইয়া গিয়াছি। ভারতে ভিক্ষু ও ধনবান—এই দুই দল লোক অলস; এবং ভদ্রমহিলার দল কৰ্ত্তব্য অপেক্ষা অল্প কাজ করে। আমাদের আরাম-প্রিয়তা খুব বাড়িয়াছে। আমাদের হস্ত, পদ, মন, চক্ষু ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করা হয় না। দশজন রমণীরত্ম একত্র হইলে ইহার উহার বিশেষত আপন আপন অর্ধাঙ্গের নিন্দা কিংবা প্রশংসা করিয়া বাকপটুতা দেখায় আবশ্যক হইলে কোন্দলও চলে।
আশা করি এখন 'স্বামী' স্থলে 'অর্ধাঙ্গ' শব্দ প্রচলিত হইবে।
নবনূর, আশ্বিন ১৩১১
নবনূর, আশ্বিন ১৩১১
________________
গত ১৩১০ সালে 'নিরীহ বাঙালি' লিখিত হইয়াছে। সুখের বিষয়, বর্তমান সালে আর বাঙালি 'পুরুষিকা' নহেন। এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে এমন শুভ পরিবর্তন হইবে, ইহা কে জানিতো জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ, এখন আমরা সাহসী বাঙালি।
--------------------
'দাসী' পত্রিকা হইতে কতকগুলি প্রশ্নোত্তর উদ্ধৃত করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিতেছি না—
প্রশ্ন. When was Cromwell born (ক্রম ওয়েলের জন্ম কখন হইয়াছিল?)
উত্তর. In the year 1649 when he was fourteen years old (১৬৪৯ সালে যখন তিনি চৌদ্দ বৎসরের ছিলেন)
প্রশ্ন. Describe his continental policy (তাঁহার রাষ্ট্রীয় নীতি বর্ণনা কর)।
উত্তর. He was honest and truthful and he had nine children (তিনি সাধু প্রকৃতি এবং সত্যবাদী ছিলেন এবং তাহার নয়জন সন্তানসন্ততি ছিল)।
প্রশ্ন. What is the adjective of ass (গর্দভের বিশেষণ কী)?
উত্তর. Assansole (আসানসোল)
প্রশ্ন. Who was Chandra Gupta (চন্দ্রগুপ্ত কে)?
উত্তর. Chandra Gupta was the granddaughter of Asoka (চন্দ্রগুপ্ত অশোকের দৌহিত্রী)।
'পরীক্ষারহস্য। কলা ঝলসাইতে লাগিল’ ইহার ইংরাজী অনুবাদ করিতে বলা হইয়াছিল। একজন ছাত্র লিখিয়াছেন,, ‘roasted some plantations’ অপর একজন লিখিয়াছেন, ‘roasted some plantagenets' অপর একজন লিখিয়াছেন, 'roasted some plaintiffs' কেহ মনে করিবেন না যে, ইহা কল্পিতউত্তর। সত্য সত্যই এরূপ উত্তর পাওয়া গিয়াছে।'
--------------------
'শমস-উল-ওলামা', পণ্ডিতদের উপাধি বিশেষ। ঐ শব্দগুলি অনুবাদ এইরূপ হয়: -শমস--Sun; ওলামা, ('আলম' শব্দের বহুবচন) learned men. এইরূপ নজম-উল-ওলামা অর্থে the 'star' of the learned men (বা women) বুঝিতে হইবে।
--------------------
স্থলে জনৈক নারীহিতৈষী মহাত্মার উর্দু গাথা মনে পড়িল। তিনি (১৯০৫ খৃস্টাব্দের কোন মাসিক পত্রিকায়) লিখিয়াছেন: 'জগতে তোমাদের নিন্দাগীতি এতদূর উচ্চরাগে গাওয়া গিয়াছে যে শেষে তোমরা ও জগতের কথায় বিশ্বাস করিয়া ভাবিলে যে. 'আমরা বাস্তবিক বিদ্যালাভের উপযুক্ত নহি।' সুতরাং মূর্খতার কুফল ভোগের নিমিত্ত তোমরা নত মস্তকে প্রস্তুত হইলে।' কি চমৎকার সত্য কথা। জগদীশ্বর উক্ত কবিকে দীর্ঘজীবী করুন!
সূত্র : রোকেয়া রচনাবলী - আবদুল কাদের সম্পাদিত
উত্তর. Chandra Gupta was the granddaughter of Asoka (চন্দ্রগুপ্ত অশোকের দৌহিত্রী)।
'পরীক্ষারহস্য। কলা ঝলসাইতে লাগিল’ ইহার ইংরাজী অনুবাদ করিতে বলা হইয়াছিল। একজন ছাত্র লিখিয়াছেন,, ‘roasted some plantations’ অপর একজন লিখিয়াছেন, ‘roasted some plantagenets' অপর একজন লিখিয়াছেন, 'roasted some plaintiffs' কেহ মনে করিবেন না যে, ইহা কল্পিতউত্তর। সত্য সত্যই এরূপ উত্তর পাওয়া গিয়াছে।'
--------------------
'শমস-উল-ওলামা', পণ্ডিতদের উপাধি বিশেষ। ঐ শব্দগুলি অনুবাদ এইরূপ হয়: -শমস--Sun; ওলামা, ('আলম' শব্দের বহুবচন) learned men. এইরূপ নজম-উল-ওলামা অর্থে the 'star' of the learned men (বা women) বুঝিতে হইবে।
--------------------
স্থলে জনৈক নারীহিতৈষী মহাত্মার উর্দু গাথা মনে পড়িল। তিনি (১৯০৫ খৃস্টাব্দের কোন মাসিক পত্রিকায়) লিখিয়াছেন: 'জগতে তোমাদের নিন্দাগীতি এতদূর উচ্চরাগে গাওয়া গিয়াছে যে শেষে তোমরা ও জগতের কথায় বিশ্বাস করিয়া ভাবিলে যে. 'আমরা বাস্তবিক বিদ্যালাভের উপযুক্ত নহি।' সুতরাং মূর্খতার কুফল ভোগের নিমিত্ত তোমরা নত মস্তকে প্রস্তুত হইলে।' কি চমৎকার সত্য কথা। জগদীশ্বর উক্ত কবিকে দীর্ঘজীবী করুন!
সূত্র : রোকেয়া রচনাবলী - আবদুল কাদের সম্পাদিত