:::: সূচীপত্র ::::
একটি রাত

রাত অনেক
রাস্তায় লোকজন একটিও নেইএখন আশ্বিনের শেষ, তাই একটু শীতের আমেজ লাগেসুকুমার তার জামার কলারটি আরও টেনে ধরলোনিতান্ত অন্যমনস্ক হয়েও সে শুনতে পেলো, একটা বিড়াল মিউ মিউ করে কাতরস্বরে ডাকছে, হয়তো হঠাৎ কোন খোলা ড্রেনে পড়ে স্নান করে উঠেছেতাছাড়া ড্রেনের গন্ধও নাকে আসে, রাত্রির নিস্তব্ধতায় দিনের বেলার চেয়েও তীব্ৰদূরে একটা কেরোসিনের ল্যাম্প টিম্‌টিম্‌ করে জ্বলছেপাশেই একটা দীর্ঘ অস্পষ্ট ছায়া

সে পুরনো বাড়ীটার একটা ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে সুকুমার থাকে, সামনেই তার মস্ত বড়ো গেট, প্রায় অর্ধেকটা ভাঙা সর্বাঙ্গ লোনায় ধরেছেবাড়ী ঢুকতে গিয়ে সুকুমার দেখলো, লম্বা একটা লোক হঠাৎ কোথায় সাপের মত সরে পড়লোলোকটা কে সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেইএদের ছায়া দেখলেও চিনতে কষ্ট হয় নাকিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সুকুমার বাড়ী ঢুকে পড়লোভিতরে মা'র কাশির শব্দ শোনা যায়, সেই কাশিসুকুমার ডাকলো, 'মা ?'

মা'র বদলে ভোলা এসে হাজির হলো

ভোলা সুকুমারের কুকুর

কিন্তু একটা সামান্য কুকুরের আগেও ছেলের ডাক না শোনার এই অক্ষমতায় লজ্জিত হয়ে মা চেঁচিয়ে উঠলো— যা এখান থেকে, কেবল পায়ে পায়ে হাঁটে ! কতোবার বলি, আমার বাপু এসব ঘেন্না করে, তবু মা আর বলতে পারলো না, দরজা খুলে দিয়ে যেন নিষ্কৃতি পেলোতার চুলগুলি কাকের বাসার মতো উস্কোখুস্কো, মুখে একটা অসাধারণ কাঠিন্যের ছাপ, চোখে একটা অদ্ভুত কাতরতাভ্ৰূ কুঁচকে সে কুকুরটার কাণ্ড দেখলোসুকুমারের বুকে সে শিশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার সমস্ত শরীরটাকে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে শুঁকছে। সুকুমার বললে, 'আরে, দাঁড়া, দাঁড়া, আগে ঘরে ঢুকতে দে'

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে মা আলো হাতে সটান ঘরের দিকে গেলভিতরের এই গলির বাতাস ঠাণ্ডা আর ভারী, চারদিকে কেমন একটা পচা আবর্জনার গন্ধ

ঘরে ঢুকে জামা-কাপড় ছেড়ে সুকুমার তক্তপোষের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লোভোলাও তার বুকের ওপর মুখ রেখে গা চাটবার চেষ্টা করলোতার কান দুটি নিয়ে খেলা করতে করতে সুকুমার হঠাৎ বললে, 'এ বেলা কী রেঁধেছো মা ?' কোন উত্তর নেইবোঝা যায়, বাইরে অন্ধকারে কোথাও সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে

সুকুমার আবার ডাকলো, ‘মা ?'

কিছুক্ষণ পরে ভারী অস্পষ্ট গলায় উত্তর এলো, 'তুই এখন খাবিনে সুকু ?'

দেখলো, অন্ধকারে দেয়ালে হেলান দিয়ে নীরবে সে দাঁড়িয়ে আছেসুকুমার বললে, 'তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন মা? বাইরে যে হিম পড়ছে।'

'কোথায় হিম !' ব্যঙ্গের সুরে সে বললে, 'যা গরম পড়েছে।'

এই বলে পরক্ষণেই আবার অন্ধকুপের মতো রান্নাঘরে ঢুকে ভাত বেড়ে ডাকলো, 'খেতে আয়।'

সুকুমারের পেছনে পেছনে ভোলাও ঢুকছিলোএবার চুপ করে থাকা যায় নামা চিৎকার করে উঠলো : 'ঢের হয়েছে বাপু, শোবার ঘর এমন কী বিছানা পর্যন্ত তো হয়েছে, এখন খাবার ঘরটা থাক !'

সুকুমার হেসে ফেললো, হাসতে হাসতে ভোলাকে লক্ষ্য করে বললে,—'যা এখান থেকে, দূর হয়ে যা, পাজী কুকুর কোথাকার— আমাদের জাত ধর্ম খুইয়ে ছাড়বি দেখছি !'

একটু একটু করে খানিকটা এগিয়ে পিছিয়ে গিয়ে ভোলা এখন অন্ধকারে শুয়ে পড়লো ! অনেক আগেই তার খাওয়া হয়ে গিয়েছেওপরের ঘরের মাতাল দীননাথ চক্রবতীর মেয়ে বীণা কয়েকদিন ধরে তাকে রোজ খাইয়ে দেয়কিন্তু এ-ইতিহাসের বিন্দু-বিসর্গও সুকুমার জানে না

খাওয়া-দাওয়ার পরে সুকুমার একটা বই খুলে বসলোকিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সারাদিনের পরিশ্রমে চোখ তার জড়িয়ে এলোবইটা পাশে সরিয়ে রেখে সে ঘুমিয়ে পড়লো

মা এবার ছেলের পাশে বসলোছেলের নিদ্রিত মুখের দিকে চেয়ে চোখের দৃষ্টি তার অদ্ভুত নরম হয়ে এসেছে

সে তার দেহে গভীর স্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলোতার নিজের ফ্যাকাশে বর্ণহীন চোখেও একরাশ অশ্রু জমা হয়েছে, একটু পরেই সমস্ত বাঁধ ভেঙে হয়তো বইতে থাকবে

ওদিকে ওপরের ঘরে বসে বসে দুই করুণ চোখে যে মেয়েটি রাত জাগছে, সে বীণাকার জন্যে এই রাত জাগা ? অন্তত তার বাবার জন্যে যে নয়, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া চলেদীননাথ ঘোর মাতাল, বুড়ো হবার আগেই গরুর মতো শান্ত বৌটাকে লাথি-গুঁতো মেরে যমের বাড়ী পাঠিয়েছে এখন বৌ-র অভাবে বাইরে রাত কাটিয়ে আসেসুতরাং দীননাথ চক্রবতীর একমাত্র মেয়ে বীণা তার অপেক্ষায় যে রাত জাগে না, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে

কিন্তু এতোক্ষণে সে আলোটা নিভিয়ে দিলো

সুকুমারের ঘরের ওপর নিবদ্ধ দৃষ্টিকে এতোক্ষণে সে অন্ধকারে ঠেলে দিলো, একটা কুকুরের মতো কুঁকড়ে শুয়ে অনেক আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো

এখন সমস্ত বাড়ীটাই বিদেশে প্রথম আসা কোন মূঢ় বালকের মতো স্তব্ধঅন্যান্য ভাড়াটেদের তো অর্ধেক রাতের ঘুম হয়ে গিয়েছেতারা সারাদিন একমুষ্ঠি অপ্রচুর অন্নের জন্যে দেহের রক্ত জল করে বাড়ী ফেরে, তারপর সন্ধ্যার পরেই খেয়ে দেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, সবগুলো ছেলেমেয়েকে ঘুমিয়ে পড়তে দেয়ার অবসরও তাদের নেই, তার আগেই তাদের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসেতারপর, সেদিন যা একটা কাণ্ড ঘটলো, তা যেমন হাস্যকর, তেমনি করুণসকলের শেষে কলতলার দক্ষিণ দিকের ঘরটিতে থাকে নকুল, সে কোন এক বইয়ের দোকানে কাজ করেতার শরীরটা এত মোটা, ভারী আর লম্বা যে হঠাৎ দেখলে কোন কাল্পনিক দৈত্যের কথা মনে হয়বয়স চল্লিশের কাছাকাছিকিন্তু ঘরে একপাল ছেলেমেয়ে, তার বৌ চিরটা কাল কেবল ছেলেমেয়ে প্রসব করে, তারপর একদিন হঠাৎ বলা-নেই কওয়া-নেই মরে গেলনকুল তখন আর কি করবে ? এক দরজা দিয়ে স্ত্রীর শবদেহ শ্মশানে, পাঠিয়ে আর এক দরজা দিয়ে কোন এক গাঁয়ে মেয়ে দেখতে চলে গেলযখন ফিরে এলো, তখন সু, মুখে সিগারেট আর একরাশ পান, আর তার পেছনে দুই হাত লম্বা একটি বৌ, তার আড়াই হাত ঘোমটাকাপড়টুকুও ভালো করে পরতে জানে না, কোমরের নীচে দেহের প্রস্থটুকু কাঠির মত সরুসেদিন রাত্রে এই বৌ-টিই হঠাৎ ভীষণ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, তারপর বাকী রাতটুকুও শুকরের মতো চিঁ চিঁ করে কেঁদেছিলবাস্তবিক এমন কাণ্ড কমই দেখা যায়তখন এই গল্প নিয়ে বাড়ীর অন্যান্য বধূ আর মেয়েদের ভিতরও একটা খোরাক জুটেছিল মন্দ নয়, তারা এই নিয়ে অনেক বলাবলি অনেক ফিসফাস্‌ করেছে

দূরে গির্জার ঘড়িতে একটা বেজে গেলদীননাথ এখনো ফেরেনিবীণা আকাশ-পাতাল অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লোএদিকে সুকুমারও গভীর ঘুমে অচেতনকিন্তু মা'র ঘুম কখনো গভীর হয় নাসে কেবল শুয়ে থাকে মাত্র মাঝে মাঝে জেগে কাশতে থাকেএই মাত্র সে কেঁদে একটু চোখ বুঝেছে, এখনো কান্নার ছাপে অপরিচ্ছন্ন আর বিকৃত তার মুখসুকুমার তাকে আর কতো কাঁদাবে ?

সুকুমারের কাছে কতো লোক যে আসে তার ইয়ত্তা নেইসারাদিন ডাকাডাকি লেগেই আছেসর্বদা যারা আসে তাদের মধ্যে গ্রাস-ওয়ার্কসের সামসুর একজনতার চোখ আর চুলদুই-ই কাটা, চোখে-মুখে সর্বদাই একটা খুশি ঝরে পড়েএই সামসুর ছাড়া আরও অনেকেই আসেতাদের কারুর বয়স চৌদ্দ, কারুর বয়স চল্লিশ; যার বয়স চৌদ্দ, তার নাম অনিল । এদের নিয়ে মাঝে-মাঝেই জটলা করে সুকুমার, সকলে মিলে রুদ্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়রাশিয়া, লেনিন ইত্যাদি দু'একটা পরিচিত কথা ছাড়া মা এদের কথা কিছুই বুঝতে পারে না

একদিন একটা ব্যাপার ঘটলো চমৎকারসুকুমার হঠাৎ সামসুরকে লক্ষ্য করে বললে, ‘একা একা বিড়ি খাচ্ছেন ! দিন একটা ? সামসুর অমনি মেঝের ওপর একটা বিড়ি ফেলে দিলোএবং সেই বিড়িটা জ্বালিয়ে সুকুমারের কী সহজ স্বচ্ছন্দ টান

ব্যাপার দেখে মার দুই চক্ষু স্থিরআর কখনো সে তাকে বিড়ি বা সিগারেট টানতে দেখেনিতার চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে এলো

হা-হা করে হেসে সুকুমার বললে 'দেখুন, মা কেমন রেগেছে!সুকুমার তার হল্‌দে দাঁতগুলি বের করে হাসলো

সুরেন মুখ বাড়িয়ে বললে, 'আমাদের কিছু দোষ নেই, মা !' মা দাঁতে দাঁত চেপে বললে, 'উহু, তোমাদের কিছু দোষ নেই, তোমরা সব শান্ত সুবোধ বালক !' তারপর সুকুমারের দিকে লক্ষ্য করে বলল, 'তোরা মনে করিস আমি কিছুই বুঝিনে কিন্তু আমি সব বুঝি !'

এই শুনে সকলেই হেসে উঠলোসুরেনের গলাটাই শোনা যায় সবচেয়ে বেশীসে আস্তে কথা বলতে পারে নাযত বাজে বা হাস্যকর কথাই হোক সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তবে সে কথা বলবেজামার বোতাম তার কোন কালেই থাকে নাতবু বোতাম লাগানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে সে বললে, 'কী বোঝেন, বলুন, আমরা সবাই শুনি।'

মা তার দিকে একদৃষ্টে চাইলো, এই মধুর স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় মুখের কাঠিন্য চেষ্টা কররো দূর করতে, কিন্তু চেষ্টা করেও যেন পারলো না।

সুকুমার বললে, 'বুঝলে না ! আপনারা পাভেলকে জানেন?'

—‘পাভেল ?' 'সে কী, গোর্কির 'মা' পড়েন নি?'

'ইনিও সেই পাভেলের মা, সেই মা' সুকুমার মা'র দিকে চেয়ে হাসতে লাগলো

এর কয়েকদিন পরেই সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর প্রদীপ জ্বালিয়ে অনেকদিন পরে মা একখানা বই খুলে বসলোবইটা পড়ে-পড়ে তার এত ভালো লেগে গেল যে ওদিকে যে নটা রেজে গেছে, সেদিকে তার এতটুকু খেয়াল নেইএক সময় কুকুরটার কলরবে বই-এর প্রতি তার মনোযোগ কিছুক্ষণের জন্যে ভেঙ্গে ছিলো বটে, কিন্তু একটু পরেই আবার সে পড়তে আরম্ভ করে দিয়েছিলোভাবলে; ছেলের আসতে এখনো অনেক দেরি, রাত এগারোটার আগে সে কখনো আসে নাকিন্তু সেদিন সুকুমার হঠাৎ এসে পড়লোদরজা খোলা পেয়ে এত চুপি চুপি সে আসতে পেরেছিলো যে, ভোলা একবার আনন্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠলেও বইটি তাড়াতাড়ি লুকোনোর অবসর মা পায়নি

তার হাতে বই দেখে সুকুমার বিস্মিতজামা-কাপড় খুলতে খুলতে সে বললে, 'ও কী বই পড়ছো, মা !' ভ্ৰূ কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপেকিন্তু বোকার মতো একবার হেসে মা বললে, 'কেন, তোরা পড়িস আমরা পড়তে পারিনে ? আমাদের পড়ায় দোষ আছে নাকি ?'

বই-এর মলাট দেখেই সুকুমার চিনতে পেরেছে

ভয়ানক খুশি হয়ে সে বললে, 'তুমিও এই বই পড়ছো, মা ? দোষ আছে কে বললে কিছু দোষ নেইতুমি সত্যি সত্যি পাভেলের মা হতে পারবে। আমি অবিশ্যি পাভেলের মতো হতে এখনো পারিনিতবে হবো — ‘

সুকুমার মাটির ওপর শুয়ে পড়লো, মার কোলে মাথা রেখে বললে, 'মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না, মা? পিঠেও একটু হাত বুলিয়ে দেবে ?'

'বারে, আমি পড়বো না বুঝি ?'

সুকুমার আশ্চর্য হয়ে গেল, এমন সহজ চাপল্য-ভরা কথা সে অনেকদিন শোনেনি

কিন্তু ছেলের মুখের দিকে চেয়ে পরক্ষণেই মা-র মুখ কঠিন হয়ে এসেছে, মনে হলো যেন একটা ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছে সে, চোখের চারপাশের চামড়া তার কুঞ্চিত হয়ে গেল, তীক্ষ্ম নাক আরও তীক্ষ হয়ে এলো, বইটি পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে সে ভারী গলায় বললে, 'দাঁড়া, দিচ্ছি।'

মা এতোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু গভীর নয়গভীর ঘুম তার কখনো হয় নাতন্দ্রার মতো খানিকটাতার গলার খর্‌ খর্‌ শব্দ বেশ শোনা যায়, হয়ত এখুনি উঠে কাশতে বসবেচোখের জল এখনো শুকোয়নি

ওদিকের বারান্দায় একটি কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপরে পড়ে ভোলা ঘুমুচ্ছেকোথায় একটু খর্‌ খর্ শব্দ শুনে একবার চোখ মেলে চাইলো, বাক্স থেকে নেমে এদিক-ওদিক একটু হাঁটাহাঁটি করলো, তারপর বাক্সের ওপর উঠে আবার শুয়ে পড়লোবারান্দার ওদিকটায় শুয়ে-শুয়ে সেখানে কেমন গন্ধের সৃষ্টি করেছে সে

তার এই বাসায় স্থানলাভের ইতিহাসটা কিছু বিচিত্রতখন একদল বিদেশী সৈন্য শহরের প্রান্তে আস্তানা গাড়ছেতাদের সঙ্গে জিনিসপত্রের অন্ত নেইনদীর পার থেকে খচ্চরের গাড়ীতে বোঝাই হয়ে সেগুলি যথাস্থানে যাচ্ছিলো

সৈন্যগুলি খুব লম্বা আর খুবই জোয়ান, পায়ে লোহার মত বুটের জুতো, গায়ে খাকি শার্ট, গলার আওয়াজ মরচে-পড়া লোহার মতো কর্কশ, তাদের কথাগুলোকে মনে হয় যেন ইস্পাতে ইস্পাতে ঠোকাঠুকি করে মরছেতাদের দেখে রাস্তার পাশে লোক জমে গেল, মাথার ওপরে আগুনের মতো রৌদ্রকেও উপেক্ষা করে তারা বিস্ময়ে তাদের কার্যকলাপ দেখতে লাগলোকোন একটা কাজে এসে রাস্তা বন্ধ দেখে সুকুমারও সেই জনতার ভিতর দাঁড়িয়েছিলতখন খচ্চরের গাড়ীগুলো বিপুল ঝন্‌ ঝন্‌ শব্দ করে রাস্তা দিয়ে চলছে, প্রত্যেকটি গাড়ীর সামনে আর পেছনে কিছু কিছু সৈন্যএমন সময়ে হঠাৎ একটা কাতর 'কুঁই' 'কুঁই' শব্দে সকলে বিস্ময়ে চেয়ে দেখলো, ছোট বাদামী রঙের একটা কুকুরতার গলাটি গাড়ীর ওপরে ভারী কলের সঙ্গে একটা সরু দড়ি দিয়ে বাঁধাখচ্চরের পায়ের তলায় কয়েকবার এদিক-ওদিক হয়ে রাস্তার এই পাশে ঠিকরে পড়ে কাৎরাচ্ছেব্যাপার দেখে রাস্তার দুইপাশের লোকগুলোর চোখ আতঙ্কে বড় হয়ে গেল, সকলেই একসঙ্গে 'ইস' শব্দ করে দুঃখ প্রকাশ করলো, তারা অনুমান করলো যে, কুকুরটা নিশ্চয় গাড়ীর নীচে চাপা পড়েছেএকটু পরেই কাৎরাতে কাৎরাতে মারা যাবে

কিন্তু কুকুরটা নেহাতই নাছোড়বান্দা, তার মরবার সম্ভাবনা যদিও সম্পূর্ণই ছিল, তবু সে মরলো নাগাড়ীটা তখনো চলছিলসঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও হেঁচড়াচ্ছে

এমন সময় একটা সৈন্য এসে দড়িটা ছিড়ে তাকে পাশে ফেলে দিলোসুকুমার দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে করে নিয়ে এলোদুপুরের রৌদ্র আগুনের মতো গায়ে বিঁধছিলো, জনতার চাপে গরম আরও বেশি, সৈন্যগুলির উৎকট ঘামের গন্ধে চারদিকের বাতাস ভরপুরসুকুমারের বুকের কাছে মুখ রেখে বাচ্চা কুকুরটা চিঁ চিঁ করে কাঁদতে লাগলোরাশি রাশি লোমের উষ্ণতা সুকুমারের গায়ে লাগছে

তার নামকরণ করা হয়েছে ভোলাভোলা এখন অনেক বড়ো হয়েছেসে এখন একলাই নিৰ্ভয়ে এদিক-ওদিক বেড়িয়ে আসে, তার দাপটে এখন মানুষও ভয় পায়, অনেক কুকুরও লেজ তুলে দৌড় দেয়কিন্তু সুকুমার তাকে স্পষ্টই বলে দিয়েছে : 'দ্যাখ, কুকুর-পোষাটা নিতান্তই বড়লোকি ব্যাপার কিন্তু আমি গরিব একবেলা ভাত জোটে তো আর একবেলা জোটে নাআমি যা খাই, তুইও তাই খাবিতাতে বাঁচতে হয় বাঁচবি, না হয় মরবি, বুঝলি ?'

এই ভোলা একদিন এদিক-ওদিক ঘুরে অনেক চিন্তা করে আস্তে আস্তে ওপরের ঘরের কাছে বারান্দাটিতে গিয়ে হাজির হলোবীণা শুয়ে-শুয়ে একটা বই পড়ছিলোতাকে দেখে নেমে এসে নিতান্ত আপনার জনের মতো বললে, 'এখানে কেন ? নিশ্চয়ই টের পেয়েছিস, আমি আজ মাংস রেঁধেছি ? (দীননাথ মদ যেমন নিত্যই খায়, মাংস তেমন প্রায়ই আনে) খাবি?'

ভোলা এখানে-ওখানে হুস্ হুস্‌ করে অনেক কিছু শুঁকলো; তারপর ফ্যাল-ফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে লেজ নাড়তে লাগলো

বীণা একটা অদ্ভুত মমতা বোধ করলো এই কুকুরটার ওপরসুকুমারের ঘরের দিকে একবার চেয়ে বললে, 'ভাল লোকের হাতেই পড়েছিস। নিজের শরীরের দিকেই নজর দেয়ার সময় যার নেইওই পাশে গদাধরের স্ত্রীকে দেখে বীণা থেমে গেল, হঠাৎ রেগে বললে,—

'যা এখান থেকে, যা বলছি, একেবারে ওপরে এসে হাজির হয়েছেন, ভারী ইয়ে আমার ! যা এখান থেকে, যা বলছিও মাসীমা, আপনাদের কুকুরের কাণ্ড দেখেছেন? বীণা তাকে তাড়া দিতে দিতে একেবারে নীচে নিয়ে গেল, রান্নাঘর থেকে কিছু মাংস নিয়ে তার পায়ের কাছে ফেলে চুপি চুপি বললে, 'খা !—' তাকে খেতে দিতে গিয়ে সুকুমারের কথা মনে করে বীণার মুখ লাল হয়ে গেল

কয়েকদিন পরেবীণা নাক সিঁটকিয়ে বললে, 'তোর গায়ে কী গন্ধ রে ! একদিনও চান করিস না বুঝি ? কেউ তোকে চান করিয়ে দেয় না, না দেবে কী, নিজের শরীরের দিকেই নজর দেয়ার সময় যার নেইতারপর বীণা চারদিকে চেয়ে নিজের কথাটাকে অর্ধ সমাপ্ত রেখেই একটা সাবান নিয়ে বসে গিয়েছে, তাড়াতাড়ির মধ্যে যতটা পারা যায় তাকে ধুইয়েছে, ধোয়াবার সময় তার সেমিজ ঘামে ভিজে গেল

বেলা তিনটের পরে সুকুমারের ঘরের কাছে গিয়ে ডাকলো, 'মাসীমা ?'

মা চোখ বুজে শুয়ে ছিলো, মেয়েটার ডাক শুনে চোখের পাতার নীচে তার চোখের মণিও কুটিল হয়ে উঠেছে, সে ইচ্ছা করেই কোন সাড়া দিল না

বীণা তবু ঘরে ঢুকে মাকে ঘুমুতে দেখে নিঃশব্দে জানালার তাকের কাছে গেল, একটা মোটা বই খুলে সেটা নাকের কাছে ধরে একটু শুঁকে আবার বাইরে এসে ভোলাকে লেজ নাড়তে দেখে বললে, 'তা হলে আমিও শুয়ে থাকিগে, কী বলিস ? কাজের মধ্যে তো কেবল শুয়ে থাকাকিন্তু মনে মনে বললে, সুকুমারের কাজের কি শেষ নেই ?

অনেক রাতে ভোলার গায়ে সুগন্ধি সাবানের গন্ধ পেয়ে সুকুমার বলছিলো, 'মা, তুমি কি আজ ওকে চান করিয়ে দিয়েছো ?'

মার চোখ তখন ছোট হয়ে গেল, গলার ভিতর একটা খুশ্ খুশ্ বোধ করছিলো, কাশতে কাশতে তার মুখ লাল হয়ে গেল, চোখ দুটি যেন ছুটে বের হয়ে আসতে চায়, তবু সে বললো, 'আমাকে একটা ওষুধ এনে দিবি, সুকু ?'

কেরোসিন কাঠের ওপর ভোলা তেমনি ঘুমুচ্ছে, এখন রাত দুটোর কম নয়ভাঙা কলকাতায় সঞ্চিত উচ্ছিষ্ট ভাত, পচা ডাল-তরকারি আর মাছের কাঁটার দুর্গন্ধকে ক্ষীণ বাতাসও বয়ে আনেদেয়ালের কোণ ঘেঁষে মালপত্র ডিঙিয়ে ছোট-বড়ো অনেক ইঁদুর এখানে-সেখানে আসা-যাওয়া করে, তাদের খুট্‌ খুট্‌ আওয়াজ শোনা যায়।

এমন সময় দীননাথ এসে জড়িতস্বরে ডাকলো'বীণা, ও বীণা ?' কোন উত্তর না পেয়ে নিজের মনে জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে লাগলো, 'বীণা ? ও বীণাপাণি, একটিবার দরজা খোল, মা? তোর বজ্জাত মা-মাগীর মত তুইও আমায় সারারাত বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি কী? দরজা খোল, মা ?'

বীণা নিঃশব্দে এসে দরজা খুলে দিলো, মদের তীব্র গন্ধ সইতে না পেরে নাকে কাপড় চেপে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। 

কিন্তু দীননাথকে খাইয়ে-দাইয়ে বিছানায় আশ্রয় নিতে রাত চারটের আর বাকী থাকে নানাকে-মুখে কাপড় দিয়ে বীণা শুয়ে পড়লো

এদিকে কিছুক্ষণ পরেই আবার সুকুমার ঘুম থেকে উঠে বসলো, কিছুক্ষণ অর্ধনিমীলিত চোখে চেয়ে বসে তারপর আলো জ্বালিয়ে একটা বই খুলে বসলোবইখানা রালফ্‌, ফক্স-এর "বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক নীতি"সুকুমার পড়তে লাগলো"সাম্রাজ্যের রাজধানী আড়ম্বরপূর্ণ দিল্লী নগরীর প্রয়োজনাতিরিক্ত জাঁকজমকময় প্রাসাদগুলি নিঃসম্বল কৃষকদের শোষিত-অর্থে নির্মিতদুইটি শাসন পরিষদ, রাজ্য পরিষদ, মন্ত্রীবৃন্দ ও সেক্রেটারী গোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও, শাসন সংস্কার ও নিয়মতান্ত্রিক সুবিধা সত্ত্বেও ভারত সরকারের ভিত্তি ১৮৫৭ সনের মহাবিদ্রোহের পরে ১৮৫৮ সালে যাহা স্থাপন করা হইয়াছিল ঠিক সেই অবস্থায়ই আছে..." সদ্য ঘুম-ভাঙা চোখে এই ছাপার অক্ষরগুলি মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যায়, অথবা যেন খুব দীর্ঘ হয়ে তাড়া করে মারতে আসে, বা বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে এক ঝাঁক সৈন্য, চমৎকার এক-একটি বলির পাঁঠা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেঅথবা এও মনে হয়, এক বিশাল মরুভূমি, তার মাঝখানে পাঠশালার মতো সরু জোড়া জোড়া ঠ্যাং-এ ভর করে বড়ো মাথাওয়ালা একদল লোক, বালির ভিতর মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে

এরা কে ! সুকুমার একটু নড়ে-চড়ে বসে চোখ ঘষতে লাগলোএখন শেষ রাতে বেশ ঠাণ্ডা লাগছে, একটু পরেই ভোর হবেদূরে হঠাৎ অনেকগুলি কুকুরের মিলিত চিৎকারধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়; শেষ রাতে পুলিশকে টহল দিতে দেখে তারা নিত্যকার মতোই বিদ্রোহ জানাচ্ছে। 'ভোলাও সেই শব্দ শুনে বাক্স থেকে নেমে একবার বারান্দার এপাশে আর একবার ওপাশে ঘুরে আবার স্বস্থানে গিয়ে শুয়ে পড়লোওদিকে কলের জল পড়তে শুরু করেছেপ্রকাণ্ড চৌবাচ্চায় গপ্ গপ্‌ শব্দ হচ্ছেওটা যেন পড়বার জন্যেই প্রস্তুত থাকে এবং চিরকালই পড়তে থাকবে এইভাবে

বাইরে কিছু কুয়াশা পড়ছে, কোন গাছের চারদিকে একটা মোটা আংটির মতো মনে হয়, বাড়ীর সামনের আঙিনায় যে শেফালী গাছটি একটা ছোলা মুরগির মতো আজও বেঁচে আছে, তার অবশিষ্ট কয়েকটি ডাল থেকে কিছু ফুল একটি-দুটি করে আঙিনার কর্কশ শরীরে ঝরে পড়ছেএমন সময় বাইরে হঠাৎ একটা গোলমাল, কতকগুলি ভারী পদশব্দ, হিন্দি-বাংলায় মিশ্রিত বুলি, দরজায় ধাক্কাধাক্কিলাথির শব্দও শোনা যায়তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে সুকুমার দ্রুত জানালার তাকের কাছে গেলওদিকে মা-ও জেগে উঠেছেব্যাপারটা সহজেই অনুমান করে ভয়ে তার গলা যেন বুজে আসতে চায়সে বললে, 'সুকু, তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।'

'বলো?'

'তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।'

সুকুমার কী একটা জিনিস তাড়াতাড়ি খুঁজতে খুঁজতে অন্যমনস্কভাবে বললে, 'বলো'

'ওরা আর একদিন এসে তোকে খুঁজেছিল।'

সুকুমার কেবল বললে, ' তারপর তাক থেকে একটা কাগজের বাণ্ডিল বার করে তার হাতে দিয়ে বললে, 'এটা কোথাও রেখে এসো গো।'

কাঁপতে কাঁপতে মা অমনি বীণার কাছে গেল, তাকে এখন কতো আপনার মনে হচ্ছেবললে, 'বীণা, মা তোর কাছে এটা রাখ।'

খানা-তল্লাসী হতে বেলা আটটা বেজে গেল

দারোগা তাদের সঙ্গে সুকুমারকে নিয়ে যেতে ভুললেন নাসবই স্বপ্নের মতো মনে হয়স্বপ্ন যখন ভেঙেছে তখন দেখা গেল, মা'র শুকনো দুইগাল বেয়ে দরদর করে জল পড়ছেকিন্তু একসময় গলা তার খুশ্‌ খুশ্‌ করতে লাগলো, এমন কাশি যে, চোখ দুটি ছুটে বের হয়ে আসতে চায় যেন, তার কাশি কী ইহজীবনেও আর যাবে না ! ওদিকে ভোলাও চিঁ চিঁ করে গোঙাচ্ছে

আর বীণার অবস্থা আরও মারাত্মক

সে আজ বাড়ীর সকলকে উপেক্ষা করে যেন প্রকাশ্য রাজপথে নেমে এলো, সুকুমারের ঘরে ঢুকে দেখলো ঘরময় ইতস্ততঃ ছড়ানো নানা জিনিসপত্র, বই-কাগজসেই রাশি রাশি বই আর কাগজের  স্তুূপে মুখ গুঁজে বীণার চোখে জল ভরে এলো, চুলের খোঁপা তার খুলে গেল, পিঠ থেকে কাপড়ের আঁচল খসে পড়লো

আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পরদিনসেদিন দুপুরবেলায় ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছেবিকেলবেলায় তা খানিকটা থামলো বটে, কিন্তু বৃষ্টি টিপ টিপ করে পড়তেই লাগলোসেদিনের পাইকারী ধরপাকড়ে শহরে একটা বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছেবিকেলে শত শত শোভাযাত্রাকারী বৃষ্টি উপেক্ষা করে মুখে প্রতিধ্বনি দিয়ে নগরের অনেক পথ অতিক্রম করলোমা বুঝতে পেরেছিলো, এরা কারা এবং কেন

সে ব্যস্ত হয়ে ডাকলো, 'বীণা ও বীণা !'

'বলুন। '

'শুনিস !'এই বলতেই সেই কাশি আবার সুরু হয়ে গেলকিন্তু ঐ বীণা এখন কতো আপনার

সূত্র :  সংকেত ও অন্যান্য গল্প - সোমেন চন্দ

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন