যশোর
আমার জন্ম হয় যশোরে, যদিচ আমার বাড়ি হচ্ছে পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামে। বাড়ি বলতে আমি সেই
স্থানই বুঝি, যেখানে স্মরনাতীত কাল থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের
বাস।
এককালে বাঙালিরা গ্রামেই বাস করত। ইংরেজ আমলের প্রথম
থেকেই জনকতক লোক পাড়াগাঁ ত্যাগ করে পাড়াগেঁয়ে শহরে বাস করতে আরম্ভ করলেন— ইংরেজের চাকরির খাতিরে। আমার পিতাও ছিলেন এই দলের একজন।
এই সব নতুন শহরে তাঁরা অবশ্য শিকড় গাড়েননি,
কারণ ইংরেজের চাকরি করতে হলে ক্রমান্বয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে
বদলি হতে হয়। সরকারের চাকর সব যাযাবরের দল।
আমার জন্মস্থানের বিষয় আমার বিশেষ কিছু মনে
নেই। আমি পাঁচ বৎসরে যশোর
ত্যাগ করে নদীয়া জেলায় আসি। সুতরাং যশোরের স্মৃতি আমার অস্পষ্ট। সে শহরের একটি বাড়ি ও দু-একটি ঘটনার কথা আমার
মনে আছে। এর বেশি কিছু নয়।
সেই বাড়িটির কথা আমি বলব— কারণ আমার শৈশবস্মৃতি সব সেই বাড়ির সঙ্গে জড়িত।
যে-বাড়িতে আমরা থাকতুম, সে বাড়ির নাম পন্ডিতের বাড়ি। বাড়িটি দ্বিতল আর সুমুখে একটি পুকুর ছিল। পুকুরের ওপারে একটি
একতলা বাড়ি ছিল সেটি নাকি পিরালীবাবুদের বাড়ি। তার পাশ দিয়ে গিয়েছিল একটি ছোট কাঁচা রাস্তা। আর আমাদের বাসার দক্ষিণে
পড়ে ছিল খানিকটা মাঠ, সেই মাঠ পেরিয়ে যেতে হত একটি রাস্তায়,
যে-রাস্তা দিয়ে নাকি শহরে যেতে হয়। শহরে মাত্র আমি একটি দিন গিয়েছিলুম— শহরে আগুন লেগেছিল তাই দেখতে, চাকরদের সঙ্গে। এ অগ্নিকান্ডের কথা আমার মনে আছে।
আর মনে আছে একদিন দুপুরবেলা বাড়ির সুমুখের
পুকুরে একটি পিরালী-বাবু দুটি স্ত্রীলোকের কাঁধে হাত দিয়ে স্নান করতে এলেন। এ ব্যাপারে মহা গোলমাল
হতে লাগর, কারণ শুনলাম, তিন জনই নাকি সমান মাতাল। পাছে তারা ডুবে মরে— তাই লোকজন সব চেঁচাচ্ছে। কিন্তু তারা স্নান করে উঠে গেল। বাবুটির চেহারা আমার আজও মনে আছে। তাঁর রং ছিল দিব্য
গৌর বর্ণ ও শরীর দোহারা। কিন্তু দুটি স্ত্রীলোকের আর যে-গুনই থাক, রূপ ছিল না। যদি থাকত, তা হলে পিরালীবাবুর
চেহারার মতো তাদের চেহারাও আমার চোখে পড়ত। আমার যত দূর মনে পড়ে, তাদের মতো কালো কুৎসিত ও রোগা স্ত্রীলোক সচরাচর দেখা যায় না।
আমি যশোর শহরের কোন দ্রষ্টব্য জিনিস দেখিনি,
তার কারণ বোধ হয় সেখানে দেখবার মতো কিছু ছিল না। এই সব ভুঁইফোড় শহরে
থাকে শুধু হাল আমলের আদালত, থানা, ইস্কুল ও জেলখানা। আমি যশোরের জেল শুধু বাইরে থেকে দেখেছি। আমার বয়েস যখন চার
ও পাঁচের মধ্যে, তখন হরিপুর থেকে নৌকো এসেছিল আমাদের পুজোর
সময় বাড়ি নিয়ে যেতে । আমার এই পর্যন্ত মনে আছে যে, সন্ধ্যেবেলায় নৌকোতে
গড়িয়ে চড়লুম । যশোরের নিচে ভৈরব নদী দেখলুম যে দাম ও শেওলায় আগাগোড়া ছাওয়া, আর তারই গায়ে রয়েছে খুব উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটা বাড়ি;
শুনলুম, এই হচ্ছে সে শহরের
জেল। এই দামের ভিতর দিয়ে
নৌকো কী করে এল তা বুঝতে পারলুম না।
আর মনে আছে সেই রাত্তিরের কথা, যেদিন আমরা যশোর ত্যাগ করি। নিত্য যা ঘটে তা ঘটনাই নয়। একটা অসাধারণ নড়াচড়ার
কথা, ছোট ছেলেদের তা-ই মনে থাকে।
আমার বয়েস যখন পাঁচ বৎসর, তখন আমরা যশোর ছেড়ে কৃষ্ণনগর রওনা হই।
যশোরে ছ্যাকড়াগাড়িতে চড়ে সমস্ত রাত চলার পর
বনগাঁয় পৌঁছই, আর সেখানে এক দিন এক রাত থেকে পরদিন সকালে
আবার ছ্যাকড়া-গাড়িতে চড়ে চাকদহ যাই। আর সেখানেই প্রথম রেলগাড়ি দেখি। সেই রেরগাড়িতে চড়ে বগুলায় আসি— আবার সেখান থেকে আমরা ছ্যাকড়াগাড়িতে চড়ে শেষটা কৃষ্ণনগরে আসি।
যশোরের এই চারটি ঘটনা শুধু আমার মনে আছে। প্রথমে অগ্নিকান্ড,
তারপর পিরালীবাবুর জলকেলি, তারপর যশোর থেকে নৌকাযাত্রা আর শেষটা যশোর-ত্যাগ। বাদবাকি সব অন্ধকার।
যশোরে আমরা অনেকে এক বাড়িতে থাকতুম। বাবা, মা, পাঁচ ভাই, দুই বোন আর দু-একটি আত্মীয়। এঁদের কারও কথা আমার মনে নেই, একমাত্র আমার অব্যবহিত জ্যেষ্ঠ কুমুদনাথের কথা ছাড়া। এর কারণ বোধ হয় আমরা
পিঠপিঠি দু-ভাই একসঙ্গে খেলা করতুম ও বেড়াতুম।
আমাদের বাড়িতে মুখুজ্যেমশায় নামে একটি লোক
থাকতেন। তিনি কে, তা আমি জানিনে। তিনি বসে-বসে সেতার বাজাতেন। আমাদের পরিবার সঙ্গীত-ছুট। অর্থাৎ সঙ্গীতের চর্চা
কেউ করতেন না। সুতরাং মুখুজ্যেমশায় সেতারের মাস্টার ছিলেন না। তাঁর সেতারের বোল পরে শুনেছি মা-র মুখে;
সে কথা পরে বলব।
আর আমি একটি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলুম। একটি বালিকাকে আজও
মনে আছে। মেয়েটি ছিল শান্তশিষ্ট আর তার ছিল কপালজোড়া দুটি চোখ, নাক খাঁদা নয়, আর বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। পাঁচ বৎসরে যদি কেউ
love-এ পড়ে, তা হলে আমি তার সঙ্গে
love- এ পড়েছিলুম। অনেক দিন পর্যন্ত আমার মনে হত মেয়েটির কী
হল, কার সঙ্গে বিয়ে হল। এই মেয়েটিকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলবার জন্য একটি ছোট গল্পও পরে লিখেছি।
এই আমার যশোরের স্মৃতি। ৩০ সেপ্টেম্বর,
১৯৪০
সূত্র : আত্মকথা - প্রমথ চৌধুরী