অস্তিত্ববাদ
: 'সত্তাবাদ' ও বলা হয়ে থাকে। অস্তিত্ববাদ বা 'এগ্জিস্টেনশিয়ালিজ্' ইউরোপীয় দর্শনে একটি বিশেষ চিন্তাধারার নাম। অস্তিত্ববাদী দর্শনের
মূল ভিত্তি জীবনবাদ এবং মানব-অস্তিত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৮৪০—এর দশকে ডেনিশ ধর্মতাত্ত্বিক কিয়ের্কগার্ড
এই তত্ত্বের মূল প্রণেতা। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসি দেশে ও জার্মানিতে এই দর্শনের
বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। কিয়ের্কগার্ড দ্বারা প্রভাবিত খ্রিষ্টান অস্তিত্ববাদীরা মনে
করতেন ঈশ্বরের আশ্রয়েই উদ্বেগ থেকে মানুষের মুক্তি। কারণ ঈশ্বরেই সসীম ও অসীমের একাকারে অবস্থান। কার্ল বার্থ,
পল টিলিখ, গ্যাব্রিয়েল মার্সেল
প্রমুখ তাত্ত্বিক চিন্তাবিদ এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। কাল ইয়াসপার অবশ্য কোনো প্রণীত ফরমাল ধর্মতত্ত্বে
বিশ্বাসী ছিলেন না। অস্তিত্ববাদে বিশ্বাসী আর এক গোষ্ঠীর মুখ্য প্রবর্তক ছিলেন জাঁ পোল সার্ত্র এবং
মাটিন হাইডেগার। হাইডেগার জার্মান দার্শনিক এডমানড হুসার্ল প্রণীত 'ফেনোমেনোলজি' দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে
অবশ্য সার্ত্র-এর চিন্তাভাবনাই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। এ প্রসঙ্গে তাঁর উপন্যাস—'নসিয়া' (১৯৩৮), নাটক—'দ্য ফ্লাইজ' (১৯৪৩) এবং বিখ্যাত দার্শনিক রচনা 'বিইং অ্যান্ড নাথিংনেস' (১৯৪৩)—বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কিয়ের্কগার্ডীয় অস্তিত্ববাদী ধারণা এবং সার্ত্ৰীয় অস্তিত্ববাদী
ধারণার মধ্যে বেশ কিছু পাথর্ক্য আছে। সার্ত্র—এর দর্শন নাস্তিক এবং মানুষের স্বাধীনতা ভিত্তিক। এখানে ব্যক্তিক দায়িত্ব
এবং বিশ্বাসযোগ্যতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সার্ত্ৰীয় অস্তিত্ববাদী বীক্ষার মূল কথা হল—existence
precedes essence—'সারবস্তু পরে, অস্তিত্ব আগে'। অর্থাৎ মানুষের কোনো পূর্বনিরূপিত স্ব-ভাব থাকে না, এই অর্থহীন অথবা উদ্ভট অস্তিত্বের জগতে মানুষকে নিজেই নিজের মূল্যবোধ এবং অর্থ
সৃষ্টি করে নিতে হয়। বাছবিচারও করে নিতে হয়। এই বেছে নেওয়ার সময় হয় আমাদের এই দায়িত্বের যন্ত্রণার (anguish
বা angst) সম্মুখীন হতে হয়,
নয়তো প্রচলিত নির্ধারক কোনো সনাতন প্রথা, রীতি বা কর্মের প্রতি অনুগত হতে হয়। এ এক অদ্ভুত স্ববিরোধী অবস্থা যেখানে মানুষ
এক অর্থে স্বাধীনতার দায়বদ্ধ। সার্ত্ৰ-বাদীদের মতে এই ঈশ্বরহীন জগতে মানুষ একা। সামাজিক বিধান বা প্রচলিত
প্রথা মেনে চলার অর্থ মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করা। ইচ্ছার দিক থেকে মানুষ মুক্ত এবং এই মুক্ত
ইচ্ছার প্রয়োগ করে, যন্ত্রণা, হতাশা এবং একাকিত্ব ভোগ করেই সে যা চায় তা হতে পারে।
সার্ত্র ছাড়াও আলবেয়ার কাম্যু তাঁর উপন্যাসে এবং প্রবন্ধে
এই একই বিষয়ের অবতারণা করেছেন। কাম্যু এবং সার্ত্র দুজনেই উপলব্ধি করেছিলেন—অস্তিত্বের শুন্যতা
ও অর্থহীনতা থেকে উদ্ধার হওয়ার একটিই উপায় আছে—সেটি হল ব্যক্তির 'দায়বদ্ধ' (engagé/committed) হওয়ার সিদ্ধান্ত। ফরাসি অস্তিত্ববাদের প্রভাব টম গান-এর প্রথম
দিকের ইংরেজি কবিতায় এবং আইরিস মারডখ এবং জন ফাউলসএর উপন্যাসে, লক্ষ করা যায়।
সার্ত্ৰীয় এবং কিয়ের্কগার্ডীয় অস্তিত্ববাদী ধারণার মধ্যে
কয়েকটি মূলগত সাদৃশ্য আছে—যেমন মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা, যুক্তি দিয়ে জগতের রহস্য বোঝা যায় না এই অনুভূতি, যন্ত্রণা একটি সার্বজনিক জাগতিক ঘটনা—এই চেতনা এবং সদর্থক ভূমিকা গ্রহণেই নৈতিকতার যাথার্থ্য ইত্যাদি। [সমরেশ বসুর 'বিবর' উপন্যাস অংশত অস্তিত্ববাদী উপন্যাস। এছাড়া, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের 'আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি',
দেবেশ রায়ের 'জন্ম', উদয়ন ঘোষের 'শান্তনু প্রহরী', শান্তনুর 'ইনারসিয়া' ও মাণিক চক্রবর্তীর 'শীতের রাতে শোওয়া' গল্পের উল্লেখ করা যেতে পারে]।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন