আসল কথা—আমাদের বহু কামনা নানা কারণে আমাদের অন্তরের গোপন কোণে নির্বাসিত হয়েছে, এবং তাদের অনেকে
উচ্চতর মনোবৃত্তিতে রূপান্তরিত হয়ে হৃদয় ফুঁড়ে বার হয়েছে। এতেই তাদের চরিতার্থতা। এইসকল মনোবৃত্তি সমাজের
পক্ষে হিতকর, তাই সমাজ তাদের সযত্নে পোষণ করে এবং সাহিত্যাদি কলায় তারা অনবদ্য
বলে গণ্য হয়। কিন্তু যেমন তেমন কামনার রূপান্তরগ্রহণের শক্তি নেই, তারা মাটিচাপা
পড়েও অহরহ ঠেলা দিচ্ছে। সমাজ বলছে—খবরদার, যদি ফুটতেই চাও তবে কমনীয় বেশে ফুটে ওঠ। কিন্তু নিগৃহীত কামনা
বলছে— ছদ্মবেশে সুখ নেই, আমি স্বমূর্তিতেই প্রকট হতে চাই; আমি পাষাণকারা
ভাঙব কিন্তু করুণাধারা ঢালা আমার কাজ নয়। হুঁশিয়ার রস-স্রষ্টা স্নেহশীল পিতার ন্যায় তাদের বলেন—বাপু-সব, তোমাদের একটু রৌদ্রে বেড়িয়ে আনব, কিন্তু সাজগোজ করে ভদ্রবেশ ধরে চল; আর বেশী দাপাদাপি
করো না। তৃষিত রসজ্ঞজন তাদের দেখে বলেন—আহা, কাদের বাছা তোমরা? কি সুন্দর, কিন্তু কেউ
কেউ যেন একটু বেশী দুরন্ত।
তাদের স্রষ্টা বুঝিয়ে দেন—এরা তোমার নিতান্তই অন্তরের ধন; ভয় নেই, এরা কিছুই নষ্ট করবে
না, আমি এদের সামলাতে জানি; এদের মধ্যে যে বেশী দুরন্ত তাকে আমি অবশেষে ঠেঙিয়ে দুরস্ত করে দেব, যে কম দুরন্ত তাকে অনুতপ্ত করব, যে কিছুতেই বাগ মানবে না তাকে নিবিড় রহস্যের জালে জড়িয়ে ছেড়ে দেব। দ্রষ্টার দল খুশী হয়ে
বলেন—বাঃ, এই তো আর্ট। কিন্তু দু একজন অরসিক এত সাবধানতা সত্ত্বেও
ভয় পান।
আর একদল রসস্রষ্টা তাঁদের আত্মজের প্রতি অতিমাত্রায় স্নেহশীল। তাঁরা এইসব নিগৃহীত
কামনাকে বলেন—কিসের লজ্জা, কিসের ভয় ?
অতি সাজগোজের দরকার কি, যাও, উলঙ্গ হয়ে রঙ মেখে নেচে এস। জনকতক লোলুপ রসলিপ্সু তাদের সমাদরে বরণ করে বলছেন—এই তো আসল আর্ট, আদিম ও চরম। কিন্তু সংযমী দ্রষ্টার
দল বলেন—কখনও আর্ট নয়, আর্টে আবিলতা থাকতে
পারে না; আর্ট যদি হবে তবে ওদের দেখে আমাদের এতজনের অন্তরে এমন ঘৃণা
জন্মায় কেন ? সমাজপতিরা বলেন—আর্ট-ফার্ট বুঝি না;
সমাজের আদর্শ ক্ষুন্ন হতে দেব না; আমাদের সব বিধানই যে ভাল এমন বলি না; যদি উৎকৃষ্টতর
বিধান কিছু দেখাতে পার তো দেখাও; কিন্তু তা যদি না পার তবে আত্মস্ফুর্তি বা
self-expression-এর দোহাই দিয়ে যে তোমরা সমাজকে উচ্ছৃঙ্খল
করবে, আমাদের ছেলেমেয়ে বিগড়ে দেবে, সেটি হবে না, আমরা আছি পুলিসও
আছে।
আর্টের প্রধান উপাদান রস, কিন্তু তার অন্য অঙ্গও আছে তাই আর্ট আরও জটিল। চিনি বিশুদ্ধ রসবস্তু, কিন্তু শুধু চিনি তুচ্ছ আর্ট। চিনির সঙ্গে অন্যান্য রসবস্তুর নিপুণ মিলনই আর্ট। কিন্তু যে সব উপাদান আমরা হাতের কাছে পাই তার সবগুলি অখন্ড রসবস্তু নয়, অল্পবিস্তর অবান্তর খাদ আছে। নির্বাচনের দোষে মাত্রাজ্ঞানের অভাবে অতিরিক্ত বাজে উপাদান এসে পড়ে, অভীষ্ট স্বাদে অবাঞ্ছিত স্বাদ জন্মায়। তার উপর আবার ভোক্তার পূর্ব অভ্যাস আছে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা আছে, ব্যক্তিগত রাগদ্বেষ আছে। এত বাধাবিঘ্ন অতিক্ৰম করে, ভোক্তার রুচি গঠিত করে কল্যাণের অন্তরায় না হয়ে, যাঁর সৃষ্টি স্থায়ী হবে, তিনিই শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা।
উক্ত দুই দল রসস্ৰষ্টার
মাঝে কোনও গণ্ডি নেই, আছে কেবল মাত্রাভেদ বা সংযমের তারতম্য। ক্ষমতার কথা ধরব না,
কারণ অক্ষম শিল্পীর হাতে স্বর্গের চিত্ৰও নষ্ট হয়, গুণীর হাতে নরকবর্ণনাও হৃদয়গ্রাহী হয়। কোন্ সীমায় সুরুচির
শেষ আর কুরুচির আরম্ভ তারও নির্ধারণ হতে পারে না। এক যুগ এক দল যাকে উত্তম আর্ট বলবে,
অপর যুগ অপর দল তার নিন্দা করবে, আর সমাজ চিরকালই আর্ট সম্বন্ধে অনধিকার চর্চা করবে।
বিধাতার রচনা জগৎ, মানুষের রচনা আর্ট। বিধাতা একা, তাই তাঁর সৃষ্টিতে আমরা নিয়মের রাজত্ব দেখি। মানুষ অনেক,
তাই তার সৃষ্টি নিয়ে এত বিতণ্ডা। এই সৃষ্টির বীজ মানুষের মনে নিহিত আছে,
তাই বোধহয় প্ৰতীচ্য মনোবিদের 'লিবিডো' আর ঋষিপ্রোক্ত 'কাম'—
কামস্তদগ্রে সমাবর্ততাধি মনসো রেতঃ প্ৰথমং
যদাসীৎ।
সতো বন্ধুমসতি নিরবিন্দন্ হৃদি প্রতীষ্যা কবয়ো মনীষা। (ঋগ্বেদ, ১০ম, ১২৯ সূ)
কামনার হল উদয় অগ্রে, যা হল প্ৰথম মনের বীজ।
মনীষী কবিরা পর্যালোচনা করিয়া করিয়া হৃদয় নিজ
নিরূপিলা সবে মনীষার বলে উভয়ের সংযোগের ভাব,
অসৎ হইতে হইল কেমনে সতের প্রথম আবির্ভাব।
(শ্ৰী শৈলেন্দ্ৰীকৃষ্ণ লাহা কৃত অনুবাদ)
ঋষি অবশ্য বিশ্বসৃষ্টির কথাই বলছেন,
এবং 'সৎ' ও 'অসৎ' শব্দের আধ্যাত্মিক অর্থই ধরতে হবে। কিন্তু সৎ-অসৎ-এর বাংলা অর্থ ধরলে এই সূক্তটি
আর্ট সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। ফ্ৰয়েডপন্থীর সিদ্ধান্ত অনুসারে অসদ্বস্তু কাম থেকে সদ্বস্তু
আর্ট উৎপন্ন হয়েছে। মনীষী কবিরা নিজ হৃদয় পর্যালোচনা করে হয়তো আপন অন্তরে আর্টের স্বরূপ উপলব্ধি
করছেন। কিন্তু জনসাধারণের
উপলব্ধি এখনও অস্ফুট। কি আর্ট, আর কি আর্ট নয়—বিজ্ঞান আজও নিরূপিত করতে
পারে নি, অতএব সুরুচি কুরুচি সুনীতি দুর্নীতির বিবাদ আপাতত চলবেই। যদি কোনও কালে আর্টের
লক্ষণ নির্ধারিত হয়, তাহলেও সমাজের শঙ্কা দূর হবে কিনা সন্দেহ।
রস কি তা আমরা বুঝি কিন্তু বােঝাতে পারি না। আর্টের প্রধান উপাদান
রস, কিন্তু তার অন্য অঙ্গও আছে তাই আর্ট আরও জটিল। চিনি বিশুদ্ধ রসবস্তু,
কিন্তু শুধু চিনি তুচ্ছ আর্ট। চিনির সঙ্গে অন্যান্য রসবস্তুর নিপুণ মিলনই
আর্ট। কিন্তু যে সব উপাদান
আমরা হাতের কাছে পাই তার সবগুলি অখন্ড রসবস্তু নয়, অল্পবিস্তর অবান্তর খাদ আছে। নির্বাচনের দোষে মাত্রাজ্ঞানের অভাবে অতিরিক্ত বাজে উপাদান এসে
পড়ে, অভীষ্ট স্বাদে অবাঞ্ছিত স্বাদ জন্মায়। তার উপর আবার ভোক্তার
পূর্ব অভ্যাস আছে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা আছে, ব্যক্তিগত রাগদ্বেষ আছে। এত বাধাবিঘ্ন অতিক্ৰম করে, ভোক্তার রুচি গঠিত করে কল্যাণের অন্তরায় না হয়ে, যাঁর সৃষ্টি স্থায়ী হবে, তিনিই শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা।
সূত্র : প্রবন্ধাবলী রাজশেখর বসু (সম্পাদনা- দীপংকর বসু)
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেই, ওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন