:::: সূচীপত্র ::::
আবু ইসহাক
(১৯২৬- ২০০৩)
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের এক অনন্যনাম আবু ইসহাক। মাত্র তিনটি উপন্যাস, দু’টি গল্প গ্রন্থ আর একটি করে নাটক ও স্মৃতিকথা, এত অল্প লিখেই তাঁর একটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত বিভাগে নাম লিখিয়ে রেখেছে স্বর্ণাক্ষরে। তাঁকে যদি শুধু কথাসাহিত্যিক বলা হয়, কিছুটা ভুল হবে, কারণ বিশিষ্ট অভিধান (সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান-২ খণ্ড ) প্রণেতার অভিধাও তাঁর প্রাপ্য। বাংলা সাহিত্যে যাঁরা কম লিখে অসাধারণ, তাঁদেরই একজন তিনি।
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘নবযুগ’-পত্রিকায় আবু ইসহাকের মাত্র ১৪ বছর বয়সে নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন ‘অভিশাপ’ নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। পরে কলিকাতার সওগাত, আজাদ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর বিভিন্ন রচনা প্রকাশিত হয়।
১৯৪২-১৯৪৮ সালের মধ্যে পরপর বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগ বড় চারটি ঐতিহাসিক ঘটনার পটভূমিতে তাঁর প্রথম দিককার রচনাগুলোতে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠে। মাত্র ২০ বছর বয়সে লেখা প্রথম উপন্যাস 'সূর্যদীঘল বাড়ী' উপন্যাসের এই ঐতিহাসিক চার ঘটনার সম্মিলন আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই।

দীর্ঘ চার বছর ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮ সাল ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’-র রচনাকাল। উপন্যাসটি প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় লেখক ভীষণ মনোকষ্টে ভোগেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এটি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় গোলাম মোস্তফা সম্পাদিত 'নওবাহার' নামক মাসিক পত্রিকায়। উপন্যাসটি প্রথমে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় রচনার সাত বছর পর ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে এবং পরে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। প্রকাশের পর ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় এর আলোচনা বের হয়। ফলে এটি সহজেই সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং নানা মহলে এটি আলোড়ন সৃষ্টি করে।
গ্রন্থ‍সমূহ :
উপন্যাস :
সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৫৫) [চলচ্চিত্ররূপ - ১৯৭৯]
পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬, সামাজিক উপন্যাস)
জাল (১৯৮৮, গোয়েন্দা উপন্যাস)
গল্প :
হারেম (১৯৬২)
মহাপতঙ্গ (১৯৬৩)
নাটক :
একমাত্র নাটক জয়ধ্বনি [২০০১ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী গ্রন্থকারে প্রকাশ করে ]
স্মৃতিচারণমূলক রচনা :
স্মৃতিবিচিত্রা [২০০১]
অভিধান প্রণেতা হিসেবেও আবু ইসহাকের একটি বিশিষ্ট পরিচয় আছে। তিনি ‘সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান’ (২ খন্ড, ১৯৯৩, ১৯৯৮) রচনা করে বাংলা কোষগ্রন্থের পরিধিকে বাড়িয়ে তুলেছেন। ১৯৯৩ সালে স্বরবর্ণ অংশ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়, পরে ১৯৯৮ সালে ব্যঞ্জন বর্ণ 'ক' থেকে 'ঞ' পর্যন্ত অংশ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ।
তিনি 'ডিকশনারি অব ক্যুটেড অ্যান্ড ওয়েডেড ওয়ার্ডস' নামে একই ধরনের একটি ইংরেজি অভিধানের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছিলেন ।
‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র যার নামও ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ (১৯৮০) সালের ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসব, জার্মানিতে অংশগ্রহণ করে এবং তিনটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
বিজয়ী ফিল্ম ডুকাট্ পুরস্কার
বিজয়ী ক্যাথটিক জুরি পুরস্কার
বিজয়ী এভান্গেলিক্যাল জুরি পুরস্কার
সূর্য দীঘল বাড়ী ছবিটি ফিগুএরা দা ফোজ চলচ্চিত্র উত্সব (১৯৮০), পর্তুগাল এ একটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
বিজয়ী ডন কিজোট পুরস্কার
“আবু ইসহাসকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ (১৯৫৫), একটি সফলকাম উপন্যাস। দুসান জাভাবিতেল কর্তৃক চেক ভাষায় অনূদিত হয়ে গ্রন্থটি পাশ্চাত্যের সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গ্রামের সাধারণ দৈন্য ও হতাশার পরিপ্রেক্ষিতে লেখক একটি প্রাণবন্ত কাহিনী নির্মাণ করেছেন। চাষী জীবনের অর্থনৈতিক সংকট, কুসংস্কার, নিস্প্রাণ আচার ও সমাজের উৎপীড়ন এ উপন্যাসে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে। গ্রাম-বাংলার এক অসহায় মাতা ও সন্তানের জীবন-কাহিনী হিসেবে সূর্য-দীঘল বাড়ী অত্যন্ত মর্মস্পর্শী।” (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত - মুহম্মদ আবদুল হাই, সৈয়দ আলী আহসান - পৃ. ৩৩৫ )
এই উপন্যাস সম্পর্কে হাসান আজিজুল হকের উক্তি :
“হৃদয়দ্রাবী কাহিনী শীর্ণ তর্জনী তুলে আমাদের গ্রাম-সমাজের গলিত, ধ্বসে-পড়া, বিবর্ণ, দুর্ভিক্ষলাঞ্ছিত, কুসংস্কারশাসিত চেহারার দিকে ক্রমাগত ইঙ্গিত করতে থাকে।”
(কথা সাহিত্যের কথকতা- হাসান আজিজুল হক পৃ.১৯)
আবু ইসহাক-এর দু’টি বিখ্যাত গল্প সম্পর্কে বশীল আলহেলাল এর মূল্যায়ণ :
“পল্লীবাংলার প্রাণকে তিনি উদ্‌ঘাটন করেছেন। আমাদের সমাজে প্রাচীন ও প্রাগ্রসর জীবনের, উঠতি নাগরিকতার ও সেকেলে গ্রাম্যতার এবং সেই সঙ্গে ধন ও নির্ধনতার যে দ্বন্দ্ব তা তিনি চিত্রিত করেছেন। কেবল তাই নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ, অত্যাচার ও অনাচার কাহিনী তিনি লিখেছেন। ‘বিস্ফোরণ’, ‘জোঁক’ ইত্যাদি গল্পে আবু ইসহাক তাঁর জাগ্রত শ্রেণীচেতনার পরিচয় প্রদান করেছেন। এই দুইগল্পে শ্রেণী-সংগ্রামের চিত্র রয়েছে।”
(বশীর আলহেলাল, উত্তরাধিকার, শহীদ দিবস সংখ্যা, ‘৭৪ - পৃ. ৩১৭] )
তাঁর আরও দু’টি গল্প ‘খুতি’ ও ‘মহাপতঙ্গ’ সম্পর্কে আবদুল হক লিখেছেন : “ স্বাধীনতার আমলে নব্য উন্নতশীল ব্যক্তিদের মূল্যবোধ বিবর্জিত উন্নতি লালসা গল্পটির বিষয়বস্তু। এক আচারনিষ্ঠ মূল্যবোধহীন পিতা আর তার নীতিনিষ্ঠ পুত্রের নিপুণ কনট্রাস্ট গল্পটিতে চিত্রিত। আমার মতে ছোটগল্পে ‘মহাপতঙ্গ’ এবং ‘খুতি’ আবু ইসহাকের শ্রেষ্ঠতম রচনা” (আবদুল হক, সমকাল. ৭ম বর্ষ, কার্তিক-অগ্রহায়ন পৃ. ২৭৭)
৫ মে, ২০০১ সালে অলক্ত পুরস্কার অনুষ্ঠানে আবু ইসহাক একটি সংক্ষিপ্ত অথচ চিন্তাকর্ষক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, “পুরস্কার পেলে সবাই খুশি হয়। ব্যতিক্রম তেমন হয় না। বার্নাড শ ব্যতিক্রম ছিলেন। সবাই যেমন খুশি হয় আমিও তেমন খুশি হয়েছি। আমি যা লিখেছি তা খুবই সামান্য। তা যে আপনাদের ভালো লেগেছে তাই আমার সাহিত্যপ্রীতি। আপনারা যে আমাকে পুরস্কৃত করলেন সেজন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের দেশে সাহিত্যিকরা অবহেলিত। বাংলাদেশের কিছু সাহিত্য সংস্থা আছে যারা সাহিত্যিকদের সাহিত্যের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। এসব প্রতিষ্ঠান লেখকদের জন্য কল্যাণকর। আসলে আমি আমার ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র নিচে চাপা পড়ে গেছি। এরপরও আমার উপন্যাস বেরিয়েছে ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’। এ উপন্যাস সম্পর্কে অনেকে জানে না। আপনারা পড়েছেন কি না জানি না। আজকের দিনটি আমার জন্য স্মরণীয়। অলক্ত সংগঠনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আমার ধন্যবাদ জানাই।”