কৃষ্ণনগর - ১ম অংশ
আজ লিখতে মন বসছে না। রবীন্দ্রনাথের কঠিন
রোগের ভাবনায় আমার মন ভরে রয়েছে। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই আর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে
পর্যন্ত এই দীর্ঘকাল তাঁর ছায়াতেই মানুষ হয়েছি। পরশু রাত্তিরে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলুম। আমি যখন তাঁর ঘরে যাই
তখন তিনি তন্দ্রাভিভুত, খাটে চিৎ হয়ে শুয়েছিলেন। কী অসাধারণ সুন্দর পুরুষ। এ অবস্থাতেও তাঁর দেবদুর্লভ
রূপ আমাকে চমকে দেয়। আমি ছোটবেলা থেকেই রূপের ভক্ত। প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথকে দেখি, তখন তাঁর অসামান্য
রূপই আমাকে মুগ্ধ করে। আর সেদিন যা দেখলুম তাতে মনে হল তিনি আরও সুন্দর হয়েছেন; আমি কৃষ্ণনগরেই আমাদের
বাড়িতে প্রথম তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করি। সুতরাং কৃষ্ণনগর সম্বন্ধে আমার বাল্যস্মৃতি আজ আর লেখা হবে না। আশা করি তিনি এ যাত্রায়ও
আরোগ্য লাভ করবেন, কেননা তাঁর vitality
-ও অসাধারণ। লোকোত্তর পুরুষের কথা বইয়ে ঢের পড়েছি, কিন্তু দেখেছি শুধু
একটি— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আজ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের দোসরা অক্টোবর। রবীন্দ্রনাথ বোধ হয়
এ ফাঁড়া কাটিয়ে উঠবেন ।
এখন বাল্যকালে ফিরে যাওয়া যাক ।
কৃষ্ণনগরে এসে আমি হঠাৎ জেগে উঠলুম— অর্থাৎ আমি
চেতন পদার্থ হলুম। বোধ হয় ঠিকে গাড়ির এক দিন এক রাত ঝাঁকুনিতে ! যশোর থেকে বনগাঁ, বনগাঁ থেকে চাকদহ, বগুলা থেকে ন-মাইল
দূরে কৃষ্ণনগরে একটা পুঁটলির মতো ঠিকে গাড়ীতে আসতে হয়।
কৃষ্ণনগরে পদার্পণ করা মাত্র ইন্দ্রিয়গোচর
পদার্থ সব আমার নাক, কান, চোখের ভিতর দিয়ে ভিড় করে ঢুকতে লাগল। বাহ্য বস্তুর সঙ্গে আমার পরিচয় শুরু হল। আমি নানা বস্তুর রূপ
দেখলুম আর তাদের নামও শিখলুম। দার্শনিকেরা যাকে বলেন নামরূপের জগৎ, সেই জগতের সঙ্গে আদানপ্রদানের
কারবার আরম্ভ হল। এ জগৎ যে বিচিত্র, সে জ্ঞান আমার জন্মাল। যাঁরা বলেন মন নামক কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই, মন হচ্ছে দেহেরই বিকার, তাঁদের জিজ্ঞাসা করি, ঠিক কোন্ সময়ে এ বিকার
শুরু হয় তা কি তাঁরা বলতে পারেন ? আর এ বিকারের উদ্দেশ্যই বা কী ?
কৃষ্ণনগরে আমি শৈশবে ও বাল্যকালে কী শিখেছি, তা বলতে গেলে পাঁচ
বৎসর থেকে পনেরো বছরের হিসেব দিতে হয়। যা শিখেছি তার বেশির ভাগ unconsciously শিখেছি, আর কিছু consciously. সুতরাং আমি consciously যা শিখেছি, তারই কথা প্রথমে উল্লেখ
করব। এই শহরেই আমি ক খ শিখেছি, A B C -ও শিখেছি।
কৃষ্ণনগরে এসে প্রথমে মিশনরি স্কুলে ভর্তি
হই। সে স্কুল বেশ বড় স্কুল
ছিল, আর কেলাস হত সব বড়-বড় ঘরে। কেলাসে কি শেখানে হত, তা মনে নেই। বোধ হয় প্রতি হপ্তায় একজন পাদরি এসে আমাদের
খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে বাংলায় বক্তৃতা দিতেন। মাসখানেক পরে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কী শিখেছি। আমি ও সেজদা আদম ও
ইভের নাম করতেই তিনি মহা চটে বললেন— ও সব গাঁজাখুরি গল্প তোমাদের শিখতে হবে না! আর কিছু শিখেছ ? আমরা বললুম পাদরিসাহেবের
কাছে একটি ভজন শিখেছি। বাবা জিজ্ঞেস করলেন— কী ভজন ?
আমরা দু-ভাই মিলে ভজনটি গাইলুম—
বন্যে এল ভেসে গেল, চাষার ডুবল ধান,
শালাদের যেমন কর্ম তেমনি শাস্তি দিলেন ভগবান
।
এ ভজন শুনে বাবা চোখ রাঙিয়ে বললেন— তোমাদের স্কুলে
আর যেতে হবে না । আর মা-কে সম্বোধন করেও বললেন— কী কর্ম ? মা বললেন, চাষাদের কুকর্ম এই যে, তারা খ্রিস্টান হয়নি।
এর পরই আমরা সে স্কুল ত্যাগ করলুম।
বাবা ছিলেন হিন্দু কলেজের ছাত্র। দেব-দ্বিজে তাঁর বিন্দুমাত্র
ভক্তি ছিল না। আমাদের চৌধুরী পরিবারের কেউই ভক্তিমার্গের পথিক ছিলেন না। যদিচ আমরা যাদব কির্তনিয়ার বংশধর ও শ্যামরায়
হচ্ছেন আমাদের কুলদেবতা, তবুও আমরা বৈষ্ণব নই। একে এই অভক্ত চৌধুরী পরিবারের ছেলে, তার উপর হিন্দু কলেজে
শিক্ষিত, তাই বাবা সকল ধর্ম সন্বন্ধে উদাসীন ছিলেন। বিশেষত খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি তাঁর কোনরূপ
অনুরাগ ছিল না। বরং বিরাগ ছিল। এর কারণ বোধ হয় অল্পবয়সে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় ছিল। উক্ত ভদ্রলোক খ্রিস্টধর্ম
অবলম্বন করায় বাবা খ্রিস্টধর্মকে ভয় করতেন। পূর্বেই বলেছি, তিনি কোন ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু তিনি জাতিতে
ব্রাহ্মন বলে ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা করতে সদাই উন্মুখ ছিলেন। পারিবারিক সংস্কারে তিনি এ বিষয়ে আবদ্ধ ছিলেন। সুতরাং আমরা যে আদম
ও ইভের রূপকথা শুনব, তিনি তা সহ্য করতে পারলেন না। এই সকল কারণে আমরা ছেলেবেলায় কোন ধর্মশিক্ষা
পাইনি।
গুরুজনদের আদেশে আমি ও আমার সেজদাদা মাসখানেকের মধ্যেই মিশনরি স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হলুম । অতঃপর আমরা ব্রজবাবুর
স্কুলে ভর্তি হলুম। সে স্কুল এখন A V School নামে পরিচিত।
এ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রজ মুখুজ্যে
নামক নেদের পাড়ার জনৈক ভদ্রলোক। নেদের পাড়ার ভালো নাম হয়তো নদীয়ার পাড়া। এ স্কুলে খ্রিস্টান
কিংবা অপর কোন ধর্মের নামগন্ধ ছিল না। ব্রজবাবু ছিলেন ঘোর নাস্তিক। তাঁর স্কুলে ঈশ্বরের প্রবেশ নিষেধ ছিল, উপরন্তু তিনি ছিলেন
ঘোর তার্কিক।
তাঁকে কেউ তর্কে এঁটে উঠতে পারতেন না; ফলে তাঁর সঙ্গে কেউ
সদালাপ করতেও ভয় পেতেন। রাস্তায় তর্কের ভয়ে লোকে তাঁর পাশ কাটিয়ে চলত। আমি দূর থেকে তাঁকে দেখেছি— শরীর তাঁর ছিল
কৃশ এবং আকার তাঁর ছিল দীর্ঘ। আর তাঁর চরিত্রও ছিল লাঠির মতো কঠিন।
এ স্কুলে ঢুকে আমরা খুশি হইনি।
মিশনরি স্কুল ছিল প্রকান্ড হাতার ভিতর প্রকান্ড
বাড়ি— পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন।
ব্রজবাবুর স্কুলে ছোট ছেলেদের ক্লাস হত একটা
অন্ধকূপে। একটি এঁদো ঘরে আমরা পড়তে যেতুম। সে ঘরে আলো আসত না, বাতাসও না। তার উপর ঘরটি ছিল এত ছোট যে, ছাত্রদের সে ঘরে ব্ল্যাক
হোল-এর মতো ঠাসা হত। সে স্কুলে কি পড়ানো হত আমার মনে নেই; বোধ হয় কিছুই হত না। শুধু শনিবারে একটি প্রকান্ড পুরনো ছবির বই
থেকে বাঘ-ভালুক প্রভৃতির ছবি দেখানো হত।
সিংহ আমরা ইতিপূর্বে দেখেছিলাম— ছবিতে নয়, মাটির সিংহ, প্রতিমার পায়ের নিচে। ভালুকের নৃত্যও দেখেছিলুম— দেখিনি শুধু
বিদেশি জানোয়ার। জিরাফের কথা আজও মনে আছে।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন— কী পড়ছ ?
আমরা বললুম— জানোয়ারের ছবি দেখছি
।
বাবা বললেন, আমি স্কুল ভেবে তোমাদের
দেখছি চিড়িয়াখানায় পাঠিয়েছি ।
তার পরদিনই তিনি আমাদের সে চিড়িয়াখানা হতে
বের করলেন ।
সেজদাদাকে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করা হলে
আমার শিক্ষা একটা সমস্যা হয়ে পড়ল। আমাকে তখন একটি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হল। কিন্তু সেখানে বেশি
দিন থাকা হল না। ইতিমধ্যে যে-সব বালকের সঙ্গে খেলার মাঠে পরিচিত হয়েছিলুম, তারা বিদ্রূপ করে বলতে
লাগল— যাদের দশ হাত কাপড়েও কাছা নেই, তাদের সঙ্গে পড়া লজ্জার
কথা। আমি বাবাকে বললুম— যাদের দশ হাত
কাপড়ে কাছা নেই, তাদের সঙ্গে এক স্কুলে পড়ব না।
বাবা কথাটা শুনে প্রথমে হাসলেন, পরে বললেন— তোমার কথা ঠিক।
দ্বিতীয় বার co-education ঐখানেই শেষ হল।
তারপর আমার বিদ্যারম্ভ হল। মা বললেন— অবু তবু গিরিসুতো
আর পুরুত কী বললে মনে নেই। তারপর বংশী মুচির জুতোর দোকানের পাঠ-শালায় তালপাতায় খাগড়ার কলম
দিয়ে ভুসো কালিতে বড়-বড় অক্ষরে ক খ লিখতে শিখি। কিন্তু বংমী মুচির পাঠশালায় বেশি দিন টিকতে
পারিনি। কাঁচা চামড়ার দুর্গন্ধে সেখান থেকে পালাতে হল। আমাদের বাসার কাছে Charity School নামে একটি ছাত্রবৃত্তি স্কুল ছিল, তারপর সেই স্কুলে ভর্তি হলুম। এ স্কুলে আমার বুদ্ধিবৃত্তি খুলে গেল এবং
সত্য কথা বলতে যথার্থ লেখাপড়া শিখতে আরম্ভ করলুম। এ স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন একজন “কুরি”— যাকে আমরা বলি
ময়রা। লোকটি ছিলেন প্রকান্ড
পুরুষ, অতি ভদ্র, অতি সহৃদয় ও রাশভারি লোক। ছেলেদের তিনি মারধর করতেন না, তা হলেও আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা করতুম। এ স্কুলে আমি প্রায়
তিন বৎসর পড়ি। আর সেখানেই আমি সমগ্র পাটিগণিত, বাংলার ইতিহাস ও ভারতবর্ষের ইতিহাস, কৃত্তিবাসের রামায়ন
ও কাশীরাম দাসের মহাভারত— অবশ্য আংশিক ভাবে— শিখি। আর শিখি শিকলের জরিপ আর কালি করতে। শেষটা বড়দাদা আমাকে সে স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য
করলেন। আমাদের বাড়িতে জনৈক
ভদ্রমহিলা মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, মেমের সাজপোশাক-পরা ও কষে কর্সেট-আঁটা। তিনি চলে গেলে আমি
জিজ্ঞাসা করেছিলুম যে, কৃশাঙ্গীটি কে? দাদা বললেন যে ছোকরা যথেষ্ট বাংলা শিখেছে আর বেশি শিখতে হবে
না। পরের দিনই ছাত্রবৃত্তি
স্কুল থেকে আমার নাম কাটানো হল। তারপর কোন্ স্কুলে যাব তা স্থির করতে-করতে কিছু দিন গেল। সেকালে কৃষ্ণনগরে দেবনাথ
মাস্টার নামে একটি ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি যে কোন্ স্কুলের মাস্টার ছিলেন, তা কারও জানা ছিল না। ছিরু মাস্টার বলে একজন
ছিলেন, তিনি খালি-পায়ে খালি-গায়ে শীত-গ্রীষ্ম একখানি র্যাপার পিঠে ফেলে ভিক্ষে করে বেড়াতেন। তিনি কারও বাড়ি এসে
প্রথমেই প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম রামতনুবাবুর কেচ্ছা কাটতেন, তারপর সিকেটা-আধুলিটা
চাইতেন এবং তা পেতেন। সুখের বিষয় তাঁর কোন স্কুল ছিল না।
সূত্র : আত্মকথা - প্রমথ চৌধুরী
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেই, ব্লগে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা।