কৃষ্ণনগর ২য়-অংশ
দেবনাথ মাস্টার বেশভুষায়, চরিত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত
লোক ছিলেন। তিনি সদাসর্বদা মাস্টারমশায় সেজে বেড়াতেন। পায়ে একজোড়া তালি-মারা জুতো, পরনে পেন্টলুন, গায়ে একটি ছাতার কাপড়ের
চাপকান— বয়েসে যার রং হয়েছে হলদে— ও মাথায় একটি টুপি। তিনি বলতেন যে, তাঁর তুল্য শিক্ষক
আর নেই। তিনি একটি নতুন স্কুল খুলবেন এবং সেই স্কুলে আমাকে ভর্তি করতে হবে বলে বাবাকে ধরপাকড়
করতে লাগলেন। কিন্তু আমি তাতে রাজি হলুম না। না-হবার কারণ, স্কুলবাড়িটি ছিল জঘন্য। সেদিন শুনলুম দেবনাথ মাস্টারের স্কুল আজও
টিকে আছে এবং হাইস্কুল হয়েছে। এ পরিণতি যে কী করে হল, বুঝতে পারিনে। দেবনাথ মাস্টার হয়তো পয়লা নম্বরের শিক্ষক
ছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে যে কোন কালে কিছু শিক্ষা করেছেন, তার প্রমাণ আমরা পাইনি। সংস্কৃতে আছে যে, উদ্যোগী পুরুষসিংহ
লক্ষ্মীলাভ করে। যদিচ চেহারায় মাস্টারমশায় সিংহ ছিলেন না, ছিলেন কৃষ্ণবর্ণ অস্থিচর্মসার একটি ব্যক্তি।
সে যা-ই হোক, আমি কৃষ্ণনগরের কলেজিয়েট
স্কুলে ভর্তি হই এবং তেরো বৎসর পর্যন্ত পড়ি। এনট্রান্স পরীক্ষা দিতে যাব, এমন সময়ে ঘোর ব্যারামে
পড়ি; আর কিছু দিন বাবার কাছে আরায় থেকে পরে কলিকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হই। সেই বয়েস থেকেই আমি
কলিকাতাবাসী হই। কৃষ্ণনগরে কলেজিয়েট স্কুলের বিষয়ে বেশি কিছু বক্তব্য নেই। নিচু ক্লাসের মাস্টারেরা
ছিলেন কুমোর ও গাঁড়াল। এই জাতীয় শিক্ষকদের চেহারা আজও মনে আছে। পঞ্চানন পাল ছিলেন দীর্ঘাকৃতি পুরুষ— আর তাঁর মুখটি
ছিল বাটালি দিয়ে নয়, কুড়ুল দিয়ে কাটা; এমন বিশাল চোখ আজ পর্যন্ত আর কোন মানুষের
মুখে দেখিনি। আর নাকটি ছিল তদ্রুপ।
লাস্ট ক্লাসের গিরিশ পণ্ডিত আমাদের নীতি উপদেশ
দিতেন। তাঁর একটি উপদেশ আমার
আজও মনে আছে। তিনি বলেছিলেন যে, মাছমাংস কখনও খেয়ো না, যেমন আমি খাইনে। তবে মাছের ও মাংসের । ঝোল খেয়ো, যেমন আমি খাই; আর ঝোলের সঙ্গে যদি
দু-এক টুকরো মাছ কি মাংস আসে, তা খেতে পারো। যো আপসে আতা উসকো আনে দেও— এই বলে ! বাবা এই উপদেশের
কথা শুনে আমায় ফারসি পড়তে আদেশ করলেন। আমি আলেফ, বে পড়তে আরম্ভ করলুম। মৌলবি সাহেব ছিলেন অতি সুপুরুষ আর তাঁর বেশভূষা
ছিল সুন্দর— উপরন্তু তিনি ছিলেন অতি ভদ্র। কেন ফারসি পড়া ছেড়ে দিলুম, তা পরে বলব।
সে স্কুলের মাস্টারমশায়রা কেউ-কেউ ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন, সিক্সথ ক্লাসের মাস্টার অটল মৈত্র ও থার্ড ক্লাসের মাস্টার পূর্ণ
মিত্র। আমি ছাত্রবৃত্তি স্কুলে
যা শিখেছিলুম, কলেজিয়েট স্কুলে তার বেশি কিছু শিখিনি। পাটিগণিত, ভূগোল, বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাস শিখে এসেছিলুম। তাতেই এনট্রান্স পর্যন্ত
কুলিয়ে গিয়েছিল। নতুনের মধ্যে শুধু শিখেছিলুম ইংরেজি, সংস্কৃত, জ্যামিতি ও বীজগণিত। ইংরেজি অবশ্য স্কুলে শিখিনি, শিখেছিলুম আমার সেজদার
কাছে। তিনি আমাকে বুঝি আর
না-বুঝি স্কটের উপন্যাসগুলি পড়তে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বই পড়তে-পড়তে আমি ইংরেজি শিখি, আর আমাদের সহপাঠীদের
তুলনায় ভালোই শিখি। আর সংস্কৃত শিখি পরীক্ষা পাশ করবার মতো। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপক্রমণিকা থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ শিখি। স্কুলে যে-পণ্ডিতমশায়
ছিলেন, তিনি যেমন ভালোমানুষ, তেমনি নিবোধ। তাঁর কাছে কিছু শিখিনি, কেননা তিনি কিছুই শেখাতে পারতেন না। ছেলেবেলায় গল্প শুনেছি
যে, জনৈক ব্রাহ্মণ কোন পণ্ডিতকে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, স্তর্কালঙ্কার মশায়, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি উত্তর করেন, স্তিলের স্তৈল মেখে
স্ত্রিবেণীর ঘাটে স্তান করতে যাচ্ছি! আমাদের পণ্ডিতমশায়ের সংস্কৃত উচ্চারণ ছিল তদ্রুপ।
আমি স্কুলে কী শিখেছি, সেই কথাই বলছিলুম। সোজা কথা এই যে, বিশেষ কিছু শিখিনি। সেকালে শিক্ষার পদ্ধতি
তেমন বাঁধাধরা ছিল না। এবং নিচু ক্লাসের মাস্টারমশায়রাও তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। তবে তাঁরা আমাদের গায়ে হাত দিতেন না। এককথায়, সেকালে শিক্ষার অত্যাচার
ছিল না।
স্কুলে আমরা ক, খ শিখি আর অনেক জিনিস
শিখি unconsciously.
কৃষ্ণনগর ছিল পাড়াগেঁয়ে শহর— অর্থাৎ অর্ধেক
শহর, অর্ধেক পাড়াগাঁ। সেখানে অনেক কামার, কুমোর, ছুতোর, স্যাকরা, কলু প্রভৃতি বাস করত, আর তাদের দোকানে আমাদের গতিবিধি ছিল অবাধ। এমনকী, গুলির আড্ডায়ও দু-একবার
গিয়েছি। শুঁড়ির দোকানেও । গুলি খেত ছোটলোকেরা, আর মদ খেত আধা-ভদ্রলোকে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল বাঙাল; জমিদারির আমলা যারা, মোকদ্দমার তদ্বির করতে
কৃষ্ণনগরে আসত। কিন্তু শুঁড়িরা মদ খেত না— অন্তত দোকানে নয়।
আমাদের ছেলেবয়সে ঘুড়ি ওড়াবার শখ ছিল, সুতরাং কাকে লাট খাওয়া
বলে, কাকে কান্নি মারা বলে, কাকে গোত্তা মারা বলে, তা-ও আমরা শিখেছিলুম এবং তাসের সুতোর গুণ
কী, রিলের সুতোর বা ফেটির সুতোরই বা গুণ কী, তা-ও আমরা শিখেছিলুম। ফেটির সুতো হচ্ছে দেশি
সুতো। চাষারা ও-সুতো উরতের
উপর পাক দিত। খরমাঞ্জা ধরে মাকি ফেটির সুতোরই উপর ভালো। ঘুড়ি অবশ্য নিম্নশ্রেণীর ছোকরাও ওড়াত। এই সূত্রে সব জাতের
ছেলেদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল ।
কৃষ্ণনগর কলেজের উত্তরে মালোপাড়া বলে একটি
পাড়া ছিল।
সেখানে বাস করত যারা মাছ ধরে, নৌকো বায়। তারা ছিল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। আর তাদের কাছেই শিখেছি, নৌকোর কোন অংশকে গলুই
বলে, কাকে পাটাতন বলে, আর কাকে হাল বলে, কাকে লগি মারা বলে, কাকে গুণ টানা বলে। আর তা ছাড়া নৌকোয়
কাঠ জুড়তে হয় গাবের আঠা দিয়ে। এদের নৌকোয় আমি একবার কৃষ্ণনগর থেকে পলাশী গিয়েছি, দু-বার হুগলী পর্যন্ত। ঝড়ঝাপটা উঠলে আমাদের
নৌকো থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হত, আর মাঝি নোঙর ফেলত।
এর থেকে সহজেই বুঝা যাবে যে, বাংলা ভাষা আমি একমাত্র
বই পড়ে শিখিনি। শিখেছি নানা শ্রেণীর নানা লোকের মুখে শুনে; যেমন সকলেই শেখেন। কিন্তু এ সব কথা আজ পর্যন্ত আমাদের পাঠ্যপুস্তকের
অন্তর্ভুক্ত হয়নি; বোধোদয়েও নয়, কথামালাতেও নয়,
সীতার বনবাসে তো নয়-ই। আমি ও-জাতীয় শব্দ আবশ্যক হলে আমার লেখায়
ব্যবহার করি। ফলে আমার সাহিত্যিক ভাষারও পুঁজি বেড়ে গিয়েছে। আমি কৈশোরে ফরাসি ভাষাও কিঞ্চিৎ আয়ত্ত করি, কিন্তু আজ পর্যন্ত
ও-ভাষার বই সহজে পড়তে পারিনে, কারিগরদের নিত্যব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে পরিচিত নই বলে। এ ছাড়া বহু গাছপালা
ও সাপের নাম শিখি। সে সব নাম চলতি ভাষাতেই পাওয়া যায়। অবশ্য এ সব কথার প্রদেশ বিশেষে কিঞ্চিৎ প্রভেদ আছে। কারিগরদের যন্ত্রপাতির
নাম শুধু কানে শুনে শেখা যায় না, তাদের চোখে দেখেও শিখতে হয়; গাছপালারও তা-ই, পাখি ও জানোয়ারদেরও
তা-ই। নামের সঙ্গে রূপের
বিচ্ছেদ ঘটিয়ে এ সব কথা আয়ত্ত করতে হয় না। তা ছাড়া, সেকালে নদে-শান্তিপুরের মৌখিক কথাও খুব শ্রুতিমধুর
ছিল। আমাদের বিশ্বাস ছিল
সেই ভাষাই— কী উচ্চারণে, কী অর্থব্যক্তিতে— বাংলার শ্রেষ্ঠ ভাষা। সে ভাষার তুলনায়— কী পূর্ববঙ্গের,
কী কলকাতার ভাষা ঈষৎ শ্রুতিকটু লাগত। তাই আমার ভাষার বনেদ হচ্ছে সেকালের কৃষ্ণনাগরিক
ভাষা। ইতিমধ্যে আমার মুখের
কথা যদি কিছু বদলে গিয়ে থাকে তো সে কলকাতার মৌখিক ভাষার প্রভাবে নয়। আমি এখন সাহিত্যিক
বলে গণ্য। তাই আমার বাংলা ভাষা শিক্ষার কথা বলছি। আমি জন্মেছিলুম পদ্মাপারের বাঙাল, কিন্তু আমার মুখে ভাষা
দিয়েছে কৃষ্ণনগর। সেই ভাষাই আমার মূল পুঁজি, তারপর তা সুদে বেড়ে গিয়েছে। বাংলা বই ছেলেবেলায় অনেক পড়েছি, কিন্তু বইয়ের ভাষা
আমার কস্মিনকালেও আদর্শ ছিল না।
অবশ্য কে কোথা থেকে ভাষা সংগ্রহ করেছেন বলা
শক্ত, কিন্তু মোটামুটি ভাবে বলা যায়, তা-ই বলতে চেষ্টা করলুম। ভাষা ব্যবহার করতে selection-এর প্রয়োজন— আর এই selection হয় লেখকের স্বীয়
রুচি অনুসারে।
আমি সেকালের কৃষ্ণনগরের কথা বড় বেশি করে
বলছি। তার কারণ এই যে, আমাদের বিশ্বাস ছিল
তার তুল্য ভাষা বাংলায় আর কোথাও নেই।
যার গলায় সুর আছে সে গান করতে বসলে তার সুর
যেমন আপনা হতেই বাঁকেচোরে আর ঘোরে; তেমনি যার মুখের ভাষা ভালো, সে-ও সে ভাষাকে ইচ্ছা করলে বাঁকাতে-ঘোরাতে
পারে। ভাষার এই স্থিতিস্থাপকতার
সন্ধান কৃষ্ণনাগরিকরা জানতেন, এরই নাম বাক্চাতুরী। ভাষা শুধু কাজের ভাষা নয়, লেখারও ভাষা। ফরাসিরা যাকে jeu de mots বলে, সে খেলার চর্চা সে
শহরেও করা হত। এর ফলে আমার লেখার ভিতর যদি বাক্চাতুরী থাকে তো তার জন্য আমি কৃষ্ণনগরের কাছে
ঋণী। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। সেকালে যারা ছোকরা
ছিল, তাদের মধ্যে দু-জন লেখক বলে স্বীকৃত হয়েছেন—দ্বিজেন্দ্রলাল
রায়, আর আমি। আমরা দু-জনেই কৃষ্ণনাগরিক। আমাদের দু-জনেরই লেখায় আর যে-গুণের অভাব থাক—রসিকতার অভাব নেই। দ্বিজেন্দ্রলালের বিশিষ্ট রচনার নাম হাসির গান আর বীরবলের কথা
কান্নার বস্তু নয়।
দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান শুধু লোককে হাসাবার
জন্য লেখা হয়নি। এর মধ্যে অনেকগুলি গান মারাত্মক বিদ্রুপে পরিপূর্ণ। চিনির মোড়কে যেমন কুইনিনের বড়ি খাওয়ানো
হয়, দ্বিজেন্দ্রলাল তেমনি হাসির মোড়কে মেকি পেট্রিয়টিজম, ঝুটো ধর্ম ও নানা প্রকার
সামাজিক মিথ্যাচারের উপর তাঁর তীক্ষ্ম বিদ্রুপ-বাণ বর্ষণ করেছেন। বীরবলও তেমনি লোকের
অন্তরে মিছরির ছুরি ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন।
এর কারণ, আমার ছেলেবেলায় কৃষ্ণনাগরিকরা পঞ্জিকাশাসিত
ছিলেন না, যেমন আজও অনেক শিক্ষিত লোক আছেন। তাঁদের মধ্যে ধর্মের গোঁড়ামি ছিল না। অধিকাংশ লোক এ বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। যদিচ কৃষ্ণনগর নবদ্বীপের
পাশের নগর, তবুও সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের কোন ভক্তকে আমি দেখিনি। কৃষ্ণনাগরিকরা ব্রাহ্ম ছিলেন না, দু-একজন ছাড়া। সুতরাং কোন ধর্মের
গোঁড়ামি আমাদের কান-মন স্পর্শ করেনি। সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক মতামত থেকে আমরা মুক্ত ছিলুম। এর ফলে মানসিক খোলা
হাওয়ায় আমরা বাস করতুম। সব জিনিস হেসে উড়িয়ে দেওয়া তাদের স্বাভাবিক ছিল। ঠাট্টা জিনিসটেরই তারা
চর্চা করত।
ভাষা আমরা একমাত্র লোকের মুখে শিখিনে, বই পড়েই শিখি। কৃষ্ণ-নগরে বাসকালে
আমি কী-কী বই পড়েছিলুম, তা বলছি। আমি ছাত্রবৃত্তি স্কুলে কাশীদাসের মহাভারতের কতক অংশ, আর হয়তো ও তারিণীচরণের
ভারতবর্ষের ইতিহাস— এই দুখানি বই আমায় স্বদেশের ইতিহাসের জ্ঞান দেয়। সেকালে আমার মনে হত, বই দুখানি ভালো ও সুখপাঠ্য। আমাদের বাড়িতে বাংলা
বইও খানকতক ছিল। বঙ্গদর্শন বাঁধানো ছিল। আর সেই বাঁধানো বঙ্গদর্শন থেকে আমি বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী, মৃণালিনী ও বিষবৃক্ষ, আর বোধ হয় কপালকুণ্ডলা
পড়ি। দীনবন্ধু মিত্রের নবীন
তপস্বিনী, লীলাবতী, সুরধুনী কাব্য আর নবীন সেনের পলাশীর যুদ্ধও পড়ি। নীলদর্পণ আমি পড়িনি, কিন্তু তার অভিনয়
দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠি। রঙ্গলালের পদ্মিনী উপাখ্যান আমাদের খুব প্রিয় কাব্য ছিল। আর এ ছাড়া শিশির ঘোষের
নওশ’ রুপেয়া ।
বাবা বাংলা বই পড়তেন না, কেননা তিনি হিন্দু
কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি দেদার বই পড়তেন, কিন্তু সে সবই ইংরেজি বই। তবে এ সব বই এল কোত্থেকে?— বাবা যখন যশোরে ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তখন দীনবন্ধু মিত্র সে শহরে পোস্ট আফিসে কোন বড় চাকরি করতেন, নবীন সেনও ছোকরা ডেপুটি
ছিলেন, আর আমার বিশ্বাস, বঙ্কিমের ভাই সঞ্জীবও ছিলেন ডেপুটি: আর শিশির ঘোষ তো যশোরের
লোক ।
সে যা-ই হোক— অল্পবয়সেই আমি কালী
সিংহের মহাভারত পড়েছি, আর পড়েছি হরিদাসের গুপ্তকথা। এ বই অবশ্য বালকের পাঠ্য নয়, কিন্তু তার ভাষা সাধুভাষা
নয়, আর অতিশয় চটকদার। সে বইয়ের প্রথম পাতা পড়ে দেখবেন— লেখা কী চমৎকার। অবশ্য আরব্য উপন্যাস বাংলায় পড়েছি আর পারস্য উপন্যাস, রবিনসন ক্রুশো ও রাসেলাস্। হেমচন্দ্রের কবিতাবলীর
একটি ‘ভারত সঙ্গীত’ আমাদের সেকালে মুখস্থ ছিল। সেকালে বাঙালির মনে পেট্রিয়টিজমের জোয়ার
এসেছিল— আর আমরা ছোট ছেলেরা সে জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলুম।
আমাদের বাড়িতে ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা ছিল। বাবার পড়ার ঝোঁক বোধ
হয় উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা লাভ করি।
আমার বড়দাদা ইংরেজি ভাষা খুব ভালো জানতেন; আর আমার সেজদাদা কুমুদনাথ
অল্প বয়েস থেকেই ছিলেন শিকারি। তিনি শিকারের বই পেলেই পড়তেন। শেষ বয়সে তিনি শিকার করতে গিয়ে বাঘের হাতে
প্রাণ দিয়েছেন। তিনিই আমাকে ইংরেজি নভেল পড়তে শেখান, এ কথা পূর্বে বলেছি।
আমাদের ইংরেজি সাহিত্যচর্চার সুযোগ ছিল। বাবার একটি ইংরেজি
বইয়ের প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল। মা-র মুখে শুনেছি, বাবা হিন্দু কলেজ থেকে পাশ করে ফেরবার সময়ে
এক দিনে এই লাইব্রেরি কেনেন। এ লাইব্রেরিতে ছিল অনেক ইতিহাসের বই ও প্রতি ঐতিহাসিকের সমগ্র
বই। কারও বই সাত-আট ভল্যুমের
কম নয়। আর ছিল স্কটের সমস্ত বই। দশ-বারো ভল্যুম শেক্সপিয়রের, মিলটনের সমস্ত কাব্য, বায়রনেরও তাই। বলা বাহুল্য এ সব বই
আমরা স্পর্শও করিনি। মধ্যে-মধ্যে স্কটের দু-একটি নভেল পড়েছি। এই লাইব্রেরির প্রসাদে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে
আমার পরিচয় হয়। আমি বহু ইংরেজি বইয়ের নাম জানতাম। এর ফলে দাদার, সেজদার, আমার ও আমার ছোট ভাই অমিয়র বই, কেনা বাতিক হয়।
পরে আমরা প্রত্যেকেই এক-একটি লাইব্রেরি সংগ্ৰহ
করি। সব চাইতে বড় লাইব্রেরি
ছিল দাদার, তারপর সেজদার ও অমিয়র। বাবার লাইব্রেরি ও দাদার লাইব্রেরি এখন কাশীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার ফরাসি লাইব্রেরিও
সেখানে, এবং আমার ইংরেজি বই শান্তিনিকেতনে। আর শ-পাঁচেক বই আমার কাছে আছে।
বই কিনলেই যে পণ্ডিত হয়, তা অবশ্য নয়। তবুও এ সব কথা বলছি
এই জন্য যে, লাইব্রেরি করার শখ এখন আর লোকের নেই। তার একটি কারণ, লাইব্রেরি থাকলে পুরনো কাগজের দামে বিক্রি হয়।
কলকাতা শহরে দেখেছি কোন-কোন বাড়িতে বড় লাইব্রেরি
ছিল; এখন নেই।
আমি জানি সুবোধ মল্লিকের কাকা হেমন্ত মল্লিকের
বাড়িতে একটি নাতি-হ্রস্ব লাইব্রেরি ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেদার বই কিনতেন, কিন্তু লাইব্রেরি গড়েননি। গগনেন্দ্র ঠাকুরের
বাড়িতে একটি প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল। এবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের একটি চমৎকার লাইব্রেরি
ছিল। তাঁর সংগৃহীত ফরাসি
বই আমি কিনি। কিন্তু তাঁর ইংরেজি বইয়ের কী হল জানিনে। বিদ্যাসাগর মহাশয়েরও প্রকাণ্ড লাইব্রেরি
ছিল।
এ সব কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে, আমরা কৈশোরে লাইব্রেরির
আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছি। এখন লাইব্রেরি হয়েছে সকলের জন্য— ব্যক্তিবিশেষের জন্য
নয়।
আমি ইতিমধ্যে কিঞ্চিৎ ইংরেজিও শিখেছিলুম। মাস্টারমশায়ের পড়ানের
গুণে নয়— নিজে পড়েই । আমি ছাত্রবৃত্তি স্কুলে পড়া ছেলে— ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ
আমার মোটেই ভালো ছিল না। বার্ড, ওয়ার্ড প্রভৃতি শব্দ আমি ঠিক উচ্চারণ করতে পারতুম না, আর দাদীরা আমার এই
অক্ষমতার দরুন আমাকে ঠাট্টা করতেন। আমার বয়েস যখন নয়, তখন সেজদাদা আমার ইংরেজি শিক্ষার ভার নিলেন। আমাদের অবশ্য জনৈক
গৃহশিক্ষক ছিলেন। তিনি যখন আমাকে a b.c. d শেখান, তখন তিনি ফার্স্ট কেলাসে পড়তেন, আর আমি যখন এন্ট্রান্স
কেলাসে উঠি, তখনও তিনি সেই কেলাসেই পড়তেন। তিনি এনট্রান্স কেলাসে শিকড় গেড়েছিলেন। ইংরেজি ভাষার অক্ষমতাই
তাঁর লাগাড় ফেলের কারণ। তাঁর কাছে একটি অমূল্য উপদেশ পেয়েছি। তিনি উঠতে-বসতে বলতেন, ‘হরি হে ত্রাণ করো, যার ধারি তার মরণ করো।’ তাঁর গুরুভক্তির আর—একটি প্রমাণ—তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন— ‘গুরু! টেনে ধরো চোখের ভুরু।’ ইনি ঢুকেছিলেন আমাদের গৃহশিক্ষক হয়ে, শেষটা হয়েছিলেন আমাদের
বাজার-সরকার।
সূত্র : আত্মকথা - প্রমথ চৌধুরী
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেই, ব্লগে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা।