ন ব - সা হি ত্যে র আ গ ম ন
১
বহু কাল পূর্বে আমি একটি হিন্দি গান শুনি, যার কথাগুলো
আজও আমার মনে আছে— যদিচ সে গান একবার ছাড়া দু'বার শোনবার সৌভাগ্য আমার অদ্যাবধি
হয়নি।
সে গানের প্রথম কথা ক'টি এই—
'নয়ী আয়ি পুরানীকে দূর করো রে।'
গায়ক ছিলেন জাতে হিন্দুস্থানি এবং এতাদৃশ 'তন্দুরস্ত' যে, হঠাৎ দেখলে তাঁকে কুস্তিগির পালোয়ান বলে ভুল হত, মনে হত, ওস্তাদজি
জীবনে ততটা গলা ভাঁজেননি— যতটা ভেঁজেছেন মুগুর; এবং তিনি
এতটা ফুর্তি করে এতটা তারস্বরে এমন ভাব বাৎলে অর্থাৎ ঘুসো পাকিয়ে 'দূর করো রে, দূর করো
রে, দুর করো রে'— এ ক'টি কথা এত বার আবৃত্তি করেছিলেন এবং সেই
সঙ্গে তাঁর স্বজাতীয় সঙ্গতী ডাইনে-বাঁয়াকে এমন নির্মম ভাবে পিটছিলেন যে, সে গান-বাজনা
ব্যাপারটিতে মজাও লাগছিল।
'নয়ির' অভ্যর্থনার জন্য ওস্তাদজি নানা রকম ভালো-ভালো বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমার যত দূর মনে পড়ে, তাঁর ঘরে ছিল 'সোনেকে থালিয়া', নিজে খাবার ও নয়ীকে খিলাবার জন্য; আর ছিল 'সোনেকো গাড়ুয়া' আর তার অন্তরে 'গঙ্গাজিকো পানি', নিজে পান করবার ও নয়ীকে 'পিলাবার' জন্য; আর ছিল 'সোনেকো খাটিয়া', পান-ভোজনান্তে নিজে শোবার ও 'নয়ী'কে শোওয়াবার জন্য।
প্রথম বয়সে পরের দুঃখে কাতর হওয়া আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক। সহৃদয়তা জিনিসটেও এক রকম যৌবন-সুলভ দোষ। মানুষের মন শক্ত হয় কালক্রমে— দর্শনের ফলে।
'নয়ির' অভ্যর্থনার জন্য ওস্তাদজি নানা রকম ভালো-ভালো বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমার যত দূর মনে পড়ে, তাঁর ঘরে ছিল 'সোনেকে থালিয়া', নিজে খাবার ও নয়ীকে খিলাবার জন্য; আর ছিল 'সোনেকো গাড়ুয়া' আর তার অন্তরে 'গঙ্গাজিকো পানি', নিজে পান করবার ও নয়ীকে 'পিলাবার' জন্য; আর ছিল 'সোনেকো খাটিয়া', পান-ভোজনান্তে নিজে শোবার ও 'নয়ী'কে শোওয়াবার জন্য।
এ সব আয়োজনের কথা শুনে বুঝতে পারলুম না, ক্ষুধা-তৃষ্ণ
কার বেশি, 'নয়ী'র না ওস্তাদজির। বোধ হয়,
দু'জনেরই সমান। তবে বুঝলুম যে, এ সঙ্গীতের প্রেরণা হচ্ছে ক্ষুধা-তৃষ্ণার
তাড়না।
সে যা-ই হোক,
এই নবদম্পতির আনন্দের কথা শুনে আমি নিরানন্দ হয়ে গেলুম— বেচারি পুরানীর
দশা ভেবে। প্রথম বয়সে পরের দুঃখে কাতর হওয়া আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক। সহৃদয়তা জিনিসটেও
এক রকম যৌবন-সুলভ দোষ। মানুষের মন শক্ত হয় কালক্রমে— দর্শনের
ফলে।
তার পর সংসারের সঙ্গে কারবার করে এই অভিজ্ঞতা লাভ করেছি যে, 'নয়ী' আসবার অথবা তাঁকে আনবার কথা উঠলেই পালোয়ান-জাতীয় লোকেরা এই
বলে গোঁফে চাড়া দিয়ে গান ধরেন যে— 'পুরানীকে দূর করো রে, দূর করো রে, দুর করো
রে।' এঁরা যখন ভবিষ্যতের
সঙ্গে ভালোবাসায় পড়ে যান, তখন এঁরা বর্তমানের প্রতি একেবারে নির্মম হন, এবং তখন
এঁরা জোর-গলায় বলেন— কারও কোন কথা শুনতে পারিনে, কেননা— 'মন-প্রাণ
যাহা ছিল, দিয়ে ফেলেছি— আগন্তুক 'নয়ী'কে। বীরপুরুষের অর্থাৎ
যে-লোকের মস্তিষ্ক, muscle-এ পরিণত হয়েছে, তাকে মানুষে ভক্তি না করুক, ভয় করতে
বাধ্য। এই কারণে ভয়ে-ভয়ে এই সত্যটা পাঁচ জনকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি
যে, মুখের ধমকে পুরানী দূর হয় না, অত সহজে
ও 'কমলি নেহি ছোড়তা'। যে-স্বত্বে পুরানী স্বত্ববান্, সে স্বত্বের চাইতে জবর স্বত্ব পৃথিবীতে আর
দ্বিতীয় নেই, আর তার নাম দখলি-স্বত্ব। পুরানীকে দূর করবার
মামুলি উপায় হচ্ছে নিজে তার কাছ থেকে দূর হওয়া— চুপি চুপি— শোরহাঙ্গাম করে নয়।
২
এখন নয়ীর কথায় ফিরে আসা যাক।
কিছু কাল থেকে ভারতবর্ষে
পলিটিকাল, ইকনমিক,
সামাজিক ইত্যাদি বহুবিধ 'নয়ী' আসছেন। তাই 'দূর করো রে, দূর করো
রে' ধ্বনিতে দেশের আকাশ-বাতাস প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। এ খবর সবাই জানেন। কারণ, এ সব 'নয়ী' আসছেন খবরের
কাগজের প্রাসাদে !
চিত্রগুপ্তের খাতা শুধু কেরানির হাজরে বই নয়, অর্থাৎ তাতে দিনের পর দিন শুধুই present লেখা থাকে না, আমরা ভবে এসে কে কী করছি, তারও হিসেবও ও-কেতাবে থাকে। শুধু এ পৃথিবীতে present থাকবার জন্য আমরা যে-সব নিত্য কর্ম করি— যথা অন্নধ্বংস ও বংশবৃদ্ধি, তার হিসেব— চিত্রগুপ্ত জানেন না। কারণ, তার কথা হচ্ছে পৃথিবীতে কারও present থাকবার কোন দরকার নেই— যদি না সে আরও কিছু উপরি কাজ করে। আর যার ঝোঁকে মানুষে এই বাজে কাজ করে, তার নাম নেশা।
সম্প্রতি বাঙ্গালা দেশে আর-একটি 'নয়ী'র আগমনবার্তা ঘোষিত হচ্ছে। এ সংবাদপত্রের 'নয়ী' নয়, সাহিত্যের 'নয়ী'। সরস্বতী নাকি নতুন মূর্তি ধরে বাঙ্গালা দেশে অচিরে দেখা দেবেন। এ কথা শুনে আমি মহা উৎফুল্ল হয়েছি। কেন যে হয়েছি, বলছি।
ছেলেবেলায় একটি বৃদ্ধ
বোষ্টম ভিখারির মুখে একটি গান শুনি। সে গানের প্রসাদে আমি একটা মহা শিক্ষালাভ করেছি, কেননা, আমি হচ্ছি
সেই জাতের লোক— যারা আর্টের অন্তরে শুধু ফিলজফির সাক্ষাৎ পায়, প্রাণের
অন্তরে শুধু জড়ের রূপ দেখতে পায়।
বৃদ্ধ আমাদের সম্বোধন করে ভাঙা গলায় গান ধরলেন—
'না খেলে
গাঁজা না খেলে গুলি
ভবে এসে করলে কী?'
এ গান শুনে তখন বাল্যসুলভ চাপল্যবশত হেসে উঠেছিলুম— কারণ,
তখন বুঝিনি,
ও-দুটি ভৌতিক পদার্থের আধ্যাত্মিক অর্থও আছে। এখন বুঝেছি যে, ওগান একটা
মহা প্রশ্ন। — যারা ভবে এসে, কি গাঁজা কি গুলি, কোন রূপ
নেশার বশীভূত হয়নি, তারা এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারে না, আর তারাই
হচ্ছে বেশির ভাগ লোক ।
চিত্রগুপ্তের খাতা শুধু কেরানির হাজরে বই নয়, অর্থাৎ তাতে
দিনের পর দিন শুধুই present লেখা থাকে না, আমরা ভবে এসে কে কী করছি, তারও হিসেবও
ও-কেতাবে থাকে। শুধু এ পৃথিবীতে present থাকবার জন্য আমরা যে-সব
নিত্য কর্ম করি— যথা অন্নধ্বংস ও বংশবৃদ্ধি, তার হিসেব— চিত্রগুপ্ত
জানেন না। কারণ,
তার কথা হচ্ছে পৃথিবীতে কারও present থাকবার কোন দরকার নেই— যদি না সে
আরও কিছু উপরি কাজ করে। আর যার ঝোঁকে মানুষে এই বাজে কাজ করে, তার নাম
নেশা।
এই নেশাখোরের দল আবার সবই এক নেশা করে না। কারও নেশা পলিটিকস, কারও নেশা
টাকা, কারও নেশা সমাজ-সংস্কার ইত্যাদি। আমি এ সকল নেশাই এস্তমাল
করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু ও-সব আমার ধাতে সইল না। এর কারণ, এদের কোনটা
এতটা জলো যে, আমার মোটেই ধরে না, আর কোনটা বা এত মোটা যে, বেজায় ধরে, এত চেপে
যে, তখন আর আমায় আমি থাকিনে। তাই আমি ভবে এসে খোশমেজাজে
কিছু করে থাকি তো সে সাহিত্যরস পান,
আর এ পানের ফলে যা হয়— তার নাম
গোলাপি নেশা; সুতরাং আমাদের সাহিত্য-জগতে যে 'নয়ী' সাকী আসছেন, নুতন পানপাত্র
ভরে নতুন কাব্যরস নিয়ে, যে-রসের অন্তরে গন্ধ থাকবে ছোট এলাচির, আর রঙ থাকবে
জাফরানের, এ সুসমাচার,
আমার কাছে মথি-লিখিত সুসমাচারের তুল্য। তবে সন্দেহ হয়, এ আনন্দ
তো সেই জাতীয় আনন্দ নয়— যার বাঙলা নাম হচ্ছে 'গাছে কাঠাল
গোঁফে তেল ?'
৩
বঙ্গসরস্বতী যে 'নয়ী' রূপে অবতীর্ণ হচ্ছেন, তার প্রমাণই
বা কী, পূর্বলক্ষণই বা কী ?
'সম্ভবামি যুগে যুগে', এ হচ্ছে
শুধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা নয়,
ভগবতী সরস্বতীরও কথা। সরস্বতীও যুগে-যুগে নব কলেবর ধারণ করে নব বেশে ধরা-ধামে যে অবতীর্ণ
হন, তা অবশ্য সকলেরই জানা আছে। কিন্তু যেহেতু শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁর আগমনের তারিখ ও ঠিকানা বলে দেননি, তখন উক্ত শ্রীতির উপর নির্ভর করে এ ভরসা পাওয়া
যায় না যে, সরস্বতী ১৩৩৫ সালের পয়লা বৈশাখ তারিখে হয় কলকাতায়, নয় ঢাকায় বৈশাখী ঝড়ের মতো লোকের কাপড়-চোপড়
উড়িয়ে হু-হু শব্দে এসে পড়বেন। দৈববাণীর ধর্মই এই যে, তা আশার কথা নয়, আকাশের কথা— ভাষায় যাকে বলে ফাঁকা আওয়াজ !
সুতরাং এখন নব-সাহিত্যের আগমনের
পূর্বলক্ষণগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক। শুনতে পাচ্ছি, নব-সাহিত্যের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে নব-সমালোচনায়। যেমন রণবাদ্য শুনে
বোঝা যায় যে, বিজয়ী সেনানী আসছেন। যখন তরুণের দল সুর ধরেছে— রবীন্দ্র-সাহিত্যকে 'দূর করো রে, দূর করো রে',
তখন 'নয়ী' নির্ঘাত আসছে, বঙ্গদেশ রূপে আলো করে।
নব-সাহিত্যের সৃষ্টির ইচ্ছা তরুণদের মনে যখন জাগরূকে হয়েছে, তখন তারা নব-সাহিত্য সৃষ্টি করবেই করবে— তা হলে বলি, নব-সাহিত্য নব ইচ্ছার হাত-ধরা নয়, কারণ, সাহিত্য-সৃষ্টি মানুষের ইচ্ছাধীন নয়।
এ কথা বিনা বাক্যে
মেনে নেবার পক্ষে আমার মনে দুটি বাধা আছে।
যাঁরা রবীন্দ্র-সাহিত্যের কান-ফাটানো সমালোচনা করছেন, তাঁরা কি সবাই তরুণ ?
আমি তো দেখতে পাই যে, যাঁরা রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রতি তেড়ে শিং বাঁকাচ্ছেন, তাঁদের বেশির
ভাগ হচ্ছেন সেই জাতীয় সাহিত্যিক— যাঁরা শিং ভেঙে বাছুরের দলে মিশেছেন। এ সমালোচনা আগন্তুক
সাহিত্যের আগমনী নয়, তাঁদের স্ব-রচিত পূর্ব-সাহিত্যের গুণকীর্তন ও এক রকম সাহিত্যিক
টনিকের বিজ্ঞাপন !
তারপর সাহিত্য-জগতের ইভলিউশনের ধারাই এই যে, আগে আসে
সাহিত্য, তারপর তার সমালোচনা। আগে সমালোচনা দেখে তার লেজ ধরে সাহিত্য আসছে, এ রূপ অনুমান
করা তদ্রপ— আগে গাড়ি,
তার টানে ঘোড়া পিছনে আসছে অনুমান করা যদ্রুপ।
তবে যদি কেউ বলেন যে, এই সমালোচনাই
প্রমাণ যে, নব-সাহিত্যের সৃষ্টির ইচ্ছা তরুণদের মনে যখন জাগরূকে হয়েছে, তখন তারা
নব-সাহিত্য সৃষ্টি করবেই করবে— তা হলে বলি, নব-সাহিত্য
নব ইচ্ছার হাত-ধরা নয়, কারণ,
সাহিত্য-সৃষ্টি মানুষের ইচ্ছাধীন নয়।
'বাঁশরী বাজাতে চাহি, বাঁশরী বাজিল কই ?' এ আক্ষেপ কাব্যজগতে
ইতঃপূর্বে বহু বংশীধারীকে করতে হয়েছে এবং অতঃপরও করতে হবে এবং এঁদের মধ্যে যাঁরা বেশি
আক্ষিপ্ত, তারা বাঁশি বাজল না দেখে, তাকে বাঁশ হিসেবে ব্যবহার করেন এবং বংশের
উক্ত রূপ ব্যবহারকেও অনেকে সমালোচনা বলে ভুল করেন। বলা বাহুল্য, এ রূপ সমালোচনা
ভবিষ্যৎ সাহিত্যের অগ্রদূত নয়,
বর্তমান সাহিত্যের ভগ্নদূত।
সূত্র : প্রমথ চৌধুরী || অগ্রন্থিত রচনা - ১
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন