:::: সূচীপত্র ::::
অ ভি ভা ষ ণ
৫ম খণ্ড

১০

সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে যাঁর চাক্ষুষ পরিচয় আছে, তিনিই লক্ষ করেছেন যে, ও-নাটকের নায়ক-নায়িকা সকলেই সংস্কৃতে কথা কন না, স্ত্রী-শূদ্রের ও-ভাষায় অধিকার নেইএর কারণ, ও-দেবভাষা আয়ত্ত করতে শাস্ত্রমার্গে ক্লেশ করতে হতসে ক্লেশ যাঁরা করতে নারাজ ছিলেন, তাঁরা সে কালের প্রচলিত মৌখিক ভাষাতেই কথোপকথন করতেনএ কালে স্ত্রী শূদ্ররা যেমন ইংরাজি ভাষায় গুফ্‌তগু না করে দেশভাষাতেই কথাবার্তা কয়তবে এ কালে যেমন জন-কতক বিদুষী মহিলা ইংরাজি ভাষাকে মাতৃভাষা করে তুলেছেন, সে কালেও তেমনই জন-কতক বিদূষী মহিলা সংস্কৃত ভাষাকে সমান কণ্ঠস্থ করেছিলেনবৌদ্ধ পরিব্রাজিকারা রঙ্গমঞ্চে আরোহণ করলে সংস্কৃত ছাড়া আর কিছু বলতেন নামৌখিক ভাষা প্রাকৃত জনের মুখের ভাষা বলে তার নাম হয়েছিল প্রাকৃত

এই প্রাকৃত মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসবা মাত্র ব্যাকরণের অষ্ট বন্ধনে পড়ে গেল এবং আলঙ্কারিকদের কল্পিত বিধিনিষেধের অধীন হয়ে পড়লনাটক-কাররা অলঙ্কারের বিধি অনুসারে গদ্য রচনা করতে বাধ্য হলেন শৌরসেনী প্রাকৃতে, আর পদ্য রচনা করতে বাধ্য হলেন মহারাষ্ট্ৰী প্রাকৃতেশৌরসেনী প্রাকৃত ছিল, যে-দেশে এখন আমরা উপস্থিত, সেই দেশের সে কালের লৌকিক ভাষাআর মহারাষ্ট্র তো অদ্যাবধি স্বনাম রক্ষা করে এসেছেগদ্য কেন শৌরসেনীর দখলে এল, আর পদ্য মহারাষ্ট্রর ? সম্ভবত দিল্লি বক্তৃতার পীঠস্থান বলে, আর মহারাষ্ট্র গানের দেশ বলেসে যা-ই হোক, এ দুই ছাড়া সংস্কৃত নাটকে আর একটি প্রাকৃতও আমাদের কর্ণগোচর হয়চণ্ডাল, জল্লাদ, চোর, ধীবর প্রভৃতি ইতর শ্রেণীর লোকের মুখে যে-প্রাকৃত শোনা যায়, সে প্রাকৃতের নাম মাগধী প্রাকৃতএই মাগধী প্রাকৃতই রূপান্তরিত হয়ে কালক্রমে বঙ্গভাষায় পরিণত হয়েছেবঙ্গভাষার আর যে-গুণই থাকুক, তার বংশমর্যাদা নেইসে বড়ঘরের সন্তান নয়আসলে খানদানি ভাষা হচ্ছে 'ব্রজভাখা', কেননা, সে ভাষা শৌরসেনী প্রাকৃতের বংশধর। 'ব্রজভাখা' যে সাহিত্যে মাথা তুলতে পারেনি, সে বিদেশি ভাষার বাদশাহি চাপে

১১

প্রাকৃত হচ্ছে মৌখিক ভাষার লিখিত সংস্করণ, অর্থাৎ মুখের ভাষা পুথিগত হলেই তা হয় প্রাকৃতও হচ্ছে সে কালের সাধু ভাষাভাষা মানুষের মুখে-মুখে বদলে যায়চলতি ভাষার প্রধান গুণ অথবা দোষ এই যে, তা চলৎশক্তিরহিত নয়অপর পক্ষে লিখিত ভাষা বাণীর গুরুপুরোহিতদের শাসনে বইয়ের মধ্যে জড়সড় ও আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকেসমাজ বদলায়, মানুষের মন বদলায়, কিন্তু পুথিগত প্রাকৃতের আর বদল নেইকিছু দিন পরে দেখা যায় যে, যে-প্রাকৃত এক কালে মুখে-মুখে চলত, সে প্রাকৃতও শাস্ত্রমার্গে ক্লেশ করে শিক্ষা করতে হয়

মৌখিক প্রাকৃতের স্রোত কালের সঙ্গে বয়ে গিয়ে যখন নব রূপ ধারণ করে, তার নাম হয় তখন অপভ্রংশশৌরসেনী প্রাকৃত যেমন কালক্রমে শৌরসেনী অপভ্রংশে পরিণত হয়েছিল, মাগধী প্রাকৃতও তেমনই কালক্রমে মাগধী অপভ্রংশে পরিণত হয়েছিল

মাগধী প্রাকৃত অবলীলাক্রমে তার রূপ পরিবর্তন করে, কেননা, মাগধী প্রাকৃত কস্মিন্‌ কালেও লিখিত ভাষা হয়ে ওঠেনিকেতাবি ভাষার চাপে তার মুক্ত গতি কখনওই রুদ্ধ হয়নিবৌদ্ধ ধর্ম অবশ্য মগধেই জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু বিপুল বৌদ্ধ শাস্ত্র মাগধী ভাষায় লিখিত নয়পালি বেহারী ভাষা নয়, মালবের ভাষাজৈন ধর্মের জন্মস্থানও ঐ অঞ্চলেইকিন্তু জৈন শাস্ত্র যে-ভাষায় লিখিত হয়েছে, সে ভাষা মাগধী নয়, অর্ধ-মাগধীঅর্থাৎ তা কাশী-কোশলের ভাষা, আজকাল আমরা যাকে আউধের ভাষা বলিমাগধী প্রাকৃত ও মাগধী অপভ্রংশ যুগ-যুগ ধরে সাহিত্যের পাশ কাটিয়ে গিয়েছেফলে বহু কাল ধরে তা দেহাতি বুলি ও জেনানা বুলি রূপেই বিরাজ করছিল; শেষটা বাঙ্গালায় এসে তা সাহিত্যের পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে

সূত্র : প্রমথ চৌধুরী || অগ্রন্থিত রচনা - ১
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেইওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন