:::: সূচীপত্র ::::
অ ভি ভা ষ ণ
৬ষ্ঠ খণ্ড

১২

শ্রীমান্‌ সুনীতিকুমার গণনা করে দেখেছেন যেআমাদের ভাষার অন্তরে অন্তত ২ হাজার ৫ শত ফার্সি শব্দ আর শ-দুয়েক য়ুরোপীয় শব্দ বেমালুম ঢুকে গিয়েছে। এতে যদি সে ভাষা যবনদোষে দুষ্ট হয়ে থাকেতাকে সে দোষ হতে মুক্ত করবার কোন উপায় নেই


এই মাগধী ভাষা বহু কাল যাবত আর্যাবর্তের প্রাচ্য ভাষা অর্থাৎ পূর্ব অঞ্চলের ভাষা বলে পরিচিত ছিলচৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েনং সাং খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে নিজ কানে শুনে গিয়েছেন যে, বঙ্গ বিহার উড়িষ্যা এই তিন সুবায় একই ভাষা প্রচলিত ছিল


শ্রীমান্‌ সুনীতিকুমার পুরনো দলিলপত্র ঘেঁটে আবিষ্কার করেছেন যে, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে বঙ্গভাষা বেহারী ভাষা থেকে পৃথক হয় এবং সেই শুভক্ষণে সে তার স্বাতন্ত্র্য লাভ করে; আর এত দিনে সে তার স্বরাজ্য লাভ করেছেখ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গভাষা সেকেলে মহারাষ্ট্রী ভাষার মতো পদ্যের দখলেই ছিলমাত্র গত শতাব্দীতে গদ্য তাকে জবর দখল করে নিয়েছেসংক্ষেপে আমাদের ভাষার বয়েস হাজার বৎসর, আমাদের গদ্যসাহিত্যের বয়েস একশো বছরএই তো হচ্ছে তার উৎপত্তির বিবরণ

এখন তার প্রকৃতির পরিচয় নেওয়া যাকসংস্কৃত আলঙ্কারিকরা আবিষ্কার করেছিলেন যে, দেশভাষা মাত্রই মিশ্র ভাষা, কেননা, সে সব ভাষা তিনটি উপাদানে গঠিতসে তিনটি উপাদান তৎসম শব্দ, তদ্ভব শব্দ ও দেশি শব্দযেসব সংস্কৃত শব্দ আমাদের ভাষায় স্বরূপে বিরাজ করছে, তারাই তৎসম, যথা 'বিবাহ'; যাদের চেহারা ফিরেছে, তারাই তদ্ভব, যথা 'বিয়ে'; আর যাদের কুলশীল জ্ঞাতিগোত্র জানা নেই, তারাই দেশিআমরা আজ দেখতে পাই, এ তিন ছাড়া অনেক বিদেশি শব্দও বাঙ্গালার অঙ্গীভূত হয়ে রয়েছেশ্রীমান্‌ সুনীতিকুমার গণনা করে দেখেছেন যে, আমাদের ভাষার অন্তরে অন্তত ২ হাজার ৫ শত ফার্সি শব্দ আর শ-দুয়েক য়ুরোপীয় শব্দ বেমালুম ঢুকে গিয়েছেএতে যদি সে ভাষা যবনদোষে দুষ্ট হয়ে থাকে, তাকে সে দোষ হতে মুক্ত করবার কোন উপায় নেইভারতচন্দ্র বলেছেন, 'অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল'; আমাদেরও তাই করতে হচ্ছে এবং হবেসঙ্গীতের ভাষায় মিশ্র রাগিণীকে বলে জংলাবঙ্গভাষা যদি জংলা ভাষা হয় তো আমাদের ঐ জংলারই চর্চা করতে হবে


১৩

আমার বিশ্বাস, আমাদের সাহিত্য তার গৌরব লাভ করবে ভবিষ্যতে। অতীত আমাদের কাছে পড়ে পাওয়া জিনিস ভবিষ্যৎ কিন্তু আমাদের নিজ হাতেই গড়ে তুলতে হবে


আমরা ভাষা নিয়ে পূর্বে যে-বাদানুবাদ করেছি, তা আসলে শব্দঘটিত কলহশুদ্ধি-বাতিকগ্রস্ত সাহিত্যিকরা চান যে সাহিত্যের ভাষা থেকে প্রথমত দেশি-বিদেশি শব্দসমূহকে বহিষ্কৃত করা হোক, তারপর যত দূর সম্ভব তদ্ভব শব্দগুলিকে তৎসম করা হোক; তা হলেই তার লুপ্ত পবিত্রতা পুনরুদ্ধার করা হবেকারও পক্ষে 'জুতো-খাওয়া'টা অবশ্য লজ্জার বিষয়, কিন্তু 'বিনামা ভক্ষণ'টি কী হিসাবে সাধুজনেচিত, তা আমার বুদ্ধির অগম্যআর তদ্ভবকে তৎসম করা অসাধ্যএত বড় গুণী কি কেউ আছেন, যিনি 'বামন'কে ব্রাহ্মাণ করতে পারেন, আর 'বোষ্টম'কে বৈষ্ণব ? আসল কথা এই যে, আমরা যদি এই অসাধ্যসাধনায় সিদ্ধিলাভ করি, তা হলে আমরা বঙ্গ-সরস্বতীকে কাঙাল করবএকটা উদাহরণ নেওয়া যাকবন্ধু, বঁধু ও ইয়ার', এ তিনের রূঢ়ি অর্থ একই, অথচ এ তিনের অর্থ সম্পূর্ণ বিভিন্নএর কোনটিকে বাদ দেবার যো নেই, কিংবা এর একটির স্থানে আর-একটি বসাবার যো নেইশুনতে পাই যে, কোমল গান্ধার সুরটি অতিশয় শ্রুতিমধুরকিন্তু যেখানে 'পা' লাগানো উচিত, সেখানে কোমল 'গা' লাগালে সুর যাদৃশ সদ্‌গতি লাভ করে, যেখানে 'বন্ধু' বসবে, সেখানে 'ইয়ার' বসালে ভাষাও তেমনই সদ্‌গতি লাভ করেসুতরাং সাহিত্যিকদের ছুঁতমার্গ পরিহার করবার পরামর্শ আমি নিৰ্ভয়ে দিতে পারিশুনতে পাই, হিন্দু সমাজের অস্পৃশ্যতা দূর করতে পারলেই আমরা স্বরাট হয়ে উঠবএ মত কত দূর সত্য জানিনে, কিন্তু বঙ্গভাষায় অস্পৃশ্যতার চর্চা করলে বঙ্গ-সরস্বতী তার স্বরাজ্য হারিয়ে বসবে, সে বিষয়ে লেশ মাত্র সন্দেহ নেইআপনারা শুনে খুশি হবেন যে, শব্দের কুল-বিচার না করে তার অর্থবিচার করাই প্রাচীন পণ্ডিতদের অনুমতভারতচন্দ্র বলেছেন যে,

"প্রাচীন পণ্ডিতগণ গিয়েছেন কয়ে
যে হোক্‌ সে হোক্‌ ভাষা কাব্য-রস লয়ে।।"
ভারতচন্দ্রের এ কথা যে সত্য, তার প্রমাণ ভোজরাজ বলেছেন,
"সংস্কৃতে নৈব কেহেপ্যর্থঃ প্রাকৃতে নৈব চাপরঃ
শক্যো বাচয়িতুং কশ্চিদপভ্রংশেন বা পুনঃ ।।"
আর ভোজরাজের চাইতেও অনেক প্রাচীন আলঙ্কারিক দণ্ডী বলেছেন,
"তদেতৎ বাঙ্‌মঙং ভূয়ঃ সংস্কৃতং প্রাকৃতং তথা
অপভ্রংশশচ মিশ্রঞ্চেত্যাহুরার্য্যা চতুর্বির্ধম্।।"

এ স্থলে আপনাদের আর একটি বার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বঙ্গসাহিত্যের, তথা বঙ্গ-ভাষার অতীত এমন লম্বাও নয়, বড়ও নয় যে, সেই অতীত গৌরব-কাহিনী শুনে আর বলে আমরা দিন কাটিয়ে দিতে পারিআমার বিশ্বাস, আমাদের সাহিত্য তার গৌরব লাভ করবে ভবিষ্যতে। অতীত আমাদের কাছে পড়ে পাওয়া জিনিস ভবিষ্যৎ কিন্তু আমাদের নিজ হাতেই গড়ে তুলতে হবেলেখকরা সমাজের আনুকুলা লাভ না করলে এ ব্রত উদযাপন করতে সমর্থ হবেন নাআর সে আনুকুল্য যে আমরা যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করবার আশা করতে পারি, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই সভা


সূত্র : প্রমথ চৌধুরী || অগ্রন্থিত রচনা - ১
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেইওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন