অ ভি ভা ষ ণ
৮ম খণ্ড
১৮
১৬
আমি এখন বঙ্গ-সাহিত্যের যথার্থ কাব্যাংশের কথা ছেড়ে দিয়ে তার
অপরাংশের প্রতি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। বঙ্গ-সাহিত্য শুধু
উঁচু দিকে বাড়ছে না, সেই সঙ্গে তার সর্বাঙ্গীণ উন্নতি হচ্ছে।
আমি অবশ্য এ কথা বলতে চাইনে যে, ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে হেরডোটাস, থুসিডিডিস, লিভি, ট্যাসিটাস প্রভৃতির আবির্ভাব হয়েছে। আমার বক্তব্য এই যে, বাঙ্গালিতে যখন ইতিহাস রচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছে, তখন ভবিষ্যতে বাঙ্গালায় নব গিবন-মমসেনের জন্মের আশা আমরা করতে পারি।
এ ভাষায় বহু লোক আজ
ইতিহাস রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। আজকের দিনে দেশের ইতিহাসের পরিচয় লাভ করতে হলে আমাদের আর পরের
ভাষার দ্বারস্থ হতে হয় না, আমি অবশ্য এ কথা বলতে চাইনে যে, ইতিমধ্যেই
আমাদের দেশে হেরডোটাস, থুসিডিডিস,
লিভি,
ট্যাসিটাস প্রভৃতির আবির্ভাব হয়েছে। আমার বক্তব্য এই যে, বাঙ্গালিতে
যখন ইতিহাস রচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছে, তখন ভবিষ্যতে বাঙ্গালায় নব গিবন-মমসেনের জন্মের
আশা আমরা করতে পারি।
য়ুরোপে essay
নামক এক শ্রেণীর সাহিত্য আছে, যার বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞান, দর্শন, কাব্য, অলঙ্কার
ইত্যাদি। এ শ্রেণীর সাহিত্যও বাঙ্গালাভাষায় স্থান পেয়েছে। আমাদের রচিত essay প্রভৃতির মূল্য যে কী, সে প্রশ্নের উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ । যদি কালক্রমে সে সব
বিস্মৃতির অতলগর্ভে নিমজ্জিত হয়,
তা হলেও বলতে হবে যে, সে সব লেখা একেবারে ব্যর্থ হয়নি। কারণ, এই সব লেখাই
এ সত্যের দলিল যে আমাদের মন আজ সজাগ হয়েছে এবং সেই সঙ্গে আমাদের মুখও ফুটেছে। বাঙ্গালির আজ অনেক
বিষয়ে অনেক কথা বলবার আছে, এবং সে কথা তারা স্পষ্ট করে বলতে শিখেছে। মনের বহু অব্যক্ত ভাব
আজ ভাষায় ব্যক্ত হয়ে উঠেছে।
১৭
যাকে মানুষ কাজের কথা বলে, তা-ও সাহিত্যের বিষয়ীভূত
হয়। ধরুন, এই পলিটিকসের কথা। আজকের দিনে অনেকের
বিশ্বাস এই যে, এর চাইতে বড় কাজের কথা ভূভারতে নেই। বাঢ়ম্ ! কিন্তু য়ুরোপীয়
সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই যে, দুখানি সাহিত্যগ্রন্থ
যুগ-যুগ ধরে সে দেশের পলিটিকাল মানের উপর প্রভুত্ব করেছে। মাকিয়াভেলির Prince এবং Rousseau's Social Contract হচ্ছে সে ভূভাগের পলিটিকাল চিন্তার পূর্ব-মীমাংসা আর উত্তর-মীমাংসা।
পলিটিকসের কথা আমাদের মুখের কথাই থেকে যাবে, প্রাণের কথা হবে না, যত দিন না তা বঙ্গ-সাহিত্যের অন্তর্ভূত হয়। কাজের কথা জ্ঞানের দ্বারা, পরিচ্ছিন্ন বুদ্ধির দ্বারা পরিষ্কৃত ও হৃদয়-রাগে রঞ্জিত না হলে তা সাহিত্যে স্থান পায় না।
গত দু'শো বৎসরেব ভিতর য়ুরোপে
কম করেও দু'লক্ষ পলিটিকসের গ্রন্থ জন্মগ্রহণ করেছে; কিন্তু সে সব গ্রন্থই
ও-দুখানি বইয়ের হয় অনুবাদ, নয় প্রতিবাদ— আর না হয় তো ও-দুই
মতবাদের একটা মীমাংসা মাত্র। এর কারণ কী ?— কারণ এই যে, মাকিয়াভেলি ও রুশো, উভয়েই মানুষের পলিটিকাল
মনের অন্তর্নিহিত প্রকৃতির মর্ম উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছিলেন। সুতরাং যা আপাতদৃষ্টিতে
কাজের কথা মাত্র, তা তাদের কাছে মানব-মনের চিরন্তন ভাবের কথা
হয়ে উঠেছে। যার কথা কর্মের অন্তর্নিহিত ধর্মের সন্ধান আমাদের দেয়, তাঁর কথাই অমরত্ব লাভ করে। এর থেকে অনুমান করা
যায় যে, পলিটিকসের কথা আমাদের মুখের কথাই থেকে যাবে, প্রাণের কথা হবে না, যত দিন না তা বঙ্গ-সাহিত্যের
অন্তর্ভূত হয়। কাজের কথা জ্ঞানের দ্বারা, পরিচ্ছিন্ন বুদ্ধির
দ্বারা পরিষ্কৃত ও হৃদয়-রাগে রঞ্জিত না হলে তা সাহিত্যে স্থান পায় না। পরের কাছ থেকে ধার
করা মনোভাব আমাদের শুধু উত্তেজিত করতে পারবে, কিন্তু আমাদের আত্মশক্তি
প্রস্ফুটিত করতে পারবে না, যত দিন না সে ভাবকে
অন্তরের বকযন্ত্রে চুঁইয়ে আমরা আমাদের মনের রক্তমাংসে পরিণত করতে পারি। যে-অন্তর্গূঢ় রাসায়নিক
প্রক্রিয়ার বলে আমরা পরমনোভাবকে অন্তরঙ্গ করতে পারব, সেই প্রক্রিয়ার ফলে এ বিষয়ে নব সাহিত্যের সৃষ্টি হবে। পলিটিকস যে কবে বঙ্গ-সাহিত্যের
অন্তর্ভুক্ত হবে, তা বলা কঠিন। কারণ, তার আগে তা বঙ্গভাষার অন্তৰ্ভুক্ত হওয়া চাই। ও-বস্তু আজও সম্পূর্ণ
ইংরাজির দখলে। এ দেশের পলিটিকসকে মনের ধনে
পরিণত করতে হলে তাকে এই পর-ভাষার অধীনতা থেকে মুক্ত করতে হবে। যত দিন আমরা তা করতে
না পারি, তত দিন তা খবরের কাগজের দখলেই থেকে যাবে, অর্থাৎ তা হবে যুগপৎ অনুকরণ ও অনুবাদ। সংক্ষেপে জ্ঞানমার্গের
ও কর্মমার্গের সকল বিষয়ই আমাদের ভাষার অন্তর্ভূত করতে হবে, নচেৎ বঙ্গ-সাহিত্য সম্পূর্ণ আত্ম-প্রতিষ্ঠিত হবে না।
জর্মান দেশের বর্তমান যুগের সুপ্রসিদ্ধ মনস্তত্ত্ববিদ্ ফ্রয়েড
আবিষ্কার করেছেন যে, মানুষের যথার্থ মনের
কথা তার সজ্ঞান মনের কথা নয়; সে কথা তার মনের গোপন কথা। আর সে কথা ধরা পড়ে তার স্বপ্নে, তার জ্ঞানমূলক
কর্মে নয়। কথাটা শুনতে যতটা নতুন শোনায়, আসলে কিন্তু
ততটা নতুন নয়। যুগ-যুগ ধরে বহু লোকের মনে এ সত্যের একটা অস্পষ্ট ধারণা যে ছিল, তার পরিচয়
বিশ্বসাহিত্যে পাওয়া যায়। সে যা-ই হোক,
ফ্রয়েডের মত যে মূলত সত্য, সে বিষয়ে য়ুরোপের বর্তমান দার্শনিকদের মধ্যে
দ্বিমত নেই।
আজকের দিনে এলিজাবেথের যুগের ইংরাজি মনের সন্ধান জানবার জন্য আমরা যেমন Bacon-এর দ্বারস্থ হইনে, হই Shakespeare-এর; ভবিষ্যতে লোক তেমনই অতীত বাঙ্গালি-মনের পরিচয় লাভ করবার জন্য রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হবে, এ যুগের কোন জ্ঞানীর শরণাপন্ন হবে না। আবার আমরাও যদি আমাদের জাতের ভবিষ্যৎ মানসিক প্রকৃতির বিষয়ে কৌতুহলী হই, তা হলেও আমাদের বর্তমান সাহিত্যের প্রবৃদ্ধ নব-ধারার দিকে নজর দিতে হবে !
যেমন ব্যক্তিবিশেষের, তেমনই জাতিবিশেষেরও যথার্থ মনের কথা তার কাব্য
থেকেই জানা যায়; কারণ,
কাব্য হচ্ছে তার কল্পনার সৃষ্টি— ভাষান্তরে
তার দিবাস্বপ্নের ভাষায় গড়া প্রত্যক্ষ মূর্তি। আমরা প্রত্যেকেই যখন
স্বপ্ন দেখি, তখন আমাদের সুষুপ্ত মন কাব্য রচনা করে। সে ক্ষণস্থায়ী ও অস্পষ্ট
কাব্যের সঙ্গে সাহিত্যের কাব্যের প্রভেদ এই যে, এ কাব্য সুস্পষ্ট আর চিরস্থায়ী।
বাঙ্গালির মনের বিশেষ প্রকৃতি ও গতির যদি পরিচয় নিতে হয় তো
তা নিতে হবে বাঙ্গালির রচিত গল্প ও গান থেকে। আজকের দিনে এলিজাবেথের
যুগের ইংরাজি মনের সন্ধান জানবার জন্য আমরা যেমন Bacon-এর দ্বারস্থ হইনে, হই Shakespeare-এর; ভবিষ্যতে লোক তেমনই অতীত বাঙ্গালি-মনের পরিচয় লাভ করবার জন্য
রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হবে,
এ যুগের কোন জ্ঞানীর শরণাপন্ন হবে না। আবার আমরাও যদি আমাদের
জাতের ভবিষ্যৎ মানসিক প্রকৃতির বিষয়ে কৌতুহলী হই, তা হলেও আমাদের বর্তমান সাহিত্যের প্রবৃদ্ধ
নব-ধারার দিকে নজর দিতে হবে !
১৯
আধুনিক বঙ্গ-সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রথমেই নজরে পড়ে
যে, এ যুগে যা অপর্যাপ্ত পরিমাণে জন্মাচ্ছে, তা হচ্ছে
গল্প। আমি পূর্বেই বলেছি যে, যুগধর্ম অনুসারে পৃথিবীর সাহিত্য-রাজ্য এ
যুগে গল্পের অধিকারে আসছে। এ সব গল্পের গুণ বিচার না করেও এ কথা বলা যায় যে, এ ব্যাপার
আমাদের আশার কথা। যে-জমিতে ফসল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়, সে জমি যে
উর্বর, সে বিষয়ে তো আর সন্দেহ নেই ! এই গল্প-সাহিত্যের প্রয়োজনাতীত
উৎপত্তিই প্রমাণ যে, বাঙ্গালির মনের জমি দিন-দিন বেশি উর্বর হয়ে উঠছে।
এই গল্প-সাহিতের প্রতিপত্তি দেখে অনেকে ভয় পান। তাঁদের ধারণা যে, গল্পসাহিত্যের
স্ফূর্তি সৎ সাহিত্যের পক্ষে ক্ষতিকর। আগাছার উপদ্রবে যেমন ভালো গাছ মারা যায়, তেমনই সাহিত্যের
এই আগাছা উঁচুদরের সাহিত্য বলে যদি কোন সাহিত্য থাকে, তো কোন রূপ পারিপার্শ্বিক নীচু সাহিত্য তার
বিনাশসাধন করতে পারবে না। যে-সাহিত্য সকল বাধা অতিক্রম করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে
না ও মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারে না, তা উঁচুদরের সাহিত্য নয়।
আমাদের মাসিকপত্রে মাস-মাস যত গল্প বিকশিত হয়, তা সবই কাব্য-কুসুম। তার বেশির ভাগই কাগজের ফুল, অর্থাৎ তাতে প্রাণ নেই, মন নেই, আর সম্ভবত এ জাতীয় অনেক ফুল বিলেতি কাগজ কেটে বানানো। তবে পৃথিবীর কোন সাহিত্যের এই একই অবস্থা নয় ? আমার বিশ্বাস, সকল সাহিত্যেই অমূল্য কাব্যের সংখ্যা অতি কম, আর যার কোন মূল্য নেই, তাই অসংখ্য। অসাধারণকে সাধারণ করা তেমনই অসম্ভব, সাধারণকে অসাধারণ করা যেমন অসম্ভব।
গল্প-সাহিত্যের যে অনেকের কাছে যথোচিত মান্য নেই, তার একটি কারণ এই যে, অনেকের বিশ্বাস, ও-শ্রেণীর সাহিত্য রচনা করা অতি সহজ। ঠুংরি যে সঙ্গীত-রাজ্যে
উচ্চপদ লাভ করেনি, তারও কারণ এই যে, অনেকের ধারণা, ও-গান গাওয়া অতি সহজ; কারণ, ঠুংরি শেখবার জন্য তাদৃশ কঠিন পরিশ্রম করতে হয় না, যতটা করতে হয় ধ্রুপদ শিক্ষা করবার জন্য। কথা সত্য, কিন্তু সঙ্গীত বা সাহিত্য এর কোনটিরই শ্রেষ্ঠত্ব, কে কতটা মেহন্নত করেছে, তার উপর নির্ভর করে
না; নির্ভর করে রচয়িতার স্বাভাবিক ক্ষমতার উপর, শাস্ত্রে যাকে বলে প্রাক্তন সংস্কার, তারই সদ্ভবের উপর। সঙ্গীতপ্রাণ শ্রোতা মাত্রেই জানে যে, যথার্থ ঠংরি শুধু সেই গাইতে পারে— যার ভগবদ্দত্ত গলা আছে, আর সেই সঙ্গে আছে সুরেলা
কান ও সুরেলা প্রাণ। লোককে মেরেপিটে হয়তো চলনসই অর্থাৎ অচল ধ্ৰুপদী বানানো যেতে
পারে, কিন্তু ও-উপায়ে ঠুংরি-গায়ক বানানো যায় না। ও-বস্তু যেমন-তেমন
করে গাওয়া যেমন সহজ, ভালো করে গাওয়া তেমনই
কঠিন।
পৃথিবীর সাহিত্যে গল্পের প্রাচুর্য দেখেই লোকের মনে এ ভুল ধারণা
জন্মেছে, এবং তার ফলে অনেক লেখকও স্বধৰ্মভ্রষ্ট হয়েছেন। যিনি উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ
লিখতে পারেন, তিনি তা না লিখে যে নিকৃষ্ট গল্প লিখছেন, অর্থাৎ গল্প-সাহিত্যের শরৎচন্দ্র হতে গিয়ে নষ্টচন্দ্র হচ্ছেন,— এর দৃষ্টান্ত বঙ্গ-সাহিত্যে বিরল নয়। কথায় বলে, 'গলা নেই গান গায় মনের আনন্দে।' এ রূপ আনন্দধ্বনিও বাঙ্গালায় নিত্য শোনা যায় এবং সে ধ্বনি
অবশ্য শ্রোতার আনন্দবর্ধন করে না।
এই সব কারণে আমি বঙ্গ-সাহিত্যের তরফ থেকে এ দাবি করতে পারিনে
যে, আমাদের মাসিকপত্রে মাস-মাস যত গল্প বিকশিত হয়, তা সবই কাব্য-কুসুম। তার বেশির ভাগই কাগজের ফুল, অর্থাৎ তাতে প্রাণ
নেই, মন নেই, আর সম্ভবত এ জাতীয়
অনেক ফুল বিলেতি কাগজ কেটে বানানো। তবে পৃথিবীর কোন সাহিত্যের এই একই অবস্থা নয় ? আমার বিশ্বাস, সকল সাহিত্যেই অমূল্য
কাব্যের সংখ্যা অতি কম, আর যার কোন মূল্য নেই, তাই অসংখ্য। অসাধারণকে সাধারণ করা তেমনই অসম্ভব, সাধারণকে অসাধারণ করা যেমন অসম্ভব।
সূত্র : প্রমথ চৌধুরী || অগ্রন্থিত রচনা - ১
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেই, ওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন