দাঙ্গা
লোকটি খুব তাড়াতাড়ি পল্টনের মাঠ পার হচ্ছিলো। বোধহয় ভেবেছিল,
লেভেল ক্রসিং-এর কাছ দিয়ে রেলওয়ে ইয়ার্ডে পড়ে নিরাপদে নাজিরাবাজার
চলে যাবে। তাহার হাতের কাছে বা কিছু দূরে একটা লোকও দেখা যায় না—সব শূন্য, মরুভূমির মতো শূন্য। দূরে পিচ্ঢালা পথের ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে দুই-একটি
সুদৃশ্য মোটরকার হুস করে চলে যায় বটে, কিন্তু এত তীব্র
বেগে যায় যে মনে হয় যেন এই মাত্র কেউ তাকেও ছুরি মেরেছে, আর সেই ছোরার ক্ষত হাত দিয়ে চেপে ধরে পাগলের মতো ছুটে চলেছে। নির্জন রাস্তার ওপর
মোটর গাড়ীর এমনি যাতায়াত আরও ভয়াবহ মনে হয়। দূরে গবর্নর হাউসের গর্বময় গাম্ভীর্য মানুষকে
উপহাস করে। পথের পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা মৃদু আন্দোলিত হচ্ছে। মাঠের ওপর কয়েকটা
কাক কিসের আশায় হেঁটে বেড়াচ্ছে! অনেক দূরে একটা ইদুরের মতো ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে
কে? একটি সৈন্য। ঐ সৈন্যটি আজ তিনদিন ধরে এক জায়গায় ডিউটি দিয়ে আসছে।
লোকটা মাঠ ছেড়ে রাস্তায়
পড়লো। তার পরনে ছেড়া ময়লা
একখানা লুঙ্গি, কাঁধে ততোধিক ময়লা একটি গামছা, মাথার চুলগুলি কাকের বাসার মতো উস্কোখুস্কো, মুখটি করুণ। তার পায়ে অনেক ধুলো জমেছে, কোন গ্রামবাসী মনে হয়।
এমন সময় কথাবার্তা নেই দুটি ছেলে এসে হাজির, তাদের মধ্যে একজন কোমর থেকে একটা ছোরা বের করে লোকটার পেছনে
একবার বসিয়ে দিলো। লোকটা আর্তনাদ করে উঠল, ছেলেটি এতটুকু বিচলিত
হলো না, লোকটার গায়ে যেখানে-সেখানে আরও তিনবার ছোরা
মেরে তারপর ছুটে পালালো, কুকুর যেমন লেজ তুলে
পলায় তেমনি ছুটে পালালো। লোকটা আর্তনাদ করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে পড়লো, তার সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে গেছে, টাট্কা লাল রক্ত, একটু আগে দেখেও মনে হয়নি এত রক্ত ঐ কংকালসার
দেহে আছে !
মিনিট দশেক পরে এক সৈন্য বোঝাই গাড়ী এলো, সৈন্যরা বন্দুক হাতে করে গাড়ী থেকে পটাপট নেমে সার্জেন্টের আদেশে হাতের কাছে যাকে
পেলো তাকেই ধরলো। হিন্দি বুলি ছেড়ে, সিগার খেয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে সার্জেন্টদের শ্বেতবর্ণ মুখ আরক্ত হয়ে এলো। যারা এদিকে
জেলের ভাত খেতে আসছিলো তাদের থামিয়া দিলো। 'উধার মৎ যাইয়ে বাবু, মৎ যাইয়ে।'
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিন নম্বর ওয়ার্ডের
প্রায় অর্ধেকটা ঘেরাও হয়ে গেল, ছোট ছোট
গলি এবং সমস্ত রাস্তার মাথায় সশস্ত্র পুলিশ সঙ্গীন উচিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ ঢুকতে
পারবে না, কেউ বেরুতেও
পারবে না, শৃঙ্খলিত
করে একটা সাময়িক বন্দীশালা তৈরি হলো।
কিন্তু
শৃঙ্খলের ভিতরেও সংগ্রাম হয়। এক বিরাট
সংগ্রাম শুরু হলো। সকলেই এখানে-সেখানে ছুটোছুটি করতে
লাগলো, চৌদ্দ বছরের
বালক থেকে আরম্ভ করে সত্তর বছরের বুড়ো পর্যন্ত। এমন দৃশ্য
শহরের জীবনে অভিনব ।
লাইনের পাশে যাদের বাসা তাদের পালাবার আর অবসর কোথায় ? তাদের মুখ চুন হয়ে গেল, কেউ হিন্দুত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে
বীরের মতো অগ্রসর হলো। এক রিটায়ার্ড অফিসার ভদ্রলোক একটা
ব্যাপার করলেন চমৎকার। বাক্স থেকে বহু পুরনো একটি পাতলুন
বের করে সেটা পরে' এবং তার ওপর একটা পুরনো কোট চাপিয়ে এক সুদর্শন যুবকের
মতো ওপর থেকে নীচে নেমে এলেন, তাঁর শরীরের
ভিতর আগের সেই তেজ দেখা দিয়েছে, যখন ওপরওয়ালা
অনেক সাহেব- সুবোকেও বকে ঝকে নিজের কাজ তিনি করে যেতেন। সেই দিন
আর এখন কই, হায়, সেই দিনগুলি এখন কোথায় ।
ভদ্রলোক
নীচে এলেন, পাৎলুনের
দুই পকেটে কায়দা করে দুই হাত ঢুকিয়ে দুই পা ফাঁক করে গেটের ওপর দাঁড়ালেন। ঐ যে, রক্তবর্ণ সাজেন্টটি এদিকেই আসছে। ভদ্রলোক
তার সঙ্গে বড়বাবুসুলভ ইংরিজি আরম্ভ করে দিলেন।
শিক্ষয়িত্রী সুপ্রভা সেনের ব্যাপার আরো
চমৎকার। সে তো মেয়েদের ইস্কুলে চাকরি করে। শহর দাঙ্গা-বিধ্বস্ত
বলে প্রচুর ছুটি উপভোগ করছিলো, আজও এইমাত্র
দুপুরের রেডিও খুলে বসেছে। ছুটির দিন
বলে একটা পান চিবুচ্ছে। ভোরবেলা ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছোট
ভাইকে গাধা বলে শাসিয়েছে, খানিকক্ষণ
গম্ভীরভাবে কিছু ভেবেছে আর এখন বসেছে রেডিয়োর গান শুনবে বলে। তার চোখে
চশমা, একগাছি
খড়ের মতো চুল সযত্নে বাঁধা। আঙুলগুলি
শুকনো হাড়ের মতো দেখতে, আর শরীরের
গঠন এমন হয়ে এসেছে যে যত্নবতী না হলেও চলে। এমন সময়
বাইরের রৌদ্রে গুর্খাদের বন্দুকের সঙীন ঝল্মল্ করে উঠলো, তাদের শ্বেত অধিনায়কের গর্বোন্নত শির আরও চোখে পড়ে, এবং বুটের খট্মট্ আওয়াজ। সুপ্ৰভা সেন আর তিলমাত্র দ্বিধা না করে নীচে চলে গেল, বসনে এবং ব্যবহারে
বিশেষ যত্নবতী হয়ে সাহেবের সম্মুখীন হলো।
মুহুর্তে এই গল্প লাফিয়ে চললো এবং সুপ্রভা সেনের অনেক খ্যাতি
ও অখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
লাইনের পাশে কোন বাড়ীই খানাতল্লাসীর হাত থেকে রেহাই পেলো না,রাজনৈতিক বন্দীদের বেলায় যেমন খানাতল্লাসী হয় তেমন অবশ্য নয়, তল্লাসী হয়
শুধু মানুষের।
ভিতরের দিকে তেমনি ছুটোছুটি,
একবার এদিকে একবার ওদিকে। কিন্তু সকলের মুখেই হাসি, বিরক্তি বা
রাগের চিহ্নমাত্র নেই। অশোকের দেখে রাগ হলো, এই ব্যাপক ধরপাকড় আর ব্যাপকতর ঘেরাও মানুষের কাছে একটা Sports হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধঃপতন বা পচন একেই বলে। অশোকের ইচ্ছে হয় চিৎকার করে বলে, “আপনারা কেন
হাসবেন? কেন হাসছো তোমরা?
একটা জায়গায় কিছু লোক জমা হয়ে গেল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই
আবার ভেঙ্গে গেল। লোকগুলির মুখে হাসি আর ধরে না। তারা আর কিছুতেই সীরিয়াস্ হতে পারছে না। অশোকের মনে হলো, এরা একেবারে
জর্জরিত হয়ে গেছে।
রাস্তা দিয়ে একটা ফেরিওয়ালা যাচ্ছিলো পুরনো কাগজের বোঝা নিয়ে। তার পায়ে একটা ময়লা
কাপড়ের প্রকাণ্ড ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। সে হঠাৎ থেমে বললে, 'বাবুরা হাসছেন। হাসুন, আপনাদেরই দিন পড়েছে, গবর্নমেন্টের
যেমন পড়েছে। দিন পড়েনি শুধু আমাদের, আমরা মরবো,
মরবো !'
অশোক মন্থর পায়ে হেঁটে বাসায় গেল। এই মাত্র আর একটা ঘটনার
সংবাদ পাওয়া গেছে। দোলাইগঞ্জ স্টেশনের ডিস্ট্যান্টসিগ্ন্যাল পার হয়ে এক বৃদ্ধ যাচ্ছিলো—ঘটনার বিবরণ শুনতে আর ভালো লাগে না। কখনো নিজেকে এত অসহায় মনে হয়।
অশোকের মা খালি মাটিতে
পড়ে ভয়ানক ঘুমুচ্ছিলেন, ছেলের ডাকে ঘুম থেকে উঠে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, 'যা শীগ্গির, বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা
বলছি ! একশোবার বলেছি, যা বাপু মামাবাড়ীতে কিছুদিন ঘুরে আয়, মারামারিটা
কিছু থামলে পরে আসিস, না তবু এখানে পড়ে থাকা চাই, একটা ছেলেও যদি কথা শোনে ! মাটি কামড়ে পড়ে
থাকা চাই, শহরের মাটি এমন মিষ্টি, না?' অশোক হেসে বললে, 'এত কাজ ফেলে কোথায় যাই বলো ?'
'হু',
কাজ না ছাই ! কাজের আর অন্ত নেই কী না ! তোদের কথা শুনবে কে রে ? কেউ না। বুঝতে পেরেছি তোদের
কতখানি জোর, কেবল মুখেই পট্পটি, হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা।'
'জানো কংগ্রেস মিনিসট্রির সময় কানপুরে কী হয়েছিলো? আমরা দাঙ্গা
থামিয়ে দিয়েছিলুম।'
মা দুই হাত তুলে বললেন, 'হয়েছে। অমন ঢের বড় বড় কথা শুনেছি। তোদের রাশিয়ার কী হলো শুনি? পারবে জার্মানীর
সঙ্গে ? পারবে ?'
অশোক বাইরের দিকে চেয়ে বললে, 'পারবে না কেন মা ? বিপ্লবের কখনো
মরণ হয় ?'
মা হাঁ করে চেয়ে রইলেন, একটু পরেই চুপি চুপি বললেন, 'হ্যারে, একী সত্যি?'
'কী মা?'
'ঐ যে উনি বললেন, জার্মানী রাশিয়ার
সব নিয়ে গেছে, একেবারে আমাদের দেশের কাছে এসে পড়েছে ?'
অশোক হো হো
করে হেসে উঠলো, 'এরা হিটলারের চেয়েও লাফিয়ে লাফিয়ে চলেন।'
এমন সময় অজু মানে অজয় এসে হাজির। অজু অশোকের ছোট ভাই। সে হাপাতে হাপাতে বললে, 'নবাব বাড়ী
সার্চ হয়ে গেছে, অশোক চোখ পাকিয়ে বললে, 'এটি কোথেকে আমদানি, শুনি !'
'বারে, আমি এইমাত্র
শুনলুম যে।'
'তোমার দাদারা বলেছে নিশ্চয়?'
অজু একজন 'হিন্দু সোসালিস্ট'। সম্প্রতি দাঙ্গার সময় জিনিষটির পত্তন হয়েছে। এই বিষয় শিক্ষা নিতেই
সে পাগলের মতো ঘোরাফেরা করে। উচ্চ-স্বরে মানুষের সঙ্গে তর্ক করে, হিটলারের জয়গান
করে, হানাহানিতেও প্রচুর আনন্দিত হয়।
'বারে, আমি নিজের কানে
শুনেছি। একটা সোল্জার আমায় বললে,—'
'তোমায় কচু বলেছে !'
অজু কৰ্কশ স্বরে বললে, 'তোমরা তো বলবেই— তারপর মৃদুস্বরে—'তোমরা হিন্দুও নও, মুসলমানও নও—'
'আমরা ইহুদীর বাচ্চা, নারে?' অশোক হা হা করে হেসে উঠলো, বললে, 'সার্চ হোক বা
না হোক, তাতে Rejoice করবারই বা কী আছে, দুঃখিত হবারই বা কী আছে? আসল ব্যাপার
হল অন্যরকম। দেখতে হবে এতে কার কতোখানি স্বার্থ রয়েছে।'
অজয় চুপ করে ছিলো, সে খুক খুক
ক'রে হেসে উঠলো।
দুপুর আস্তে বিকেলের দিকে এগিয়ে গেল।
অশোক রাস্তায় বেরিয়ে দেখতে পেলো, এই মাত্র পুলিশ
তুলে নেওয়া হয়েছে। লোকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এই অঞ্চলেরই অধিবাসী যারা বাইরে ছিল, অনাহারে তাদের
মুখ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু বেশীরভাগ লোকেরই মুখের হাসিটি শুকোয়নি। ভিতরে এবং বাইরে যারা
ছিল তাদের সকলেরই অভিজ্ঞতার বর্ণনা চলতে লাগলো। ওদিকে দুই গাড়ী বোঝাই ভদ্রলোকদের ধরে নিয়ে
গেছে। একজন ভদ্রলোক গাড়ীতে
বসে ঝর্ ঝর্ করে কেঁদে ফেললেন ।
'কার আবার স্বার্থ
থাকবে? স্বার্থ রয়েছে হিন্দু আর মুসলমানের।' এই বলে অজয় অন্যদিকে চেয়ে একটা গান গাইতে লাগলো।
মা বলে উঠলেন, 'তোরা ভাইয়ে
ভাইয়ে এমন ঝগড়া করিস কেন না, মুখে মুখে তর্ক করা দূরের কথা! কিন্তু দাদা আমায় যা ভালবাসতেন !
ছোটবেলায় অনেক শীতের রাত্তিরে আমরা এক লেপের তলায় শুয়ে ঘুমিয়েছি।'
অশোক গালে হাত দিয়ে বললে, 'হয়েছে! এবার
ভাইয়ের গল্প আরম্ভ হয়ে গেছে, আমাদের তাহলে উঠতে হয়।'
তারপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা এগিয়ে এলো। এবার তবে বাসায় ফিরতে হয়। কিছুপরেই সান্ধ্য আইন
শুরু হয়ে যাবে। রাস্তাঘাট নির্জন হবার আগে একটা মস্ত ঠেলাঠেলি আরম্ভ হয়ে গেছে। পুলিশগুলো মানুষের
শরীর সার্চ করে নিচ্ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরা একেবারে হাত তুলে দাঁড়িয়ে যায়। এক ভদ্রলোক একটা পেন্সিল কাটা ছুরি নিয়ে
ধরা পড়লেন। সকলে তাঁর নিবুদ্ধিতার নিন্দা করতে ছাড়লো না। ওদিকে সমস্ত দোকানপত্র আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে। একটু আগেও রাস্তার পাশে একটা মেলা বসেছিলো যেন, এখন সকলেই শেষ ডাক দিয়ে চলে যাচ্ছে। রিটায়ার্ড অফিসাররা নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরম স্নেহের দৃষ্টিতে সেই অস্থায়ী হিন্দু দোকনদারদের দিকে বার বার তাকাচ্ছেন,
ওদের এখন পুত্রবৎ মনে অথবা যেন বোমা বিধ্বস্ত লণ্ডন নগরীর অসংখ্য
রেফিউজি !
অশোক বাসার কাছে গিয়ে দেখে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই বললেন, ‘বাবা আশু, তোর বাবা তো
এখনও এলো না। তারপর ফিস্ফিস্ করে—'তাছাড়া আজ আবার মাইনে
পাবার দিন।'
কিছুমাত্র চিন্তার চিহ্ন না দেখিয়ে অশোক
তৎক্ষণাৎ বললে, 'আহা, অত ভাবনা কিসের—?
এখনো তো অনেক সময় আছে।'
‘অনেক নয় আশু, সাতটা বাজতে আর আধঘণ্টাও বাকী নেই।'
অশোক আবার রাস্তায় নেমে এলো, পেছনে ছোট ভাই
নীলু মা'র আঁচল ধরে দাড়িয়ে রইলো, বেলাও মা'র পেছনে এসে
দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় ক্রমেই লোক কমে আসছে। যারা কিছুদূরে আছে তাদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। কয়েক মিনিট পরেই ছোট
ছোট সৈন্যদল মার্চ করে গেল। আকাশের রঙ ক্রমেই ধূসর হয়ে আসছে। রাস্তা আর দালানের গায়ে ছায়া নেমেছে। বাদুড় উড়ে যাচ্ছে
ঝাঁকে ঝাঁকে।
এই সাতটা বাজলো। অশোক ফিরে এলো ।
মা এখনো বাইরের দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে। চোখ দুটি ভোরের তারার মতো করুণ। 'আশু, এখন উপায় ?' —মা ভাঙা গলায়
বললেন। তাঁর চোখ জলে ভরে এসেছে।
অশোক কিছু বললে না। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে
খালি তক্তপোষের ওপর শুয়ে পড়লো। তার মুখ কুঞ্চিত হয়ে এসেছে, চোখের ওপর একটা বিষম দুর্ভাবনার চিহ্ন স্পষ্ট। হয়তো এক কঠিন কর্তব্যের
সম্মুখীন হতে চলেছে সে। নীলু তার হাত ধরে ডাকলো, 'বড়দা, ও বড়দা ?
বড়দা গো ?
বারে, কথা বলে না ! ও বড়দা ? বারে ! বারে !'
নীলু কেঁদে ফেললো, 'বাবাগো' বলে
নাকিসুরে কাঁদতে লাগলো।
ওদিকে মা-ও কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। বেলাও তাঁর পাশে বসে দুই একটা ভয়াবহ গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। অন্ধকার নেমেছে রাস্তায়। ঘরের অন্ধকার আরও সাংঘাতিক। আলো জ্বালাবে কে? ঘরের আবহাওয়া
ভূতুড়ে হয়ে উঠেছে। বাইরে ঘন ঘন বাসের হর্ন শোনা যায়। সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। যেন কোন যুদ্ধের দেশ। অথবা কোন সাম্রাজ্যবাদের শেষ শঙ্খধ্বনি, বার্ধক্যের
বিলাপ।
পাশের বাড়ীতে ভয়ানক
তাসের আড্ডা জমেছে। বেশ গোলমাল শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আড্ডা ছেড়ে টর্চ হাতে করে বিমল এলো। বিমল ছেলেটিকে ভালোই
মনে হয়, কথাবার্তায় অনেক সময় ছেলেমানুষ। অনেক সময় পাকাও বটে। সে বললে, 'অশোকবাবু,
চলুন।'
অশোক প্রস্তুত হয়েই ছিল। খালি পায়েই সে বিমলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বিমল টর্চ জ্বালিয়ে
এগুতে লাগলো। মাঝে মাঝে তীক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো, কোন পুলিশ আসছে কিনা! বাড়ীটা বেশী দূরে নয়। অলিগলি দিয়ে নিরাপদেই যাওয়া যায়। বিমল যথাস্থানে গিয়ে
ডাকলো, 'সূর্যবাবু? সূৰ্যবাবু বাড়ী আছেন ?'
ভিতরে থেকে আওয়াজ এলো, 'কে ?'
'আমরা। দরজাটা খুলুন।'
সূর্যবাবু নিজেই এসে দরজা খুললেন, হেসে বললেন, —'কী ব্যাপার ?'
বিমল বললে, 'আমরা আপনার ফোনে একটু
কথা বলতে পারি ?'
'নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই !'
