:::: সূচীপত্র ::::
অ ভি ভা ষ ণ
৭ম খণ্ড


১8

আমি এতক্ষণ ধরে আপনাদের কাছে ভাষার বিষয় যে বক্তৃতা করলুম, তার কারণ মানুষের ভাষা তার মনের পরিচয় দেয়আমরা যাকে ভাষার উন্নতি-অবনতি বলি, তা মনের উন্নতি-অবনতির বাহ্য নিদর্শন মাত্রকোন জাতির ভাষা যখন নবরূপ ধারণ করে, তখন বুঝতে হবে যে, সে জাতির মনও নব কলেবর ধারণ করেছেতা ছাড়া ভাষার আলোচনা করা সহজভাষা ভাবের স্থূল দেহ, সূক্ষ্ম শরীর নয়; আর সকলেই জানেন যে, পৃথিবীর সব জিনিসের স্থূল দেহ নিয়েই নাড়াচাড়া করা সহজ, কারণ তা ধরাছোঁয়ার বস্তুকোন পদার্থের সূক্ষ্ম শরীর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, মনোগ্রাহ্যতাই কাব্যবস্তু কী, তার বিচার করতে হলে দর্শনের রাজ্যে ঢুকতে হয়এ ক্ষেত্রে সে আলোচনায় হস্তক্ষেপ করা আমার পক্ষে অনধিকারচর্চা হবে; কারণ আমি এ সভার দার্শনিক শাখার সভাপতি নইআর যদি বিদ্যা দেখাবার লোভে সে আলোচনায় প্রবৃত্ত হই, তা হলেও ধৈর্য ধরে আপনারা তা শুনতে পারবেন নাবাজারে গুজব এই যে, হিন্দু মাত্রেই দার্শনিকযদি এ কথা সত্য হয়, তা হলে তার অর্থ আমরা জাতকে জাত স্বভাব-দার্শনিক, স-তর্ক দার্শনিক নইকিন্তু এ যুগের দর্শনের টানা-পড়েন দুই সমান তর্কে বোনা

কোন বিষয়ে অক্ষমতা অপর কোন বিষয়ে ক্ষমতার পরিচায়ক নয়। উপরি উক্ত কু-সংস্কারের মূলে আছে এই ধারণা যেকাব্যের সঙ্গে জীবনের কোন সম্বন্ধ নেই। এ কথা সত্য হতযদি জীবন মনের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত হত। তা যে নয়তা সকলেই জানেন। আর মন অর্থ যে শুধু ব্যবহারিক মন নয়তার প্রমাণকর্ম দিয়ে আমরা সকল জীবন ভরাট করে দিতে পারিকিন্তু সমগ্র মন পূর্ণ করতে পারিনেতার অনেকটা শূন্য থেকে যায়। 


আপনারা বোধ হয় জানেন যে, এ কালে আমরা যাকে সাহিত্য বলি, সংস্কৃত ভাষায় তার নাম ছিল কাব্যএই 'সাহিত্য' শব্দ বাঙ্গালায় কোথা থেকে এল, জানিনেও-শব্দ সম্ভবত সুপ্রসিদ্ধ আলঙ্কারিক গ্রন্থ সাহিত্য-দর্পণের মলাট থেকে উড়ে এসে বাঙ্গালা সাহিত্যের অন্তরে জুড়ে বসেছে

কাব্য ও সাহিত্য, এ দুটি শব্দের যে শুধু নামের প্রভেদ আছে তা-ই নয়, ও-দুয়ের অর্থেরও বিস্তর প্রভেদ আছেকাব্যের চাইতে সাহিত্যের এলাকা ঢের বেশি বিস্তৃতকাব্য বলতে বোঝায় শুধু কবিতা ও আখ্যায়িকাসাহিত্য বলতে আমরা ইতিহাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি নানা রকমের রচনা বুঝিঅবশ্য গল্প ও কবিতা আজও সাহিত্যের অন্তর্ভূত হয়ে রয়েছে; শুধু যে রয়েছে, তা-ই নয়, কবিতা না হোক, গল্প আজ সাহিত্যরাজ্যের অনেকখানি অংশ অধিকার করেছেপৃথিবীর সকল লিখিয়ে দেশেই দেখা যায় যে, গল্প-সাহিত্যের প্রসার ও প্রচার দিন-দিন শুধু বেড়েই চলেছে; সুতরাং খুব সম্ভব, তা বাঙ্গালা দেশেও কালক্রমে একটা প্রকাণ্ড কাণ্ড হয়ে উঠবে


১৫

এই বিপুল পৃথিবী ও নিরবধি কালের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করুন, দেখতে পাবেন যে, যাঁরা সাহিত্যজগতের মহাপুরুষ বলে মানবসমাজে গণ্য হয়েছেন, তারা সকলেই হয় কবি, নয় গল্প-রচয়িতা; আর সেই ব্যক্তিকেই আমরা মহাকবি বলি, যিনি একাধারে ও-দুই

কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে, এ যুগে কাব্য সম্বন্ধে একটা কু-সংস্কারের পরিচয় প্রায়ই পাওয়া যায়যাঁরা নিজেদের কাজের লোক বলে মনে করেন, অথবা তা-ই বলে প্রমাণ করতে চান, তাঁরা ফাঁক পেলেই বলেন যে'আমরা কবিতা-ফবিতা বুঝিনে।' সম্ভবত তাঁরা সত্য কথাই বলেন, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে সকল সত্য প্রচার করা তো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক নয়মানুষ সেই ভাবেই মানুষের কাছে আত্মপরিচয় দিতে উৎসুক, যাতে তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেওয়া হয়সুতরাং আমি কবিতা বুঝিনে এ কথা অহঙ্কারের সুরেই বলা হয়ে থাকেঅর্থাৎ বক্তা 'কবিতা বুঝিনে', এই কথার দ্বারা প্রমাণ করতে চান, তিনি কাজ বোঝেন; যেমন অনেকে 'বাঙ্গালা ভালো জানিনে', এ কথা বলেন শুধু এই প্রমাণ করতে যে, তিনি ইংরাজি খুব ভালো জানেনউভয়েই এরূপ উক্তির দ্বারা সমান সুবিবেচনার পরিচয় দেনবলা বাহুল্য, কোন বিষয়ে অক্ষমতা অপর কোন বিষয়ে ক্ষমতার পরিচায়ক নয়উপরি উক্ত কু-সংস্কারের মূলে আছে এই ধারণা যে, কাব্যের সঙ্গে জীবনের কোন সম্বন্ধ নেইএ কথা সত্য হত, যদি জীবন মনের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত হততা যে নয়, তা সকলেই জানেনআর মন অর্থ যে শুধু ব্যবহারিক মন নয়, তার প্রমাণ, কর্ম দিয়ে আমরা সকল জীবন ভরাট করে দিতে পারি, কিন্তু সমগ্র মন পূর্ণ করতে পারিনে; তার অনেকটা শূন্য থেকে যায়মানব-মনের সকল ক্রিয়াশক্তি তার সংসার-বাসনার দ্বারা গণ্ডিবদ্ধ নয়তা যদি হত, তা হলে মানবসমাজে ধর্ম বলেও কোন জিনিসের সৃষ্টি হত নাবিষয়ে নির্লিপ্ত এবং দৈনন্দিন সাংসারিক ভাবনা থেকে মুক্ত মানবী শক্তির লীলাই আর্ট, ধর্ম, কাব্য প্রভৃতি রূপে প্রকাশ পায়আমরা প্রতি জনেই এ জাতীয় সৃষ্টির কর্তা না হই, ভোক্তা তো বটেইকাব্য মনের এই অতিরিক্ত ও মুক্ত অংশেরই খোরাকসে অংশটা অনেক কল্পনা, স্বপ্ন দিয়ে ভরিয়ে রাখতে হয়যাঁরা মানব-মনের সেই সব অস্পষ্ট ও অনিত্য কল্পনাকে স্পষ্ট করে ব্যক্ত করতে পারেন, তাঁরাই কবি

আর যদি ধরেই নেওয়া যায় যে, জীবনের সঙ্গে কাব্যের কোনই সম্বন্ধ নেই, তা হলে জিজ্ঞাসা করি যে, আমাদের দৈনিক কর্মজীবন কি এতই সুন্দর, এতই মনোরম ও এতই প্রিয় যে, আমরা এক দণ্ডের জন্যও তা ভুলে থাকতে পারিনে? কাব্যের আর কোন গুণ না থাকুক, অন্তত এই মহাগুণ আছে যে, তা অন্তত দু'দণ্ডের জন্যও আমাদের কর্মক্লিষ্ট জীবনের ভাবনা ভুলিয়ে দিতে পারে

আর এক শ্রেণীর লোক আছেন, যাঁরা মহা লোকহিতৈষী; সমাজের অর্থাৎ পরের কীসে উপকার হয়, সেই ভাবনাতেই তাঁরা মশগুলযে-সাহিত্য সমাজের ধরা-ছোয়ার মতো কাজে লাগে, তদতিরিক্ত সাহিত্যকে তাঁরা অবজ্ঞার চক্ষুতে দেখেনসকলেই জানেন যে, তেল নামক পদার্থটা সমাজের বহুতর কাজে লাগে, যথা খেতে, মাখতে, কল চালাতে, চাকায় দিতে এমনকী, progress-এর চাকাতেওতাই এঁরা কবিদের সমাজের ঘানিতে জুড়ে দিতে চান আর তাতে যে গররাজি হয়, তাকে সৌখিন, বিলাসী, অলস, অকর্মণ্য ইত্যাদি বিশেষণে বিশিষ্ট করেনএঁদের কথার উত্তর দেওয়া বৃথা, কেননা জনগণ সে কথা কানে তুলবে নাকারণ, তেল আমাদের সকলেরই চাই; সুতরাং তা যোগানো যে মহৎ কার্য, সে বিষয়ে তো আর সন্দেহ নেই

তবে সামাজিক জীবনের উপর কাব্যের প্রভাব যে কী, তা আমাদের জীবনের উপর রামায়ণ ও মহাভারত নামক দুখানি কাব্যের প্রভাবের বিষয় চিন্তা করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন

সত্য কথা এই যে, আমাদের স্পষ্ট ইচ্ছা ও ব্যক্ত বাসনাই আমাদের পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করেমানুষের অসাংসারিক মনই মানুষকে মানুষের সঙ্গে এক সূত্রে আবদ্ধ করেআমাদের জীবনের মূলে যা আছে, তা তেল নয় রসজীবনের এই মূল ধাতু নিয়েই কবির কারবারবঙ্গসাহিত্য কাব্যে যে অপূর্ব গৌরবান্বিত হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ বাঙ্গালার রবি আজ সমগ্র সভ্য জগৎকে উদ্ভাসিত করেছে



সূত্র : প্রমথ চৌধুরী || অগ্রন্থিত রচনা - ১
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেইওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন