:::: সূচীপত্র ::::
ন ব - সা হি ত্যে র আ গ ম ন



এই সব সমালোচনা পড়ে-শুনে আমার মনে হয় যে, যাঁরা জোর-গলায় নবসাহিত্যকে আবাহন করেছেন, তাঁরা সব তরুণ পাঠক, তরুণ লেখক নয়, কারণ, যে যথার্থ লেখক, সে তো সাহিত্যসৃষ্টিই করছে, সে আবার আহ্বান করবে কাকে সাহিত্য তো বাইরের জিনিস নয়, যাকে নানা রূপ স্তব-স্তুতির দ্বারা ঘরে আনতে হবেসাহিত্য-বস্তু নিজ শক্তিতে নিজের অন্তর থেকে গড়ে তুলতে হয়সাহিত্যের স্বরাজ্য কোন দেশি-বিলেতি কমিশনের প্রসাদে পাওয়া যাবে না

অপর পক্ষে যে পূর্বজন্মের কর্মফলে জন্মেছে শুধু পাঠক হবার জন্য, সে যদি লেখক হতে চায় তো তার সমালোচক হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেইউদাহরণ স্বয়ং আমিসমালোচক জানেন শুধু পূর্ব-সাহিত্য, সুতরাং ভবিষ্যৎ-সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী চিরকাল ভবিষ্যদ্বাণীই রয়ে যাবে


বি-রাজকে স্বরাজ করবারসারদাকে অন্নদা করবারবিধবাকে সধবা করবার জন্যে বকে-বকে অনেকের মুখ ব্যথা হয়ে গিয়েছে। এই থেকে আমার মনে হয় যেসমালোচকদের দল যার আবাহন করছেনতার নাম নব-সমাজনব-সাহিত্য নয়। অনেকে হয়তো মনে করেন যেসমাজে ও সাহিত্যে কোন প্রভেদ নেই

লেখক মাত্রেরই অন্তরে অবশ্য একটি করে সমালোচক থাকেন, কিন্তু সে সমালোচকের আসল কাজ নিজের লেখার দোষ-গুণ বিচার করা, পরের লেখার দোষ-গুণ ধরা নয় ! যাঁরা নিজে লিখতে পারেন না, তাঁরাই পরের লেখা কী রকম হওয়া উচিত, সে বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেনযে নিজে গাইতে পারে না, সে-ই তালে-বেতালে নৃত্য করে, আর সে ব্যাপারকে বলে সঙ্গীত

সাহিত্যে যে আজকাল গণ্ডগোল হচ্ছে, তার আর-একটি কারণ এই যে, অনেকে এমন কাব্য লেখেন, যে-কাব্য হচ্ছে বর্ণচোরা সমালোচনারাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি নীতির সংস্কার হচ্ছে যে-গল্প-সাহিত্যের প্রাণ, তা আকারে কাব্য, কিন্তু আসলে রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক প্রবন্ধ মাত্রতাই প্রবন্ধের সঙ্গে কাব্য ঘুলিয়ে গিয়েছেফলে অনেক পাঠক এই ঘোলা জলকেই কাব্যরস বলে সানন্দে পান করেনসম্ভবত পাঠক উচ্চজাতীয় সাহিত্যই চানকারণ, দেখতে পাই, বি-রাজকে স্বরাজ করবার, সারদাকে অন্নদা করবার, বিধবাকে সধবা করবার জন্যে বকে-বকে অনেকের মুখ ব্যথা হয়ে গিয়েছেএই থেকে আমার মনে হয় যে, সমালোচকদের দল যার আবাহন করছেন, তার নাম নব-সমাজ, নব-সাহিত্য নয়অনেকে হয়তো মনে করেন যে, সমাজে ও সাহিত্যে কোন প্রভেদ নেইতবে বেশির ভাগ লোক যে রবীন্দ্র-সাহিত্যকে দূর করবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, এ রূপ মনে করবার কোন কারণ নেইযে-সম্প্রদায় নব-সমাজ, নব-রাজ্য গড়বার কাজে লেগেছেন অর্থাৎ যে-সম্প্রদায় আমাদের বল-বুদ্ধি-ভরসা, সে সম্প্রদায় রবীন্দ্র-সাহিত্যের অস্তিত্ব বিষয়েও সম্পূর্ণ অজ্ঞসে সম্প্রদায় লেখকও নন, পাঠকও নন, তাঁরা শুধু বক্তা ওরফে কর্মীতাঁদের মুখে পুরানীকে দূর করবার প্রস্তাবটা হবে বিয়ের আগেই divorce-এর প্রস্তাবের মতো

আসল কথা, রবীন্দ্র-সাহিত্যের ওরফে বঙ্গ-সাহিত্যের বিরুদ্ধে তথাকথিত বিদ্রোহ হচ্ছে, মনের বিরুদ্ধে ক্ষুধার বিদ্রোহ, বুকের বিরুদ্ধে পেটের বিদ্রোহ, এ অবশ্য সাহিত্যিক বিদ্রোহ নয়কারণ, নব-সরস্বতী এলে সঙ্গে গোলা-ভরা ধান ও পেটরা-ভরা কাপড় আনবেন নাযিনি তা আনতে পারেন, তাঁর নাম লক্ষ্মী এবং এখন তিনি ঘরে বসে লক্ষ্মী মেয়ের মতো চরকা ঘোরাচ্ছেনসে যা-ই হোক, সরস্বতীর বেনামীতে লক্ষ্মীকে ডেকে কোন ফল নেই, ও-ডাকে সরস্বতীও আসবেন না লক্ষ্মীও নয়উপবাসের পর উৎসব, শিবরাত্রির পর দোল আসে, শুধু পাঁজির জগতে, পুঁথির জগতে নয়



যাঁরা বিশ্বাস করেন যে, পুরনো সাহিত্যকে বধ না করলে নব-সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না, তাঁরা ভুলে যান যে, সাহিত্য অমর, তা পুরনোই হোক, নতুনই হোকযদি রবীন্দ্র-সাহিত্য না ম'লে নব-সাহিত্য না আসে, তা হলে নব-সাহিত্য আর আসবে না, কারণ, ও-পুরনো সাহিত্যের আর মার নেইআর যদি কেউ বলেন যে, রবি অস্ত গেলেই শশীর উদয় হবে, তা হলে তাঁদের কাছে একটা কথা নিবেদন করিরবির আলো নিভে গেলেই যে রজনী হবে উতলা, তার কোন সম্ভাবনা নেইনব-সাহিত্য যে-রূপ ধরেই আসুক, তা সাহিত্যই হবে, সাহিত্য ছাড়া আর কিছুই হবে নাআর তখন দেখা যাবে যে, এ নব-সাহিত্য সে সাহিত্য নয়, যার আগমন পাঁচ জনে প্রতীক্ষা করছেনএ স্থলে একটা কথা ভরসা করে বলা যায় যে, ভবিষ্যতের কাব্যশাস্ত্ৰ কামশাস্ত্র হবে না, আর ভবিষ্যতের কামশাস্ত্রও কাব্যশাস্ত্র হবে না, কেননা অতীতেও তা হয়নি, যদিচ একটিকে অপরটিতে রূপান্তর করবার বৃথা চেষ্টা অতীতেও করা হয়েছেএটা সুখের বিষয়ই হোক আর দুঃখের বিষয়ই হোক, science চিরকাল science-ই থাকবে আর literature literature, যদিচ ভবিষ্যতের সাহিত্য বিজ্ঞান-পরিপুষ্ট হবেবিজ্ঞানে পরিপুষ্ট হবে, অনুমান করছি এই কারণে যে, তা চিরকালই হয়ে এসেছেসরস্বতী যে শুধু ত্রিকোণ পৃথিবীতেই বাস করতে পারেন, গোলাকার পৃথিবীতে পারেন না, এমন কথা বললে লোক হাসবেবরং সত্য কথা এই যে, গোল পৃথিবীর ক্ষেত্র সরস্বতীর পক্ষে ঢের উদার

এ কারণ যাঁরা ভয় পান যে, নব-সাহিত্য অমৃত হবে না, হবে শুধু মদিরা, তাঁদের জিজ্ঞাসা করি, অমৃতেরও কি নেশা নেই, ও-বস্তু-কি হাল সভ্যতার কলের জল ? আর সুরার ভিতরেও কি এক ফোটাও অমৃত নেই আছে শুধু হলাহল ভাষান্তরে আলকহল ?

নব-সাহিত্য এসেছে কি নাতা তত দিন জানা যাবে নাযত দিন নব সমালোচনার জয়ঢাক না থামবে। ও-বাদ্য থামলেই কোথায় কার বাঁশি সুরে বাজছেতা সকলেরই কর্ণগোচর হবেঅবশ্য তাদের যাদের সুরের কান আছে

নব-সাহিত্য যদি সত্যই সুরা হয় তো আমি বলি সোভান্‌ আল্লাকারণ, সুরায় আশা করি, আমাদের শোয়া সামাজিক মনেকে ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে খাড়া করে সে তুলতে পারবেএই সাহিত্য-সুরা পান করে যদি আমাদের সামাজিক মন দাঁড়িয়ে ওঠে, তা হলে তার বিশৃঙ্খল অঙ্গভঙ্গি দেখেও কেউ আবার তাকে শোয়াতে চাইবে নামৃতের চাইতে মত্ত ঢের ভালো, কেননা, সে ধড়ফড়ে জীব

তবে এ সুরা কোন্‌ জাতীয় সুরা হবে, তাই হচ্ছে ভাবনার বিষয়লোকে বলে, গাঁজার ভেলসা নেই, কিন্তু সুরার দেদার জাতিভেদ আছে


নব-সাহিত্য সুরা হোক, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই, তবে এ সাহিত্য-সুরা ধেনো না হলেই রক্ষেকারণ, ধেনোর আর যতই ফয়দা থাকুক, তার গন্ধে ভূত পালায়, সে গন্ধ এত কড়া যে, গরম মসলা যোগেও তাকে নরম করবার যো নেইবরং তাতে তাকে আরও চড়িয়ে দেওয়া হয়রামপ্রসাদ বলেছেন, 'সুরা পান করিনে আমি সুধা খাই মা মা বলে।' কিন্তু ও-বস্তু ধেনো হলে কাব্যপিপাসু ভক্তরা তা মা-মা বলে গলাধঃকরণ করতে পারবে না; সবাইকে বাবা-বাবা বলে তা বমন করে ফেলতে হবে


নব-সাহিত্য আসছে কি না, সে হচ্ছে বাজে ভাবনানব-সাহিত্য এসেছে কি না, সেইটেই হচ্ছে আসল জানবার কথাআমার ধারণা, নব-সাহিত্য এসেছে কি না, তা তত দিন জানা যাবে না, যত দিন নব সমালোচনার জয়ঢাক না থামবেও-বাদ্য থামলেই কোথায় কার বাঁশি সুরে বাজছে, তা সকলেরই কর্ণগোচর হবে, অবশ্য তাদের যাদের সুরের কান আছেতরুণরা কে কী গান ধরেন, তাতে কিছু যায় আসে না, মোদ্দা কথা, তা বেসুরে না হলেই হলধরুন, তাঁরা যদি পুরানীকে সম্বোধন করে এই বলে তান ধরেন যে, 'আমার হ'ল সুরু তোমার হ'ল সারা' তাতেও আমরা বাহবা দেব যদি ঠিক-ঠিক জায়গায় ঠিকঠিক সুর লাগে, যথা আমার হ'ল সুরু'তে কড়ি, আর 'তোমার হল সারা'তে কোমল, আর তাল যদি রুদ্রতাল না হয়এ গান আমাদের সবারই কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করবেকারণ, আমরা সবাই জানি যে, সবারই শেষ হয়, অপর পক্ষে দু'চার জনের শুধু সুরে শুরু হয়


সূত্র : প্রমথ চৌধুরী || অগ্রন্থিত রচনা - ১
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেইওয়েবে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন