:::: সূচীপত্র ::::
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার
(১৮৩৩-১৮৯৬)
 
প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, সুসাহিত্যিক ও ‘ভারতবর্ষ’-পত্রের প্রথম সম্পাদক জলধর সেন, পণ্ডিত শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব এবং ‘বিষাদসিন্ধু’-রচয়িতা মীর মশাররফ্‌ প্রমুখ বিদ্বজ্জনগণ ছিল তারই সাহিত্যশিষ্য এবং গ্রামবাসী।
 
বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত বাউল সঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি সর্বসমক্ষে ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। গানে ‘কাঙাল’ নামে ভণিতা করতেন বলে এক সময় কাঙাল শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ‘হরিনাথ মজুমদার ‘কাঙ্গাল’ ছিলেন। আমাদের এই কাঙ্গালের দেশে ইহা তাঁহার গৌরবের ‘খেতাব’।'(কাঙ্গাল হরিনাথ- জলধর সেন)
 
“আশৈশব জমিদার, মহাজন, কুঠিয়াল ও গোরা পল্টনের অত্যাচার ও উৎপীড়ন প্রত্যক্ষ করে হরিনাথের মনে যে প্রতিকারচিন্তা জাগে সেখান থেকেই তিনি সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রেরণা লাভ করেন।”(কাঙাল হরিনাথ ও ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’- আবুল আহসান চৌধুরী -[কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ- বাংলা একাডেমী-১৯৯৮] ১৭৫ পৃ: )

 
নিজগ্রামের লোকের উপর জোর-জুলুম, দুঃখ-অভাবের ঘটনা সাধারণের সামনে আনার উপলক্ষ্যে তিনি প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন কবি ইশ্বরচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ। কবির উপদেশে তাঁর (কাঙাল) প্রবন্ধের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে প্রকাশ করা হতো। তারপর নিজ উদ্যোগে গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। তা ‘কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্মের যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার-ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা।’ (আবুল আহসান চৌধুরী- প্রাগুক্ত ১৭৫ পৃ: ) শেষে এক পয়সার সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।
গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে প্রায় ২২ বছর চলেছিল। ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবী'র অর্থ আনুকূল্যে কাগজ চালানোর পর আর্থিক কারণে ও সরকারের মুদ্রণ শাসনের ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে হয়।এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো। এছাড়াও, কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণের কেচ্ছা-কাহিনীও প্রকাশিত হতো। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও দেশী জমিদারদের অব্যাহত হুমকিও তাঁকে এ-কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
১৮৮০ সালে তিনি নিজস্ব একটি বাউল সঙ্গীতের দল প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি “কাঙ্গাল ফকির চাঁদের দল” নামে পরিচিতি ছিল। তাঁর রচিত বাউল সঙ্গীতগুলো ফকির চাঁদের বাউল সঙ্গীত নামে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। ধর্ম সাধনার অঙ্গরূপে তিনি বহু সহজ-সুরের গান রচনা করে সদলবলে সেই গান গেয়ে বেড়াতেন। হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হ'ল গানটি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
গানটির প্রথম চার চরণ নিম্নরূপ :-
“হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পাড় কর আমারে।
তুমি পাড়ের কর্তা জেনে বার্ত্তা তাই ডাকি তোমারে।।
আমি আগে এসে ঘাটে রইলাম বসে।
যারা পরে এল আগে গেল আমি রইলাম পরে।।”
 
১২৯০-১৩০০ বঙ্গাব্দের মধ্যে তিনি কাঙাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী নামে ১৬ খন্ডে বাউল সঙ্গীত প্রকাশ করেন। হরিনাথের গানগুলো অনেক লেখক, সঙ্গীত বোদ্ধাদের মন জয় করে ও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তন্মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম।
হরিনাথ শুধু গানেই নয়, গদ্য ও পদ্য রচনায়ও পারদর্শী ছিলেন।
তাঁর মুদ্রিত গ্রন্থের সংখ্যা আঠারোটি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে -
বিজয় বসন্ত (১৮৫৯)
চারু-চরিত্র (১৮৬৩)
কবিতা কৌমুদী (১৮৬৬)
অক্রুর সংবাদ (১৮৭৩)
চিত্তচপলা (১৮৭৬)
কাঙ্গাল-ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী (১২৯৩-১৩০০ বঙ্গাব্দ)
দক্ষযজ্ঞ
বিজয়া (১৮৬৯)
কবিকল্প (১৮৭০),
সাবিত্রী নাটিকা (১৮৭৪),
পরমার্থগাথা
মাতৃমহিমা (১৮৯৬)
কাঙালের ব্রহ্মাণ্ডবেদ(১৮৮৭-৯৫)
 
কাঙাল হরিনাথের মহত্ত্ব ও স্মরণীয় প্রতিষ্ঠার একটি বড় ছাপ সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব, সুসাহিত্যিক জলধর সেন, দীনেন্দ্রকুমার রায়, মীর মশাররফ্‌ হোসেন-এর মতো মানুষেরা তাঁর সাহিত্যশিষ্য এবং তাঁর শিক্ষা ও উপদেশ অনুপ্রেরণা তাঁরাই জীবনের পাথেয়রূপে জ্ঞান করে গেছেন। হরিনাথ হিন্দু,মুসলমান, খৃস্টান সবাইকেই সমদৃষ্টিতে দেখতেন এবং স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে, এক স্বচ্ছ প্রাণ।