সূৰ্যবাবু সাদরে ফোন দেখিয়ে
দিলেন। বিমল স্টীমার অফিসে
ফোন করল, অনেকক্ষণ পরে কে একজন লোক এসে বললো, 'সুরেশবাবু কে? সুরেশবাবু টুরেশবাবু
বলে এখানে কেউ নেই। ও, দাঁড়ান দাঁড়ান। ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা ঘণ্টাখানেক পরে আবার আসুন। আমি খুঁজে আসছি।' বিমল অনেকবার ডেকেও আর কোন উত্তর পেলো না। ফোন রেখে অশোকের দিকে
তাকিয়ে বললো, 'চলুন, আবার আসবো'খন।'
অশোক ফিরে এলো। দরজার কাছে মার জল-ভরা চোখ ছল্ ছল্ করছে। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। অশোক বললে, 'পরে যেতে বলেছে।' এই শুনে মা আবার ভেঙ্গে পড়লেন, ভগ্নস্বরে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। মাটির দিকে চেয়ে অশোক মনে মনে বললে, আগামী নূতন সভ্যতার যারা বীজ, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আমি
যোগ দিয়েছি, তাদের সুখ-দুঃখ আমারও সুখ-দুঃখ। আমি যেমন বর্তমানের
সৈনিক, আগামী দিনেরও সৈনিক বটে। সেজন্য আমার গর্বের আর সীমা নেই। আমি জানি, আজকের চক্রান্ত সেদিন ব্যর্থ হবে, প্রতিক্রিয়ার ধোঁয়া শূন্যে মেলাবে। আমি আজ থেকে দ্বিগুণ কর্তব্যপরায়ণ হলাম, আমার কোন ভয় নেই।'
এমন সময় পাশের ঘরে আলো দেখা গেল—আলো নয় তো আগুন । কাগজ পোড়ার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। অশোক গিয়ে দেখলো হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের আবেদনের
ইস্তাহারগুলি স্তুপীকৃত করে অজয় তাতে আগুন দিয়েছে। অশোক তৎক্ষণাৎ আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে করতে
বললে, 'এসব কী করছিস?'
'কী করবো আবার? মড়া পোড়াচ্ছি।'
'অজু, তুই ভুল বুঝেছিস। চোখ যখন অন্ধ হয়ে
যায়নি, তখন একটু পড়াশোনা কর। তারপর পলিটিক্স করিস্।'
'দাদা, তোমার কম্যুনিজম রাখো। আমরা ওসব জানি।'
'কী জানিস, বল্ ?' অশোকের স্বরের উত্তাপ বাড়লো।
'সব জানি। আর এও জানি তোমরা দেশের শক্ৰ—'
'অজু, চুপ করলি?'
অজয় নিজের মনে গুম্ গুম্ করতে লাগলো।
অশোক উত্তপ্ত স্বরে বললে, 'ফ্যাসিস্ট এজেন্ট। বড়োলোকের দালাল। গাধার মতো ডাক ছাড়বি? তখন তোর গাধার ডাক
শুনবে কে?
পেট মোটা হবে কার? স্টুপিড, জানিস দাঙ্গা কেন হয়? জানিস প্যালেস্টাইনের
কথা? জানিস আয়ারল্যাণ্ডের কথা, মুর্খ !—' কিন্তু একটা তীব্র আর্তনাদ শুনে হঠাৎ অশোক থেমে গেল, পাশের ঘরে গিয়ে দেখলো, মা আরও অস্থির হয়ে
পড়েছেন।
কয়েকদিন পরে। অশোক বাইকে চড়ে একটা সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী
মিটিং-এ যোগদান করতে যাচ্ছিলো। এক জায়গায় নির্জন পথের মাঝখানে খানিকটা রক্ত দেখে সে সাইকেল
থেকে নেমে পড়লো। সারাদিন আকাশ মেঘাবৃত ছিল বলে রক্তটা অত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়নি, এখনো খানিকটা লেগে রয়েছে। কার দেহ থেকে এই রক্তপাত হয়েছে কে জানে? অশোকের চোখে জল এলো, সব কিছু মনে পড়ে গেল। সে চারদিক ঝাপসা দেখতে
লাগলো, ভাবলো, এই চক্রান্ত ব্যর্থ
হবে কবে?
সূত্র : সংকেত ও অন্যান্য গল্প - সোমেন চন্দ
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন