:::: সূচীপত্র ::::
কৃষ্ণনগর ২য়-অংশ

দেবনাথ মাস্টার বেশভুষায়, চরিত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত লোক ছিলেনতিনি সদাসর্বদা মাস্টারমশায় সেজে বেড়াতেনপায়ে একজোড়া তালি-মারা জুতো, পরনে পেন্টলুন, গায়ে একটি ছাতার কাপড়ের চাপকান বয়েসে যার রং হয়েছে হলদে ও মাথায় একটি টুপিতিনি বলতেন যে, তাঁর তুল্য শিক্ষক আর নেইতিনি একটি নতুন স্কুল খুলবেন এবং সেই স্কুলে আমাকে ভর্তি করতে হবে বলে বাবাকে ধরপাকড় করতে লাগলেনকিন্তু আমি তাতে রাজি হলুম নানা-হবার কারণ, স্কুলবাড়িটি ছিল জঘন্যসেদিন শুনলুম দেবনাথ মাস্টারের স্কুল আজও টিকে আছে এবং হাইস্কুল হয়েছেএ পরিণতি যে কী করে হল, বুঝতে পারিনেদেবনাথ মাস্টার হয়তো পয়লা নম্বরের শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে যে কোন কালে কিছু শিক্ষা করেছেন, তার প্রমাণ আমরা পাইনিসংস্কৃতে আছে যে, উদ্যোগী পুরুষসিংহ লক্ষ্মীলাভ করেযদিচ চেহারায় মাস্টারমশায় সিংহ ছিলেন না, ছিলেন কৃষ্ণবর্ণ অস্থিচর্মসার একটি ব্যক্তি

সে যা-ই হোক, আমি কৃষ্ণনগরের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হই এবং তেরো বৎসর পর্যন্ত পড়িএনট্রান্স পরীক্ষা দিতে যাব, এমন সময়ে ঘোর ব্যারামে পড়ি; আর কিছু দিন বাবার কাছে আরায় থেকে পরে কলিকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হইসেই বয়েস থেকেই আমি কলিকাতাবাসী হইকৃষ্ণনগরে কলেজিয়েট স্কুলের বিষয়ে বেশি কিছু বক্তব্য নেইনিচু ক্লাসের মাস্টারেরা ছিলেন কুমোর ও গাঁড়ালএই জাতীয় শিক্ষকদের চেহারা আজও মনে আছেপঞ্চানন পাল ছিলেন দীর্ঘাকৃতি পুরুষ আর তাঁর মুখটি ছিল বাটালি দিয়ে নয়, কুড়ুল দিয়ে কাটা; এমন বিশাল চোখ আজ পর্যন্ত আর কোন মানুষের মুখে দেখিনিআর নাকটি ছিল তদ্রুপ

লাস্ট ক্লাসের গিরিশ পণ্ডিত আমাদের নীতি উপদেশ দিতেনতাঁর একটি উপদেশ আমার আজও মনে আছেতিনি বলেছিলেন যে, মাছমাংস কখনও খেয়ো না, যেমন আমি খাইনেতবে মাছের ও মাংসের ঝোল খেয়ো, যেমন আমি খাই; আর ঝোলের সঙ্গে যদি দু-এক টুকরো মাছ কি মাংস আসে, তা খেতে পারোযো আপসে আতা উসকো আনে দেও এই বলে ! বাবা এই উপদেশের কথা শুনে আমায় ফারসি পড়তে আদেশ করলেনআমি আলেফ, বে পড়তে আরম্ভ করলুমমৌলবি সাহেব ছিলেন অতি সুপুরুষ আর তাঁর বেশভূষা ছিল সুন্দর উপরন্তু তিনি ছিলেন অতি ভদ্রকেন ফারসি পড়া ছেড়ে দিলুম, তা পরে বলব

সে স্কুলের মাস্টারমশায়রা কেউ-কেউ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন, সিক্সথ ক্লাসের মাস্টার অটল মৈত্র ও থার্ড ক্লাসের মাস্টার পূর্ণ মিত্রআমি ছাত্রবৃত্তি স্কুলে যা শিখেছিলুম, কলেজিয়েট স্কুলে তার বেশি কিছু শিখিনিপাটিগণিত, ভূগোল, বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাস শিখে এসেছিলুমতাতেই এনট্রান্স পর্যন্ত কুলিয়ে গিয়েছিলনতুনের মধ্যে শুধু শিখেছিলুম ইংরেজি, সংস্কৃত, জ্যামিতি ও বীজগণিতইংরেজি অবশ্য স্কুলে শিখিনি, শিখেছিলুম আমার সেজদার কাছেতিনি আমাকে বুঝি আর না-বুঝি স্কটের উপন্যাসগুলি পড়তে পরামর্শ দিয়েছিলেনবই পড়তে-পড়তে আমি ইংরেজি শিখি, আর আমাদের সহপাঠীদের তুলনায় ভালোই শিখিআর সংস্কৃত শিখি পরীক্ষা পাশ করবার মতোবিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপক্রমণিকা থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ শিখিস্কুলে যে-পণ্ডিতমশায় ছিলেন, তিনি যেমন ভালোমানুষ, তেমনি নিবোধতাঁর কাছে কিছু শিখিনি, কেননা তিনি কিছুই শেখাতে পারতেন নাছেলেবেলায় গল্প শুনেছি যে, জনৈক ব্রাহ্মণ কোন পণ্ডিতকে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, স্তর্কালঙ্কার মশায়, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি উত্তর করেন, স্তিলের স্তৈল মেখে স্ত্রিবেণীর ঘাটে স্তান করতে যাচ্ছি! আমাদের পণ্ডিতমশায়ের সংস্কৃত উচ্চারণ ছিল তদ্রুপ

আমি স্কুলে কী শিখেছি, সেই কথাই বলছিলুমসোজা কথা এই যে, বিশেষ কিছু শিখিনিসেকালে শিক্ষার পদ্ধতি তেমন বাঁধাধরা ছিল নাএবং নিচু ক্লাসের মাস্টারমশায়রাও তেমন শিক্ষিত ছিলেন নাতবে তাঁরা আমাদের গায়ে হাত দিতেন নাএককথায়, সেকালে শিক্ষার অত্যাচার ছিল না

স্কুলে আমরা ক, খ শিখি আর অনেক জিনিস শিখি unconsciously.

কৃষ্ণনগর ছিল পাড়াগেঁয়ে শহর অর্থাৎ অর্ধেক শহর, অর্ধেক পাড়াগাঁসেখানে অনেক কামার, কুমোর, ছুতোর, স্যাকরা, কলু প্রভৃতি বাস করত, আর তাদের দোকানে আমাদের গতিবিধি ছিল অবাধএমনকী, গুলির আড্ডায়ও দু-একবার গিয়েছিশুঁড়ির দোকানেও গুলি খেত ছোটলোকেরা, আর মদ খেত আধা-ভদ্রলোকেতাদের মধ্যে অনেকেই ছিল বাঙাল; জমিদারির আমলা যারা, মোকদ্দমার তদ্বির করতে কৃষ্ণনগরে আসতকিন্তু শুঁড়িরা মদ খেত না অন্তত দোকানে নয়

আমাদের ছেলেবয়সে ঘুড়ি ওড়াবার শখ ছিল, সুতরাং কাকে লাট খাওয়া বলে, কাকে কান্নি মারা বলে, কাকে গোত্তা মারা বলে, তা-ও আমরা শিখেছিলুম এবং তাসের সুতোর গুণ কী, রিলের সুতোর বা ফেটির সুতোরই বা গুণ কী, তা-ও আমরা শিখেছিলুমফেটির সুতো হচ্ছে দেশি সুতোচাষারা ও-সুতো উরতের উপর পাক দিতখরমাঞ্জা ধরে মাকি ফেটির সুতোরই উপর ভালোঘুড়ি অবশ্য নিম্নশ্রেণীর ছোকরাও ওড়াতএই সূত্রে সব জাতের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল

কৃষ্ণনগর কলেজের উত্তরে মালোপাড়া বলে একটি পাড়া ছিল

সেখানে বাস করত যারা মাছ ধরে, নৌকো বায়তারা ছিল ঘোর কৃষ্ণবর্ণআর তাদের কাছেই শিখেছি, নৌকোর কোন অংশকে গলুই বলে, কাকে পাটাতন বলে, আর কাকে হাল বলে, কাকে লগি মারা বলে, কাকে গুণ টানা বলেআর তা ছাড়া নৌকোয় কাঠ জুড়তে হয় গাবের আঠা দিয়েএদের নৌকোয় আমি একবার কৃষ্ণনগর থেকে পলাশী গিয়েছি, দু-বার হুগলী পর্যন্তঝড়ঝাপটা উঠলে আমাদের নৌকো থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হত, আর মাঝি নোঙর ফেলত

এর থেকে সহজেই বুঝা যাবে যে, বাংলা ভাষা আমি একমাত্র বই পড়ে শিখিনিশিখেছি নানা শ্রেণীর নানা লোকের মুখে শুনে; যেমন সকলেই শেখেনকিন্তু এ সব কথা আজ পর্যন্ত আমাদের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত হয়নি; বোধোদয়েও নয়, কথামালাতেও নয়, সীতার বনবাসে তো নয়-ইআমি ও-জাতীয় শব্দ আবশ্যক হলে আমার লেখায় ব্যবহার করিফলে আমার সাহিত্যিক ভাষারও পুঁজি বেড়ে গিয়েছেআমি কৈশোরে ফরাসি ভাষাও কিঞ্চিৎ আয়ত্ত করি, কিন্তু আজ পর্যন্ত ও-ভাষার বই সহজে পড়তে পারিনে, কারিগরদের নিত্যব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে পরিচিত নই বলেএ ছাড়া বহু গাছপালা ও সাপের নাম শিখিসে সব নাম চলতি ভাষাতেই পাওয়া যায়অবশ্য এ সব কথার প্রদেশ বিশেষে কিঞ্চিৎ প্রভেদ আছেকারিগরদের যন্ত্রপাতির নাম শুধু কানে শুনে শেখা যায় না, তাদের চোখে দেখেও শিখতে হয়; গাছপালারও তা-ই, পাখি ও জানোয়ারদেরও তা-ইনামের সঙ্গে রূপের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে এ সব কথা আয়ত্ত করতে হয় নাতা ছাড়া, সেকালে নদে-শান্তিপুরের মৌখিক কথাও খুব শ্রুতিমধুর ছিলআমাদের বিশ্বাস ছিল সেই ভাষাই কী উচ্চারণে, কী অর্থব্যক্তিতে বাংলার শ্রেষ্ঠ ভাষাসে ভাষার তুলনায় কী পূর্ববঙ্গের, কী কলকাতার ভাষা ঈষৎ শ্রুতিকটু লাগততাই আমার ভাষার বনেদ হচ্ছে সেকালের কৃষ্ণনাগরিক ভাষাইতিমধ্যে আমার মুখের কথা যদি কিছু বদলে গিয়ে থাকে তো সে কলকাতার মৌখিক ভাষার প্রভাবে নয়আমি এখন সাহিত্যিক বলে গণ্যতাই আমার বাংলা ভাষা শিক্ষার কথা বলছিআমি জন্মেছিলুম পদ্মাপারের বাঙাল, কিন্তু আমার মুখে ভাষা দিয়েছে কৃষ্ণনগরসেই ভাষাই আমার মূল পুঁজি, তারপর তা সুদে বেড়ে গিয়েছেবাংলা বই ছেলেবেলায় অনেক পড়েছি, কিন্তু বইয়ের ভাষা আমার কস্মিনকালেও আদর্শ ছিল না

অবশ্য কে কোথা থেকে ভাষা সংগ্রহ করেছেন বলা শক্ত, কিন্তু মোটামুটি ভাবে বলা যায়, তা-ই বলতে চেষ্টা করলুমভাষা ব্যবহার করতে selection-এর প্রয়োজন আর এই selection হয় লেখকের স্বীয় রুচি অনুসারে

আমি সেকালের কৃষ্ণনগরের কথা বড় বেশি করে বলছিতার কারণ এই যে, আমাদের বিশ্বাস ছিল তার তুল্য ভাষা বাংলায় আর কোথাও নেই

যার গলায় সুর আছে সে গান করতে বসলে তার সুর যেমন আপনা হতেই বাঁকেচোরে আর ঘোরে; তেমনি যার মুখের ভাষা ভালো, সে-ও সে ভাষাকে ইচ্ছা করলে বাঁকাতে-ঘোরাতে পারেভাষার এই স্থিতিস্থাপকতার সন্ধান কৃষ্ণনাগরিকরা জানতেন, এরই নাম বাক্‌চাতুরীভাষা শুধু কাজের ভাষা নয়, লেখারও ভাষাফরাসিরা যাকে jeu de mots বলে, সে খেলার চর্চা সে শহরেও করা হতএর ফলে আমার লেখার ভিতর যদি বাক্‌চাতুরী থাকে তো তার জন্য আমি কৃষ্ণনগরের কাছে ঋণীঅন্তত আমার তাই বিশ্বাসসেকালে যারা ছোকরা ছিল, তাদের মধ্যে দু-জন লেখক বলে স্বীকৃত হয়েছেনদ্বিজেন্দ্রলাল রায়, আর আমিআমরা দু-জনেই কৃষ্ণনাগরিকআমাদের দু-জনেরই লেখায় আর যে-গুণের অভাব থাকরসিকতার অভাব নেইদ্বিজেন্দ্রলালের বিশিষ্ট রচনার নাম হাসির গান আর বীরবলের কথা কান্নার বস্তু নয়

দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান শুধু লোককে হাসাবার জন্য লেখা হয়নিএর মধ্যে অনেকগুলি গান মারাত্মক বিদ্রুপে পরিপূর্ণচিনির মোড়কে যেমন কুইনিনের বড়ি খাওয়ানো হয়, দ্বিজেন্দ্রলাল তেমনি হাসির মোড়কে মেকি পেট্রিয়টিজম, ঝুটো ধর্ম ও নানা প্রকার সামাজিক মিথ্যাচারের উপর তাঁর তীক্ষ্ম বিদ্রুপ-বাণ বর্ষণ করেছেনবীরবলও তেমনি লোকের অন্তরে মিছরির ছুরি ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন

এর কারণ, আমার ছেলেবেলায় কৃষ্ণনাগরিকরা পঞ্জিকাশাসিত ছিলেন না, যেমন আজও অনেক শিক্ষিত লোক আছেনতাঁদের মধ্যে ধর্মের গোঁড়ামি ছিল নাঅধিকাংশ লোক এ বিষয়ে উদাসীন ছিলেনযদিচ কৃষ্ণনগর নবদ্বীপের পাশের নগর, তবুও সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের কোন ভক্তকে আমি দেখিনিকৃষ্ণনাগরিকরা ব্রাহ্ম ছিলেন না, দু-একজন ছাড়াসুতরাং কোন ধর্মের গোঁড়ামি আমাদের কান-মন স্পর্শ করেনিসর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক মতামত থেকে আমরা মুক্ত ছিলুমএর ফলে মানসিক খোলা হাওয়ায় আমরা বাস করতুমসব জিনিস হেসে উড়িয়ে দেওয়া তাদের স্বাভাবিক ছিলঠাট্টা জিনিসটেরই তারা চর্চা করত

ভাষা আমরা একমাত্র লোকের মুখে শিখিনে, বই পড়েই শিখিকৃষ্ণ-নগরে বাসকালে আমি কী-কী বই পড়েছিলুম, তা বলছিআমি ছাত্রবৃত্তি স্কুলে কাশীদাসের মহাভারতের কতক অংশ, আর হয়তো ও তারিণীচরণের ভারতবর্ষের ইতিহাস এই দুখানি বই আমায় স্বদেশের ইতিহাসের জ্ঞান দেয়সেকালে আমার মনে হত, বই দুখানি ভালো ও সুখপাঠ্যআমাদের বাড়িতে বাংলা বইও খানকতক ছিলবঙ্গদর্শন বাঁধানো ছিলআর সেই বাঁধানো বঙ্গদর্শন থেকে আমি বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী, মৃণালিনী ও বিষবৃক্ষ, আর বোধ হয় কপালকুণ্ডলা পড়িদীনবন্ধু মিত্রের নবীন তপস্বিনী, লীলাবতী, সুরধুনী কাব্য আর নবীন সেনের পলাশীর যুদ্ধও পড়িনীলদর্পণ আমি পড়িনি, কিন্তু তার অভিনয় দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠিরঙ্গলালের পদ্মিনী উপাখ্যান আমাদের খুব প্রিয় কাব্য ছিলআর এ ছাড়া শিশির ঘোষের নওশ রুপেয়া

বাবা বাংলা বই পড়তেন না, কেননা তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেনতিনি দেদার বই পড়তেন, কিন্তু সে সবই ইংরেজি বইতবে এ সব বই এল কোত্থেকে?— বাবা যখন যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তখন দীনবন্ধু মিত্র সে শহরে পোস্ট আফিসে কোন বড় চাকরি করতেন, নবীন সেনও ছোকরা ডেপুটি ছিলেন, আর আমার বিশ্বাস, বঙ্কিমের ভাই সঞ্জীবও ছিলেন ডেপুটি: আর শিশির ঘোষ তো যশোরের লোক

সে যা-ই হোক অল্পবয়সেই আমি কালী সিংহের মহাভারত পড়েছি, আর পড়েছি হরিদাসের গুপ্তকথাএ বই অবশ্য বালকের পাঠ্য নয়, কিন্তু তার ভাষা সাধুভাষা নয়, আর অতিশয় চটকদারসে বইয়ের প্রথম পাতা পড়ে দেখবেন লেখা কী চমৎকারঅবশ্য আরব্য উপন্যাস বাংলায় পড়েছি আর পারস্য উপন্যাস, রবিনসন ক্রুশো ও রাসেলাস্‌হেমচন্দ্রের কবিতাবলীর একটি ভারত সঙ্গীত আমাদের সেকালে মুখস্থ ছিলসেকালে বাঙালির মনে পেট্রিয়টিজমের জোয়ার এসেছিল আর আমরা ছোট ছেলেরা সে জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলুম

আমাদের বাড়িতে ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা ছিলবাবার পড়ার ঝোঁক বোধ হয় উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা লাভ করি

আমার বড়দাদা ইংরেজি ভাষা খুব ভালো জানতেন; আর আমার সেজদাদা কুমুদনাথ অল্প বয়েস থেকেই ছিলেন শিকারিতিনি শিকারের বই পেলেই পড়তেনশেষ বয়সে তিনি শিকার করতে গিয়ে বাঘের হাতে প্রাণ দিয়েছেনতিনিই আমাকে ইংরেজি নভেল পড়তে শেখান, এ কথা পূর্বে বলেছি

আমাদের ইংরেজি সাহিত্যচর্চার সুযোগ ছিলবাবার একটি ইংরেজি বইয়ের প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিলমা-র মুখে শুনেছি, বাবা হিন্দু কলেজ থেকে পাশ করে ফেরবার সময়ে এক দিনে এই লাইব্রেরি কেনেনএ লাইব্রেরিতে ছিল অনেক ইতিহাসের বই ও প্রতি ঐতিহাসিকের সমগ্র বইকারও বই সাত-আট ভল্যুমের কম নয়আর ছিল স্কটের সমস্ত বইদশ-বারো ভল্যুম শেক্সপিয়রের, মিলটনের সমস্ত কাব্য, বায়রনেরও তাইবলা বাহুল্য এ সব বই আমরা স্পর্শও করিনিমধ্যে-মধ্যে স্কটের দু-একটি নভেল পড়েছিএই লাইব্রেরির প্রসাদে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়আমি বহু ইংরেজি বইয়ের নাম জানতামএর ফলে দাদার, সেজদার, আমার ও আমার ছোট ভাই অমিয়র বই, কেনা বাতিক হয়

পরে আমরা প্রত্যেকেই এক-একটি লাইব্রেরি সংগ্ৰহ করিসব চাইতে বড় লাইব্রেরি ছিল দাদার, তারপর সেজদার ও অমিয়রবাবার লাইব্রেরি ও দাদার লাইব্রেরি এখন কাশীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার ফরাসি লাইব্রেরিও সেখানে, এবং আমার ইংরেজি বই শান্তিনিকেতনেআর শ-পাঁচেক বই আমার কাছে আছে

বই কিনলেই যে পণ্ডিত হয়, তা অবশ্য নয়তবুও এ সব কথা বলছি এই জন্য যে, লাইব্রেরি করার শখ এখন আর লোকের নেইতার একটি কারণ, লাইব্রেরি থাকলে পুরনো কাগজের দামে বিক্রি হয়

কলকাতা শহরে দেখেছি কোন-কোন বাড়িতে বড় লাইব্রেরি ছিল; এখন নেই

আমি জানি সুবোধ মল্লিকের কাকা হেমন্ত মল্লিকের বাড়িতে একটি নাতি-হ্রস্ব লাইব্রেরি ছিলরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেদার বই কিনতেন, কিন্তু লাইব্রেরি গড়েননিগগনেন্দ্র ঠাকুরের বাড়িতে একটি প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিলএবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের একটি চমৎকার লাইব্রেরি ছিলতাঁর সংগৃহীত ফরাসি বই আমি কিনিকিন্তু তাঁর ইংরেজি বইয়ের কী হল জানিনেবিদ্যাসাগর মহাশয়েরও প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল

এ সব কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে, আমরা কৈশোরে লাইব্রেরির আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছিএখন লাইব্রেরি হয়েছে সকলের জন্য ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়

আমি ইতিমধ্যে কিঞ্চিৎ ইংরেজিও শিখেছিলুমমাস্টারমশায়ের পড়ানের গুণে নয় নিজে পড়েই আমি ছাত্রবৃত্তি স্কুলে পড়া ছেলে ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ আমার মোটেই ভালো ছিল নাবার্ড, ওয়ার্ড প্রভৃতি শব্দ আমি ঠিক উচ্চারণ করতে পারতুম না, আর দাদীরা আমার এই অক্ষমতার দরুন আমাকে ঠাট্টা করতেনআমার বয়েস যখন নয়, তখন সেজদাদা আমার ইংরেজি শিক্ষার ভার নিলেনআমাদের অবশ্য জনৈক গৃহশিক্ষক ছিলেনতিনি যখন আমাকে a b.c. d শেখান, তখন তিনি ফার্স্ট কেলাসে পড়তেন, আর আমি যখন এন্ট্রান্স কেলাসে উঠি, তখনও তিনি সেই কেলাসেই পড়তেনতিনি এনট্রান্স কেলাসে শিকড় গেড়েছিলেনইংরেজি ভাষার অক্ষমতাই তাঁর লাগাড় ফেলের কারণতাঁর কাছে একটি অমূল্য উপদেশ পেয়েছিতিনি উঠতে-বসতে বলতেন, ‘হরি হে ত্রাণ করো, যার ধারি তার মরণ করো তাঁর গুরুভক্তির আরএকটি প্রমাণতিনি আমাদের শিখিয়েছিলেনগুরু! টেনে ধরো চোখের ভুরু ইনি ঢুকেছিলেন আমাদের গৃহশিক্ষক হয়ে, শেষটা হয়েছিলেন আমাদের বাজার-সরকার

সূত্র : আত্মকথা - প্রমথ চৌধুরী
মূল বইয়ে এমন অংশ বিভাজন নেই, ব্লগে প্রকাশের সুবিধার্থে এমন করা।