:::: সূচীপত্র ::::
অ ভি ভা ষ ণ
৯ম খণ্ড

২০

এ সত্ত্বেও আমি এই গল্প-সাহিত্যের আতিশয্য বঙ্গ-সাহিত্যের একটা সুলক্ষণ বলে মনে করিদশে মিলে যে-জমি তৈরি করে যাচ্ছেন, তার উপরেই ভবিষ্যতে কাব্যের যথার্থ ফুল ফুটবেআজকের দিনে বহু লেখকের রচিত গল্প যে কাব্য নয়, তার কারণ তাদের কল্পনা তেমন পরিস্ফুট ও পরিচ্ছিন্ন নয়কিন্তু এই নব সাহিত্যকে আর এক হিসাবে দেখা যেতে পারেগল্প-সাহিত্য থেকে জাতির নব মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়

যারা সামাজিক জীবনের উপর সাহিত্যের ফল সু কি কুতা-ই বিচার করতে যানতাঁরা সামাজিক লোক ভবিষ্যতে বেশি সুখী হবে কি দুঃখী হবেতারই হিসেব করতে ব্যস্ত। এ ভাবনা সম্পূর্ণ বৃথা। কারণসুখ-দুঃখ পৃথিবীতে চিরকাল ছিলআজও আছে এবং চিরকাল থাকবে। বদল হয় শুধু তার নামরূপের


আমরা যদি এই সাহিত্যকে আমাদের মনের শুধু দলিল হিসেবে দেখি, তা হলে দেখতে পাই যে, এর অন্তরে একটি নুতন আকাঙক্ষা ফুটে উঠেছেযে-আকাঙক্ষা হচ্ছে মুক্তির আকাঙক্ষাআমাদের জীবন নানা প্রকার চিরাগত আচার ও সংস্কারে বদ্ধবাঁধাধরা আচার-বিচারের হাত থেকে মুক্তিলাভের কল্পনাই এই নব-সাহিত্যের মূল কল্পনাএ সাহিত্য আকারে কতকটা বস্তুতান্ত্রিক হলেও, বাস্তব জীবনের প্রতিকৃতি নয়কেননা, নব-সাহিত্যের কল্পনা বাস্তব জীবনের epiphenomenon নয়, তার থেকে বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণ উড়ো কল্পনাযে-কল্পনার ভিত্তি জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তা কখনও কাব্যের সামগ্রী হতে পারে নাকিন্তু আমাদের যুবকরা আজ যে-স্বপ্ন নিজেরা দেখছেন, সে স্বপ্ন তাঁরা বহু লোককে দেখাচ্ছেনফলে জাতির মন এই সব নুতন স্বপ্নে ভরে উঠবেএর ফল আমাদের সামাজিক জীবনের উপর যা-ই হোক, আমাদের মানসিক জীবনের সুর এক পর্দা চড়িয়ে দেবেযারা সামাজিক জীবনের উপর সাহিত্যের ফল সু কি কু, তা-ই বিচার করতে যান, তাঁরা সামাজিক লোক ভবিষ্যতে বেশি সুখী হবে কি দুঃখী হবে, তারই হিসেব করতে ব্যস্তএ ভাবনা সম্পূর্ণ বৃথাকারণ, সুখ-দুঃখ পৃথিবীতে চিরকাল ছিল, আজও আছে এবং চিরকাল থাকবেবদল হয় শুধু তার নামরূপেরসুখ-দুঃখ মনের জিনিস এবং মনই প্রতি যুগে তার বিভিন্ন রূপ দেবেসে যা-ই হোক, সাহিত্যের স্বাভাবিক স্ফূর্তি নষ্ট করে তার স্বাস্থ্যরক্ষার চেষ্টা কত দূর যুক্তিসঙ্গত, তা আপনারাই বিবেচনা করবেন

২১

আমি এতক্ষণ ধরে আপনাদের কাছে যে বাগ্‌বিস্তার করলুম, তার ভিতর হয়তো কোন সার কথা নেইআমি এ সভায় কোন নব-বাণী ঘোষণা করবার জন্য উপস্থিত হইনি, এসেছি শুধু আপনাদের আতিথ্য গ্রহণ করতে এবং সেই উপলক্ষে আপনাদের পাঁচ জনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতেসুতরাং আমার কথা যথাসাধ্য আলাপের অনুরূপ করতে চেষ্টা করেছিযদি অনেক বাজে কথা বলে থাকি তো সে প্ৰগলভতা আপনারা নিজগুণে মার্জনা করবেন

পৃথিবীতে ধর্মসাহিত্য বলে এক জাতীয় সাহিত্য আছেযা ধর্মের মন্ত্রভাগ নয়আর পলিটিকাল সাহিত্য বলেও এক জাতীয় সাহিত্য আছেযা পলিটিকসের যন্ত্রভাগ নয়এ রাজ্যে প্রকাশই প্রচারকেননাসাহিত্য আলোকধর্মী। আর আলোর ধর্মই এই যেতা আপনা হতেই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে


প্রাচীন আলঙ্কারিকদের মতে, সাহিত্যের কথা সুহৃৎ-সম্মিত বাণী, প্রভুসম্মিত বাণী নয়এ মত আমি চিরকালই প্রসন্ন মনে গ্রাহ্য করে এসেছিপ্রভুসম্মিত বাণী অর্থাৎ আদেশই সংক্ষিপ্ত হয়আজ্ঞা প্রচার করবার অধিকার শুধু ধর্মগুরুদের ও রাজপুরুষদেরই আছেযারা লোকমান্যও নয়, রাজমান্যও নয়, তাদের অর্থাৎ আমাদের মতো সাহিত্যিকদের সে অধিকার নেইতাই আমরা আমাদের বাণী এমন কোন মন্ত্রাকারে প্রকটিত করতে পারিনে, যে-মন্ত্র জপ করে লোক মোক্ষলাভ করবে; এমন কোন সূত্রাকারে পরিণত করতে পারিনে, যে-সূত্র লোক ভক্তিভরে বক্ষে ধারণ করে দ্বিজত্ব লাভ করবে

মন্ত্র রচনা করা ও সূত্র রচনা করা হচ্ছে ধর্মপ্রচারক ও পলিটিকাল প্রচারকদের ব্যবসাসত্য কথা এই যে, সাহিত্যজগতে কোন প্রচারক নেই এবং থাকতে পারে নাএ রাজ্যে যিনি যে-মুহুর্তে প্রচারকার্য শুরু করেন, তিনি তন্মুহুৰ্ত্তে সরস্বতীর রাজ্য হতে নির্বাসিত হন স্বাধিকার প্রমত্ততার অপরাধেএর কারণ, সাহিত্য কোন বিষয় প্রচার করে না, সব জিনিসই প্রকাশ করেতাই পৃথিবীতে ধর্মসাহিত্য বলে এক জাতীয় সাহিত্য আছে, যা ধর্মের মন্ত্রভাগ নয়, আর পলিটিকাল সাহিত্য বলেও এক জাতীয় সাহিত্য আছে, যা পলিটিকসের যন্ত্রভাগ নয়; এ রাজ্যে প্রকাশই প্রচার, কেননা, সাহিত্য আলোকধর্মীআর আলোর ধর্মই এই যে, তা আপনা হতেই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে

২২

বঙ্গ-সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমার মনে একটা মস্ত বড় আশা আছে; সে আশা যে দুরাশা নয়, আপনাদের কাছে তা-ই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কৃতকার্য হয়েছি কি না, বলতে পারিনেমনে রাখবেন, ভবিষ্যৎ বিষয়ের কোন বর্তমান প্রমাণ নেইসে বিষয়ে আমাদের আশাই একমাত্র প্রমাণ

মানুষের ভাষা একটা স্রোত, মানুষের মনও একটি স্রোত; এবং এই দুই স্রোতে মিলে যে-স্রোতের সৃষ্টি করে, তার নাম সাহিত্য-স্রোতঅবশ্য এ স্রোতের অন্তরে কখনও আসে জোয়ার, কখনও ভাটাআমার বিশ্বাস, আমাদের সাহিত্যের অন্তরে এখন জোয়ার এসেছেসুতরাং বঙ্গ-সাহিত্যের বর্তমান একটা শুভলগ্ন
  রামপ্রসাদ বলেছেন যে
"প্রসাদ বলে থাক ব'সে ভবার্ণবে ভাসিয়ে ভেলা
(যখন) জোয়ার আসবে উজিয়ে যাবে,
ভাটিয়ে যাবে ভাটার বেলা ৷"

ধর্মের দিক থেকে দেখতে গেলে, এ উপদেশ যে খুব বড় কথা, তা আমি মানিএ হচ্ছে ভগবানে আত্মসমর্পণের চরম উক্তিআর দর্শনের দিক থেকে দেখতে গেলেও দেখা যায় যে, এ সত্য কথামানুষের আকাশ-জোড়া অহঙ্কার নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়, যখন সে জানতে পারে যে, মানুষের ক্ষুদ্র অহং সৃষ্টিপ্রবাহের উপরে ভাসমান খড়কুটো মাত্র। "যতো বাচো নিবৰ্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ"—সেই অনন্ত রহস্যের ভাবনায় অভিভূত হলে মানুষের সকল ক্রিয়াশক্তি একদম পঙ্গু হয়ে পড়েতাই মানবজীবনের কোন ব্যাপারেই রামপ্রসাদের উপদেশ গ্রাহ্য নয়, সাহিত্যিক জীবনেও নয়মানুষকে জোয়ারের সময় ভেটিয়ে যেতে হয়, ভাটার সময়েও উজিয়ে যেতে হয়, যদি তার কোন নিদিষ্ট গম্য স্থান থাকেআমরা যদি বঙ্গ-সাহিত্যের স্বরাজ্য লাভ করতে চাই তো আমাদের হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে চলবে নাকে জানে কখন আবার ভাটা আসবে? বর্তমান জোয়ারের উপর বেশি ভরসা রাখা যায় নাকেননা, তা এসেছে বাইরে থেকেআমরা যাতে এ জোয়ার চলে গেলে কাদায় না পড়ি, তার জন্য বঙ্গ-সাহিত্যে আমাদের অন্তরের জোয়ার বওয়াতে হবেতা বওয়ানো, সম্পূর্ণ আমাদের ইচ্ছাসাপেক্ষএ ইচ্ছা আমাদের মনে জন্মলাভ করেছে, এখন তাকে শক্তসমর্থ করবার দায়িত্ব সমগ্র বাঙ্গালি জাতির হাতেআশা করি, এ দায়িত্ব সম্বন্ধে আমরা বাঙ্গালিরা উদাসীন হব না,— "কি স্বদেশে কি বিদেশে যথায় তথায় থাকি।"


সূত্র : প্রমথ চৌধুরী || অগ্রন্থিত রচনা - ১
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেইওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন