:::: সূচীপত্র ::::
অ ভি ভা ষ ণ
৪র্থ খণ্ড


মাতৃভাষার মাহাত্ম্যের বিষয়ে আপনাদের কাছে বেশি কিছু বলা নিম্প্রয়োজনকারণ, আপনাদের সঙ্গে আমাদের মানসিক ঐক্যের প্রধান বন্ধনই তো এই ভাষার বন্ধনভাষাই হচ্ছে একটি জাতির পরস্পরের মনপ্রাণের অপৌরুষেয় যোগসূত্রআমি অপৌরুষেয় বিশেষণটি ব্যবহার করছি এই কারণে যে, কোন বিশেষ ব্যক্তি কর্তৃক পৃথিবীর কোন ভাষাই সৃষ্ট হয়নি, আমাদের ভাষাও হয়নিএকটা সমগ্র মানব সমাজ যুগ-যুগ ধরে অলক্ষিতে একটা ভাষা গড়ে তোলেসামাজিক মন যে-ভাবে দিনের পর দিন গড়ে উঠেছে, সঙ্গে-সঙ্গে তার ভাষাও তেমনই গড়ে উঠেছেএকটা জাতির মন যে-কারণে যে-উপায়ে সাকার হয়ে উঠেছে, সে জাতির ভাষাও সেই কারণে সেই উপায়ে সাকার হয়ে উঠেছেজাতির মন যখন একটি বিশিষ্ট ও পরিচ্ছিন্ন মূর্তি ধারণ করে, তখনই তা সাহিত্যে বিকশিত হয়সাহিত্যে দীক্ষিত হয়েই ভাষা তার দ্বিজন্ম লাভ করে, অর্থাৎ দ্বিজ হয়সাহিত্যের মূল উপাদান কী? মানুষের আশা, আকাঙক্ষা, আনন্দ, বেদনা, কল্পনা, কামনার চিত্রই তো সাহিত্যযখনই একটি জাতির ভিতর সাহিত্যের দর্শন লাভ করা যায়, তখনই বুঝতে হবে, সে জাতির মন আলোকে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে ও তার অন্তরে আত্মজ্ঞান প্রবুদ্ধ হয়েছেকারণ, সাহিত্য প্রবুদ্ধ জ্ঞানেরই সৃষ্টিমানুষের মন ও ভাষাকে দেশ ও কাল, দু'জনে দু'হাত মিলিয়ে তৈরি করেছেআমরা যদি কোন কারণে দেশের বন্ধন কাটাই, তা হলেও কালের বন্ধন ছিন্ন করতে পারিনেমানুষ উদ্ভিদের মতো জিওগ্রাফির অধীন নয়; তার মন নামক জিনিস আছে বলে সে মুখ্যত হিস্টরির অধীনসে অধীনতা-পাশ সম্পূর্ণ ছিন্ন করলে সে পশুত্ব প্রাপ্ত হয়আমরা যাকে জাতীয়তা বলি, তার মূল ভিত্তি ইতিহাসের গর্ভে নিহিত


রবীন্দ্রনাথ বহু কাল পূর্বে এই বলে আক্ষেপ করেন যে,— "আমাদের দেশের পুরাবৃত্ত, ভাষাতত্ত্ব, লোক-বিবরণ প্রভৃতি সমস্তই এ পর্য্যন্ত বিদেশী পণ্ডিতরা সংগ্ৰহ এবং আলোচনা করিয়া আসিয়াছেনদেশে থাকিয়া দেশের বিবরণ সংগ্ৰহ করিতে আমরা একেবারে উদাসীন, এমন লজ্জা আর নাই।" আপনারা শুনে সুখী হবেন, বাঙ্গালিরা তাদের ভাষাব ইতিহাস সম্বন্ধে এখন আর উদাসীন নয়সম্প্রতি আমার বন্ধু শ্রীমান্‌ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় 'The Origin and Development of the Bengalee Language' নামক একখানি গ্রন্থ প্রকাশিত করেছেনএই বিরাট গ্রন্থের মালমসলা সংগ্রহ করতে এবং সেই উপাদান দিয়ে এই ইতিহাস রচনা করতে, এক যুগ ধরে তাঁকে কী একান্ত, কী অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে, তা ভাবতে গেলেও আমাদের মন অবসন্ন হয়ে পড়েএখানি ভাষাবিজ্ঞানের একখানি অতুলনীয় গ্রন্থবিজ্ঞানের একটা মস্ত গুণ এই যে, ও-শাস্ত্র অনেক তর্কের একেবারে চূড়ান্ত নিম্পত্তি করে দেয়তার একটি চমৎকার প্রমাণ আমি বহু কাল পূর্বে পাইজনৈক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত এক দিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে "চৌধুরী মশায়, এ কথা কি সত্য যে, য়ুরোপের পণ্ডিতরা সূর্যের পরিমাণ নির্ণয় করেছে?" আমি উত্তরে বললুম, "হাঁ, এ কথা আমিও শুনেছি।" এ উত্তর শুনে তিনি হেসে বললেন, "মূখের অসাধ্য কিছুই নেই, সূর্য যে প্রমেয়, তাই প্রমাণ করবার আগে বেটারা সূর্যকে মেপে সারলে।" আমি মনে-মনে বললুম,— যখন তারা সূর্যকে মেপে সারা করেছে, তখন তা প্রমেয় কি অপ্রমেয়, এ তর্কের আর অবসর নেইতা ছাড়া সূর্য প্রমেয় কি অপ্রমেয়, এই তর্কই যদি চালানো হত, তা হলে মাপ আর কখনওই নেওয়া হত না; কেননা, ও-তর্কের আর শেষ নেই, যাবচ্চন্দ্র দিবাকর চলতে পারে

আমরা পাঁচ জন সাহিত্যিক মিলে যে ভাষার তর্ক করেছি, সে কতকটা ঐ গোছেরচলতি বাঙ্গালা লিখিতব্য কি অলিখিতব্য, তাই নিয়ে আমরা বাগবিতণ্ডায় ব্যাপৃত ছিলুমশ্ৰীমান্‌ সুনীতি এ তর্ককে খতম করে দিয়েছেনতিনি বঙ্গভাষার যে-পুরাতত্ত্ব আমাদের শুনিয়েছেন, তা আপনাদের সংক্ষেপে শোনাতে চাইকারণ, এ আশা আমি করতে পারিনে যে, ঐ দু'হাজার পাতার বই ধৈর্য ধরে আপনারা পড়ে উঠতে পারবেনওতে সব আছেআমার সেই পুরনো সমস্যা '' কী করে '' হয়, তার সন্ধানও এ পুস্তকে পাওয়া যায়কিন্ত ভয় নেই, সে সব কথা আপনাদের বলতে যাচ্ছিনেআমি উক্ত গ্রন্থের বৈজ্ঞানিক খোসা ছাড়িয়ে ও বীচি বেছে আপনাদের কাছে তার শাঁসটুকু ধরে দেবআশা করি, তা আপনাদের তাদৃশ মুখরোচক না হোক, নিতান্ত কটুকষায় হবে না

সূত্র : প্রমথ চৌধুরী || অগ্রন্থিত রচনা - ১
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেই, ওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন